রাজ্য সরকারের বর্ষপূর্তিতে রবিবার সিঙ্গুরে মিছিল করল তৃণমূল। কিন্তু সেখানে পা মেলাতে দেখা গেল না অনেক ‘অনিচ্ছুক’ চাষিকে। মিছিলও গেল না বাজেমিলিয়া, বেড়াবেড়ি বা গোপালনগরের মতো গ্রামগুলিতে, যেগুলি সিঙ্গুরে জমি আন্দোলন-পর্বে রাজনৈতিক উত্তাপে নিয়মিত ‘তেতে’ থাকত।
হাজার দু’য়েক মানুষের ওই মিছিল রবিবার সকাল ৯টা নাগাদ শুরু হয় স্টেশন লাগোয়া বুড়াশান্তি মাঠ থেকে। সিঙ্গুর বাজার, হাসপাতালের পাশ দিয়ে রতনপুর হয়ে কিলোমিটার দেড়েক ঘুরে এক ঘণ্টার মধ্যে মিছিল শেষ হয় বুড়াশান্তি মাঠেই।
২০০৬ থেকে এত দিন তৃণমূল বা ‘কৃষিজমি রক্ষা কমিটি’ যখনই সিঙ্গুরের ওই এলাকায় কোনও কর্মসূচি নিয়েছে, তাতে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সামিল হয়েছেন ‘অনিচ্ছুকে’রা। এ দিন কী হল? সিঙ্গুরের সিপিএম নেতা বলাই সাঁবুইয়ের দাবি, “স্বতঃস্ফূর্ততায় এখন ভাটার টান। ওই মিছিলে বেশির ভাগ অনিচ্ছুকই যাননি। কামারকুণ্ডু, নসিবপুর থেকে তৃণমূল কর্মীরা ভিড় করেছেন।” হরিপালের তৃণমূল বিধায়ক তথা ‘কৃষিজমি রক্ষা কমিটি’র আহ্বায়ক বেচারাম মান্নার পাল্টা দাবি, “সব অনিচ্ছুকই মিছিলে সামিল হয়েছেন। মিছিল সফল।” |
সিঙ্গুরেরই আর এক তৃণমূল নেতা মানিক দাস অবশ্য মানছেন, অন্য বারের চেয়ে এ বার কম ‘অনিচ্ছুক’ মিছিলে এসেছেন। তাঁর যুক্তি, “গরমের জন্য কেউ কেউ আসেননি। বাজেমিলিয়ায় হরিনাম সংকীর্তনের আসরেও অনেকে গিয়েছেন। আমরা প্রস্তুতিরও সময় পাইনি।” অথচ জেলা তৃণমূল সূত্রের খবর, ওই মিছিল-কর্মসূচির প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল দিন দশেক আগেই।
আগে কত বার যে ‘কৃষিজমি রক্ষা কমিটি’র মিছিলে সামিল হয়েছেন, মনে করতে পারছিলেন না গোপালনগরের ঘোষপাড়ার আঙুরবালা ঘোষ। বললেন, “শুকিয়ে মরছি। আর ও সব ভাল লাগে না।” তাঁর প্রতিবেশী সুকুমার ঘোষ বা কেজেডি পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য নব ঘোষ আবার মিছিলের কথা জানতেন না বলে দাবি করেন।
শনিবারই তাঁদের জন্য মুখ্যমন্ত্রী যে ‘সরকারি সাহায্যে’র কথা ঘোষণা করেছিলেন, তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বহু ‘অনিচ্ছুক’। এ দিন বেড়াবেড়ির পূর্বপাড়ার অনিচ্ছুক জমিদাতা পরিবারের শ্যামলী দাস বললেন, “এ বারই প্রথম মিছিলের কথা শুনেও যাইনি।”
বিধানসভা ভোটের আগে যিনি সদ্যোজাত নাতির নাম রেখেছিলেন ‘পরিবর্তন’, সেই শ্যামলীদেবী এখন কাউকে আর বিশ্বাস করতে চান না। তাঁর কথায়, “জমি চাই। আর কিছু দিন দেখে আমরাই পাল্টা জমি ফেরতের জন্য আন্দোলনে নামব।” ‘কৃষিজমি রক্ষা কমিটি’র মিছিলে আর এক
পরিচিত মুখ বাজেমিলিয়ার ষাটোর্ধ্ব নিমাই সাঁতরাও এ দিনের মিছিলে অনুপস্থিত। কী হল? জবাব, “চাষিদের মন ভেঙে গিয়েছে।” |
মিছিল থেকে দূরেই রইলেন সরকারি সাহায্যে ক্ষুব্ধ তিন ‘অনিচ্ছুক’ শ্যামলী দাস, নিমাই সাঁতরা ও আঙুরবালা ঘোষ। |
বাঁকুড়ায় এ দিন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “ওই চাষিদের মাসে ১,০০০ টাকা পেয়ে লাভ হবে না। বরং তাঁরা জমি বিক্রি করে সেই টাকা ব্যাঙ্কে রাখলে বেশি সুদ পেতেন।” মুখ্যমন্ত্রীর সাহায্য দানের ঘোষণা অনিচ্ছুকদের ‘হতাশা ও ক্ষোভকে আরও বাড়িয়েছে’ বলে মন্তব্য করেছেন জমি-আন্দোলন পর্বে তৃণমূলের পাশে থাকা দল এসইউসি-র রাজ্য সম্পাদক সৌমেন বসুও।
‘সরকারি সাহায্য’ নিয়ে মুখ খুলেছেন সিঙ্গুরের ‘ইচ্ছুক’রাও। তাঁদের বক্তব্য, শিল্পের জন্য জমি দিয়ে টাকা পেয়েছেন। কিন্তু শিল্প না হওয়ায় প্রশিক্ষণ নিয়েও তাঁদের ছেলেমেয়েরা ‘বেকার’ হয়ে পড়েছেন। সেই ‘বেকার’ ছেলেমেয়েদের কথা সরকার কেন ভাবছে না? বেচারাম মান্না বলেন, “কিছু পাওয়ার আশায় এখন অনেক ‘ইচ্ছুক’ ‘অনিচ্ছুক’ সাজছেন। সরকার যে সাহায্য করছে, তাতে চাষিদের ভালই হবে। এ মাস থেকেই ওই সাহায্য কার্যকর করা হবে।”
|