বেপরোয়া দুষ্কৃতী-রাজে
লাগাম চায় অতিষ্ঠ জনতা
তুন আবাসন-প্রকল্প গড়ে উঠছে রাজারহাটে। সাইট ম্যানেজারের অভিজ্ঞতা বলছে, ইট-বালি নিতে হচ্ছে নির্দিষ্ট দুই গোষ্ঠীর কাছ থেকে। সেই সঙ্গেই তৃতীয় একটি গোষ্ঠীকে ‘তুষ্ট’ রাখতে হচ্ছে, তাদের কাছ থেকে কিছু নেওয়া হচ্ছে না বলে! নির্মাতারা বুঝছেন, যে জিনিস তৈরির খরচ ছিল আগে ১০ টাকা, এখন দাঁড়িয়েছে ৩০ টাকা!
সৌজন্যে ‘সিন্ডিকেট’!
সরকারের দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ এনে সিবিআই তদন্ত চাইছেন প্রধান শাসক দলের নিহত দুই কর্মীর স্ত্রী।
অভিযোগের নেপথ্যে সেই ‘সিন্ডিকেট-রাজে’র দাপট।
নিউ আলিপুরের ফ্ল্যাটবাড়ির বাসিন্দা থেকে নিউ টাউনের ব্যবসায়ী-শিল্পগোষ্ঠী অতিষ্ঠ ‘সিন্ডিকেটে’র জ্বালায়। তোলাবাজির জেরে ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ীদের নাভিশ্বাস উঠছে। ভুক্তভোগীরা প্রশাসনের সাহায্যপ্রার্থী। কিন্তু রাজনীতির ‘নিয়মে’ শাসক পক্ষের সবুজ সঙ্কেত ছাড়া প্রশাসনও নীরব!
পাশের বাড়িতে সশস্ত্র ডাকাত হানা দিয়েছে দেখে পড়শি ‘১০০’ ডায়াল করছেন। প্রথমে কেউ ফোন তুলছে না। ফের চেষ্টায় ও’প্রান্ত থেকে প্রশ্ন আসছে, একটা ভ্যান পাঠালে চলবে?
মহাকরণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক বছরের জমানায় আইন-শৃঙ্খলা জনিত কিছু ঘটনার সংক্ষিপ্ত ‘ফ্ল্যাশব্যাক’। ঘটনা ঘটছে। জানাজানি হচ্ছে। আবার ঘটছে। হার ছিনতাইকারীদের বাধা দিতে গিয়ে বাড়ির সামনে গুলিবিদ্ধ হচ্ছেন গৃহবধূ। গয়নার দোকান লুঠ করছে দুষ্কৃতীর দল। আবার ছিনতাই রুখে স্টেশনেই তিন দুষ্কৃতীকে পিটিয়ে মারছেন ক্ষুব্ধ রেলযাত্রীরা।
নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা খানিকটা প্রশ্নের মুখে। পুলিশের ‘নিষ্ক্রিয়তা’ এবং ক্ষেত্র বিশেষে ‘অতি-সক্রিয়তা’ (কার্টুন-কাণ্ডে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের গ্রেফতারিতে যেমন) একই রকম প্রশ্নের মুখোমুখি। ভুক্তভোগী আমজনতার একাংশ আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। প্রশাসনের একাংশ আশঙ্কায়, গণপিটুনির কালো ছায়া আবার উঁকি দিচ্ছে।
এ সব কি আগে ছিল না? ছিল! কিন্তু এমন ‘বেপরোয়া’ দুষ্কৃতী-রাজ ছিল না। যে জন্য আলোচনা উঠছে, এ সব পাল্টানোর জন্যই তো ‘পরিবর্তন’ আনা হয়েছিল!
সব চেয়ে বড় উদাহরণ ‘সিন্ডিকেট-রাজ’। বাম জমানার শেষ দশ বছরে ক্রমশ ডালপালা ছড়িয়েছে প্রোমোটার-ঠিকাদার এবং তার আনুষঙ্গিক দুষ্কৃতী-রাজের বিষবৃক্ষ। তৎকালীন শাসক দলের প্রাণকেন্দ্র আলিমুদ্দিন স্ট্রিট মাঝেমধ্যেই ‘ফরমান’ জারি করেছে, এ সবের সঙ্গে দলের কারও জড়িত থাকা চলবে না। কিন্তু নগরায়ণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ‘সিন্ডিকেট-রাজে’র দৌরাত্ম্য। বাড়ি তৈরি করতে গেলে তাদের কাছ থেকে তাদের বেঁধে-দেওয়া দামেই ইট-বালি-সিমেন্টের মতো ইমারতি দ্রব্য নিতে হবে এই ‘ফরমায়েশে’র কারবারিরা দিব্যি রাজনৈতিক ‘প্রশ্রয়’ পেয়েছে! আলিমুদ্দিনের ‘ফরমান’ রয়ে গিয়েছে পার্টি চিঠি বা দলীয় ‘নোটে’র কাগজেই। আমজনতার প্রত্যাশা ছিল, ‘পরিবর্তনে’র পরে সেই বিষবৃক্ষ সমূল উপড়ে ফেলবেন ‘প্রশাসক’-নেত্রী।
কিন্তু রাজারহাট বা অন্য যে সমস্ত কলকাতা লাগোয়া এলাকায় নগরায়ণ হচ্ছে দ্রুত গতিতে, সেখানে শাসক দলের একটা অংশ নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছেন ‘সিন্ডিকেট-কারবারে’। দলের প্রথম সারির নেতা-বিধায়করা প্রকাশ্যে না-এলেও তাঁদের ‘আশীর্বাদের হাত’ রয়েছে নিচু তলার কর্মীদের উপর। যাঁরা আবার সরাসরি বলছেন, ‘স্থানীয়’ ছেলেদের থেকে ইমারতি দ্রব্য নিতে হবে। মমতা নিজে একাধিক দলীয় সভায় বলেছেন, ‘সিন্ডিকেটে’র সঙ্গে জড়িত থাকা যাবে না। কিন্তু তা দলের নিচু তলা পর্যন্ত পৌঁছেছে বলে ভুক্তভোগীদের মনে হচ্ছে না।
রাজ্য মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং তৃণমূলের পদাধিকারী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলছেন, “এটা একটা নিরন্তর প্রক্রিয়া। বীজটা বপন করে গিয়েছে সিপিএম। আমাদের দলনেত্রী স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, ঠিকাদারি বা প্রোমোটারি করলে দল করার দরকার নেই! রাজ্য নেতৃত্ব দলীয় স্তরে লাগাতার বৈঠকে এর থেকে দূরত্ব রাখতে বলছেন। কিন্তু এত দিনের চলে-আসা একটা জিনিস এক দিনে তো বন্ধ হয় না!”
সরকার এবং তৃণমূল নেতৃত্বের বক্তব্য, রাজ্যের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলার দুই ‘অবিচ্ছেদ্য’ অঙ্গ পাহাড় এবং জঙ্গলমহলের পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক’ করে এনেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। তাঁদের মতে, জঙ্গলমহল ‘শান্ত’। পাহাড় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না-এলেও আগের চেয়ে অনেক ‘স্বাভাবিক’। আম আদমি অবশ্য পাহাড় বা জঙ্গলের চেয়ে অনেক বেশি ভাবিত তার বাড়ি ফেরার নিরাপত্তা নিয়ে। নিরাপদে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করা নিয়ে। মেয়ে বাড়ির বাইরে বেরোলে বিনা বিপত্তিতে তার বাড়ি ফেরা নিয়ে। পার্থবাবু ব্যাখ্যা করছেন, “আসলে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। আগে ৫০০টা ঘটনা ঘটলেও বিরাট কিছু হত না। এখন পাঁচটা ঘটলেও কথা হচ্ছে! রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত হয়ে প্রশাসন কাজ করার চেষ্টা তো করছে। তার ফলও মিলছে।”
পুলিশের কাজের ‘সুবিধা’র জন্য একের পর এক কমিশনারেট হয়েছে এক বছরে। কিন্তু পরিকাঠামো বাড়েনি। অপরাধের ঠেলায় জেরবার নাগরিক জীবনের অভিজ্ঞতার সূত্র ধরে বিরোধীরা তাই কটাক্ষ করতে পারছে ‘অপরাধীরা ভাবছে, আমাদের সরকার’! প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলছেন, “আমাদের সময়েও অপরাধ ছিল। কিন্তু এই রকম ছিল না! সোজা বাড়িতে ঢুকে খুন করে, ডাকাতি করে চলে গেল! সবাই ভাবছে, যা খুশি করো! কেউ কিচ্ছু বলবে না!” রাজ্যে কর্মরত এক আইএএসের বিশ্লেষণ, “প্রশাসনটা আসলে খুব ব্যক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। যেটা আগে ছিল না। সমস্যা মোকাবিলা করতে গিয়েও অনেক রকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সমন্বয়ের অভাব হচ্ছে।”
আপাতদৃষ্টিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতার ‘সমস্যা’ যা, তা-ই তাঁর বৃহত্তম ‘সুবিধা’! এই প্রশাসন এবং শাসক দলে তিনিই সব। আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে বেড়ে-চলা সংশয় নিরসনে তাঁর কড়া পদক্ষেপের দিকেই তাই তাকিয়ে ‘পরিবর্তনে’র পশ্চিমবঙ্গ।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.