জমি-রাজনীতির নন্দীগ্রাম ২০০৭-এ সেই যে পায়ের তলা থেকে মাটি সরাতে শুরু করেছিল সিপিএমের, পূর্ব মেদিনীপুরে গত বছর বিধানসভা নির্বাচনেও সেই প্রবণতা বজায় ছিল। ২০০৮-এ পঞ্চায়েত নির্বাচন, ২০০৯-এ লোকসভা ভোট, ২০১০-এর পুরভোট এবং গতবছরের বিধানসভা নির্বাচনপরের পর বিপর্যয় দেখেছে বাম-শিবির। জেলার ১৬টি কেন্দ্রেই হার মানতে হয়েছিল বাম-প্রার্থীদের। নন্দীগ্রাম-কাণ্ডে ‘খলনায়ক’ বনে যাওয়া লক্ষ্মণ শেঠকে তাঁর ‘গড়’ হলদিয়াতেও বিপর্যস্ত করে দিয়ে গিয়েছিল তৃণমূল-হাওয়া। বছর ঘুরতেই আবার ভোট জেলার দুই পুরসভায়। পাঁশকুড়ার সঙ্গেই হলদিয়াতেও। এই শিল্পশহরের একদা ‘শেষ-কথা’ লক্ষ্মণ শেঠ নন্দীগ্রাম-কাণ্ডেই এখন জেলে। পুরভোটের আগে তাঁর জামিন পাওয়ার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে হাইকোর্টে। ১৯৯৭ থেকে টানা তিন দফায় হলদিয়ার পুরবোর্ড হাতে রাখা বাম নেতৃত্বের সামনে ক্ষমতা খোওয়ানোর ভ্রূকুটি। গতবছর বিধানসভায় পরাজয়ের পরে লক্ষ্মণ-জায়া, পুরপ্রধান তমালিকা পণ্ডাশেঠের সামনেও এ বার ফের ‘কঠিন লড়াই’। |
বাম-শিবিরকে উদ্বেগে রাখছে গত বছরের বিধানসভা ভোটের বুথওয়াড়ি বিশ্লেষণও। দেখা যাচ্ছে, পুর-এলাকার ২৬টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৫টিতেই এগিয়ে ছিল তৃণমূল। মাত্র ১১টি ওয়ার্ডে এগিয়ে থেকে ‘সংখ্যালঘু’ হয়ে পড়ে বামেরা। ২০০৭-এর সর্বশেষ পুর-নির্বাচনে ১৯টি ওয়ার্ডে জিতেছিলেন বাম-প্রার্থীরা। মাত্র ৭টি ওয়ার্ডে বাম-বিরোধীরা। বিধানসভার ফলাফলে বামেরা তাদের দখলে থাকা ৮টি ওয়ার্ডে পিছিয়ে পড়ে। অর্থাৎ বিধানসভা ভোটের ফলাফলকে ‘নিরিখ’ ধরলে হলদিয়া পুরবোর্ড হাতছাড়া হওয়ার অবস্থায় বামফ্রন্ট। তাদের পক্ষে একমাত্র বলবার মতো তথ্য ছিল, পুরপ্রধান তমালিকা পণ্ডাশেঠ তাঁর ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে ৩৫৮ ভোটের ‘লিড’ ধরে রেখেছিলেন। এ বার অবশ্য সেই ওয়ার্ড ছেড়ে তমালিকা প্রার্থী হয়েছেন ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে। যদিও বিধানসভা ভোটে সেখানেও এগিয়ে ছিল বামেরাই।
উপ-পুরপ্রধান নারায়ণ প্রামাণিকের ১০ নম্বর ওয়ার্ডে কিন্তু বাম-শিবির পিছিয়ে ছিল ৪৫৮ ভোটে। গ্রামীণ সুতাহাটার ৩ নম্বর ওয়ার্ড, দুর্গাচক এলাকার ৮ নম্বর ওয়ার্ড, শিল্পতালুকের ১২নং ওয়ার্ড, উদ্বাস্তু কলোনি গাঁধীনগর-ক্ষুদিরামনগরের ২০নং ওয়ার্ড, বন্দর আবাসন এলাকার ২২ নম্বর ওয়ার্ড কিংবা ২৬নং ওয়ার্ডেও পিছিয়ে পড়তে হয়েছিল বামেদের। পুর-শহরের বিভিন্ন বর্গের বসবাসের এলাকাতেই বামেদের ভোট কমেছিল বিধানসভায়। সব মিলিয়ে বামেরা তাদের দখলে থাকা ৩, ৮, ৯, ১০, ১২, ২০, ২২ এবং ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে পিছিয়ে পড়েছিল। বাম-বিরোধীরা কিন্তু তাদের দখলে থাকা ১, ২, ৪, ৫, ৬, ১৫ ও ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ‘লিড’ ধরে রাখতে পেরেছিল। তৃণমূল নেতৃত্বের তাই দাবি, পুর-ক্ষমতায় ‘পরিবর্তন শুধু সময়ের অপেক্ষা’। অন্য দিকে, বাম-নেতারাও একান্তে মানছেন, এ বার তাঁরা ‘সঙ্কটে’। এ জন্য অবশ্য তাঁরা নতুন শাসকদল তৃণমূলের ‘সন্ত্রাস’কেই ‘ঢাল’ করছেন। পাশাপাশি অবশ্য তাঁরা এটাও মনে করাচ্ছেন, গতবছর বিধানসভায় কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ছিল তৃণমূলের। পুরভোটে নেই। তাই, ঘুরেফিরে সেই ভোট-ভাগের অঙ্কেই ‘ক্ষীণ আশা’ দেখছেন বাম-শিবিরের কেউ কেউ।
আর পাঁশকুড়া পুরসভায়, গোটা পূর্ব মেদিনীপুর জেলার মধ্যেই প্রথম পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল ২০০৭-এ, নন্দীগ্রাম-আন্দোলন পর্বেই। বামেদের হটিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল-জোট। ১৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১০টিতে জিতেছিলেন জোট প্রার্থীরা। ৭টিতে বামেরা। তবে জোট-পরিচালিত পুরবোর্ডের কাজকর্ম নিয়ে নাগরিকদের মধ্যে ক্ষোভ জমেছে। আর সম্ভবত সে কারণেই ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনে পুর-এলাকায় তৃণমূল-জোটের যা ‘লিড’ ছিল, ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনের নিরিখে তা অনেকটাই কমে এসেছিল। বিধানসভা নির্বাচনে পাঁশকুড়া পুর-এলাকার ১৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১১টিতে জোট এগিয়ে থাকলেও সামগ্রিক ভাবে ‘লিড’ অনেকটাই কমে যায়। বিধানসভা নির্বাচনে পাঁশকুড়া পুর-এলাকায় জোট-প্রার্থী পান ১৪,২৯৯ ভোট। বাম-প্রার্থীর প্রাপ্তি ১২,৩৬৯ ভোট। অর্থাৎ সাকুল্যে মাত্র ১৯৩৫ ভোটের ‘লিড’ তৃণমূল-জোটের। অথচ ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনেও পুর-এলাকায় জোটের ‘লিড’ ছিল প্রায় ২৭০০ ভোটের। দু’বছরের মধ্যে ‘লিড’ কমে যায় ৮০০ ভোটের। ভোটার-সংখ্যার সামগ্রিক বৃদ্ধি হিসাবে রাখলে, জোটের ভোট-হ্রাস তাৎপর্যপূর্ণ।
বিধানসভা ভোটের ফলাফলের নিরিখে পাঁশকুড়া পুরসভার ১৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে জোটের দখলে থাকা ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪ ও ১৫এই দশটি ওয়ার্ড ছাড়াও সিপিএমের দখলে থাকা ১ নম্বর ওয়ার্ডেও তৃণমূল প্রার্থী এগিয়েছিলেন। বামেরা এগিয়েছিল মাত্র ৬টি ওয়ার্ডে। কিন্তু ২০০৯-এর লোকসভা ভোটের তুলনায় প্রায় সব ওয়ার্ডেই জোটের প্রাপ্ত-ভোট কমে গিয়েছিল বিধানসভায়। এ বার আবার জোট ভেঙে গিয়েছে। তাই ঈষৎ আশায় বামেরা। খানিক দুশ্চিন্তায় তৃণমূল-শিবিরই। যে কারণে তৃণমূল নেতৃত্বকে পাঁশকুড়ায় এসে বলতে হচ্ছে, জোট ভাঙার দায় তাঁদের নয়, কংগ্রেসের। কংগ্রেস-বিজেপি’র বিরুদ্ধে সমানতালে তোপ দাগতে হচ্ছে বাম-বিরোধী ভোট ভাগাভাগি রুখতে। তৃণমূলের স্থানীয় নেতৃত্ব এ জন্য পুরবোর্ডের খামতিকেও দায়ী করছেন। নিরঙ্কুশ ক্ষমতার জেলায় পাঁশকুড়াই কাঁটা শাসক-শিবিরে। |