‘নন্দীগ্রাম-হাওয়ায়’ ২০০৮-এর ত্রি-স্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে পূর্ব মেদিনীপুরে সেই যে জয়ের ধারা শুরু হয়েছিল তৃণমূলের, পরের লোকসভা-পুরসভা-বিধানসভা ভোটেও বজায় ছিল সেই ধারা। ব্যতিক্রম থেকে গিয়েছিল হলদিয়া পুরসভা। ১৯৯৭ থেকে তিন দফায় যেখানে টানা ক্ষমতায় বামেরাই। এ বার হলদিয়া পুরভোটে জয় তাই তৃণমূলের কাছে মস্ত চ্যালেঞ্জ। তেমনই বাম-শিবিরেও হলদিয়া রক্ষা ‘মর্যাদার লড়াই’।
২০০৭-এর শেষ পুর-নির্বাচনে ৭টি ওয়ার্ড দখল করেছিল তৃণমূল-শিবির। বাকি ১৯টি ওয়ার্ডে জিতে পুরবোর্ড গড়েছিল বামেরা। তবে রাজ্যের প্রধান শাসকদল তৃণমূল এ বার পুরভোটে নন্দীগ্রাম-স্মৃতি উস্কে দেওয়ার পাশাপাশিই পুর-পরিষেবায় বাম-বোর্ডের ‘ব্যর্থতা’ তুলে ধরতেও সচেষ্ট হয়েছে। তাদের দাবি, এ বার পুরসভায় ক্ষমতায় এসে তারাই ‘হাল ফেরাবে’। ১৫ বছর আগে পঞ্চায়েত-স্তর থেকে পুরসভায় উত্তীর্ণ হলদিয়ার আম-আদমিও বহু জায়গায় এখনও বুঝতেই পারেন না পুরসভার মর্ম। পুরভবন চত্বর চাকচিক্যে ভরা হলে কী হবে পুর-এলাকার বিস্তীর্ণ অংশে পরিস্রুত পানীয় জলেরও ব্যবস্থা হয়নি। বাসিন্দারাও পানীর জলের সঙ্কট নিয়ে সরব। কোথাও পানীয় জলের লাইন নেই তো কোথাও টাইমকলে ‘সুতোর মতো’ জল পড়ে। আবার অনেক এলাকায় ‘সবেধন নীলমণি’ টিউবওয়েলও দীর্ঘ দিন খারপ হয়ে পড়ে থাকার অভিযোগ। পুরপ্রধান তমালিকা পণ্ডাশেঠের অবশ্য দাবি, “জলের সমস্যা থাকলেও আমাদের পুরবোর্ডই সমস্যা কাটিয়ে ওঠারও চেষ্টা করে গিয়েছে বরাবর।”
হলদিয়াবাসীর কিন্তু অভিযোগ, জল-সঙ্কট কাটাতে পুরসভার তেমন উদ্যোগ গত কয়েক বছরে চোখেই পড়েনি। ১২, ১৪, ১৬ ও ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে জলসঙ্কট অত্যন্ত তীব্র। বেশিরভাগ এলাকাতেই নেই জলের পাইপলাইন। সম্পন্ন কিছু পরিবার নিজেদের উদ্যোগেই ‘স্যালো’ অথবা টিউবয়েল বসিয়ে নিয়েছে। সাধারণ মানুষের সে উপায় নেই। পুকুরের জলই তাঁদের ভরসা। শিল্প-শহরের দূষণে সেই জলটুকুও অনেক সময়ে পানের অযোগ্য। গরমে পুকুর শুকিয়ে গেলে জলের আকাল আরও বাড়ে। বাসিন্দাদের অনেকের অভিযোগ, প্রতিবার ভোটে কতশত প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ভোট মিটলেই যে-কে-সেই। জনগণ সেই তিমিরেই। এ ভাবেই চলছে বছরের পর বছর। |
টাইমকলের সুবন্দোবস্ত না-থাকায় পুরসভার উদ্যোগে টিউবওয়েল করা হয়েছিল ৩, ৫, ৬, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে। তৃণমূলেরও দাবি, বেশ কিছু টিউবওয়েল করা হয়েছে সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর বরাদ্দ টাকায়। ৬ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর বিদ্যাবতী পাত্রের অভিযোগ, “এখানে পানীয় জলের খুব সঙ্কট। বাম-পুরবোর্ড আমাদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণই করে এসেছে। আমাদের সাংসদের তহবিল থেকে কয়েকটা টিউবওয়েল বসিয়ে সঙ্কট সামালের চেষ্টা করেছি। পুরসভার রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অধিকাংশ টিউবওয়েলই আবার খারাপ হয়েছে।” বাসিন্দা হাফিজুল মল্লিকের কথায়, “একে তো পানীয় জলের সমস্যা। তার উপরে হাতেগোনা যে-কয়েকটি টিউবওয়েল আছে তাও খারাপ হয়ে থাকে অধিকাংশ সময়ে। গরমে যে কী ভয়ঙ্কর সমস্যা, তা বলে বোঝানো যাবে না।”
এ দিকে টাইমকল আছে কিন্তু ‘সুতোর মতো’ জল পড়ার ছবিও পুরসভার অধিকাংশ এলাকায়। যেখানে তিন-বেলা জল সরবারহের কথা, এক ঘণ্টা করে মাত্র দু’বেলা জল মেলে বলে অভিযোগ। অভিযোগ, বাড়ির কলের লাইনেও জল পড়ে ছিটেফোঁটা। জলের জন্য তাই সকাল থেকেই মাথায় হাত পড়ে বাসিন্দাদের। পুরপ্রধান তমালিকাদেবীর ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের (এ বার আবার তিনি ওয়ার্ড বদলেছেন) তৃণমূল নেতা সৌমেন বেরার অভিযোগ, “কাজ করার কোনও মানসিকতাই নেই ওনার। যিনি নিজের ওয়ার্ড ঠিক ভাবে দেখতে পারেন না, তিনি কেমন পুরসভা চালিয়েছেন, সহজেই বোঝা যায়! এই ওয়ার্ডের মানুষ পর্যাপ্ত জলটুকুও পায় না।” এই কথায় সুর মিলিয়েছেন ওই ওয়ার্ডের বাসিন্দা অকুলচন্দ্র বেরার মতো অনেকেই। তাঁর কথায়, “আমাদের দুর্দশা কেউ দেখে না। বাড়িতে খরচ করে জলের লাইন নিলেও জল পাই না ঠিক ভাবে। পুরপ্রধান নিজেই আসেন না এলাকায়।” তবে তমালিকাদেবীর বক্তব্য, “সমস্যা সব এলাকাতেই রয়েছে। আমরা খড়গপুর আইআইটি-কে দিয়ে একটা পরিকল্পনা করিয়েছিলাম। কিন্তু খরচ এত যে সেটা এখনও কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।” |