কাছা সামলাতে কোঁচা খুলে যাচ্ছে। এক বছরে এ রকমই হাল রাজ্যের অর্থ দফতরের।
এই টানাটানির সংসার কেমন চালাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র?
রোজগার কতটা বাড়ল আর অপ্রয়োজনীয় খরচ কতটা কমানো গেল, সেটাই অর্থ দফতরের দক্ষতার মাপকাঠি। তাই প্রথমেই আসা যাক, আয় বাড়ানোর কথায়।
মদ এবং সিগারেট ছাড়া অন্য কোথাও কর না বসিয়ে অর্থমন্ত্রী যখন রোজগার (রাজস্ব আদায়) ৩০ শতাংশ বৃদ্ধির কথা বলেছিলেন, তখনই তা বিস্মিত করেছিল অর্থ দফতরের কর্তাদের। অর্থমন্ত্রীর আশা ছিল, কড়া হাতে ‘পুরস্কার ও তিরস্কার’ নীতি চালু করলেই ব্যবসায়ীদের থেকে কর আদায় বাড়ানো যাবে। তার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল, বৈদ্যুতিন পদ্ধতিতে কর জমা দেওয়ার ব্যবস্থা ও কর দেওয়ার পদ্ধতির সরলীকরণ। কিন্তু ওই দুই দাওয়াই-ই কার্যত বিফলে গিয়েছে।
কারণ, আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২৭,৬৯০ কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবে আদায় হয়েছে ২৪,৯৩৪ কোটি টাকা। বৃদ্ধির হার ১৮ শতাংশের কিছু বেশি (তার আগের বছর ছিল ২৫ শতাংশ)।
কেন কাজ করল না জোড়া দাওয়াই?
অর্থমন্ত্রীর ব্যাখ্যা, মন্দার জন্য দেশের উন্নয়নের গতি কমেছে। তারই প্রভাব পড়েছে এ রাজ্যের রোজগার বাড়ানোর ক্ষেত্রেও। কিন্তু এ রাজ্যের সঙ্গে তুলনীয় অন্য অনেক রাজ্যই এই সময়ে ২৩ শতাংশেরও বেশি আদায় বাড়িয়েছে। তাই শুধু মন্দার কারণেই যে কম আদায় হয়েছে, তা মনে করেন না অর্থ দফতরের কর্তারা। অর্থ দফতরের এক কর্তা বলেন, “মন্দা কম রোজগারের একটি কারণ হতে পারে। কিন্তু এটাই একমাত্র কারণ নয়।” আয় বাড়ানোর পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় খরচে কড়া হাতে লাগাম টানাও অর্থ বিভাগের কাজের মধ্যে পড়ে। টানাটানির সংসারে এই কাজটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত আয় বাড়লেও অপ্রয়োজনীয় খাতে খরচ যদি বাড়তে থাকে, তবে তা কার্যত বিফলেই যায়। যে কোনও সুগৃহিণীই তা বোঝেন। অমিত মিত্র তা বুঝেছেন কি?
বুঝে থাকলে অপ্রয়োজনীয় খরচ এ ভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে কেন? মেলা-মহোৎসব, ক্লাবকে সহায়তা, নানা পুরস্কার, ইমাম-ভাতা, রাস্তার মোড়ে মোড়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত, কোটি কোটি টাকা খরচ করে ত্রিফলা আলো জ্বালানো, সদ্য রঙ করা ভবনেও নতুন করে নীল-সাদা রঙ করা ইত্যাদি হরেক খাতে খরচ দেখে চোখ কপালে উঠছে অর্থ দফতরের কর্তাদের অনেকেরই। |
হ্রাস বৃদ্ধি |
২০১০-১১ |
২০১১-১২ |
২০১২-১৩ |
(বাজেট বরাদ্দ) |
তথ্য-সংস্কৃতি |
৭.৫ |
৪৮ |
১১০ |
|
১২৯% |
(২০১০-১১ সঙ্গে তুলনা করলে ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি ১৩৬৬ %) |
পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন |
২০৪৫ |
২৯৭১ |
২৭১৬ |
|
৮.৫% |
নারী, শিশু এ সমাজকল্যাণ |
|
৭১৫ |
১০৮১ |
১০১৫ |
|
৬% |
|
নগর উন্নয়ন |
৮৬৫ |
১৫৩০ |
১২৩৩ |
|
১৯% |
|
(সব তুলনা আগের অর্থবষের্র সঙ্গে। অঙ্ক কোটি টাকায়)
সূত্র: পশ্চিমবঙ্গ বাজেট ২০১২-১৩ |
|
|
তাঁদের বক্তব্য, যে সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, সেখানে কোন খরচকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, সেটাই সবচেয়ে জরুরি বিষয়। কিন্তু এখানেও মানসিকতার সমস্যা রয়েছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, জনকল্যাণের বিভিন্ন খাতের তুলনায় সংস্কৃতিখাতে বাজেট বরাদ্দ প্রচুর বাড়ানো হয়েছে। যেমন, ২০১০-১১ সালের তুলনায় ২০১২-১৩ সালে তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে প্রায় ১৫ গুণ! অথচ এরই পাশাপাশি তুলনামূলক ভাবে পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন এবং নারী, শিশু এবং সমাজ কল্যাণ খাতে চলতি বছরের বাজেট বরাদ্দ গত আর্থিক বছরের (২০১১-১২) তুলনায় কমে গিয়েছে যথাক্রমে সাড়ে ৮ এবং ৬ শতাংশ হারে। একই ভাবে নগরোন্নয়ন খাতে খরচ কমানো হয়েছে ১৯ শতাংশ।
এই চিত্রের পাশাপাশি রয়েছে বিপুল ভর্তুকির প্রবণতাও। পরিবহণ-সহ নানা ক্ষেত্রে পরিষেবার মূল্য বাড়তে না দেওয়ায় কোষাগারের উপরে বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে হেঁশেল সামলাতে সেই ধার করে ঘি খাওয়ার উপরেই ভরসা করছে রাজ্য। ধার করে ঘি খাওয়া অবশ্য অশাস্ত্রীয় নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেই ঘি কি শুধুই ঋণের বোঝা বাড়াবে, না রাজ্যের আর্থিক স্বাস্থ্যেরও প্রকৃত উপকারে আসবে? হালফিলের খরচের নমুনা তো সে কথা বলছে না। বরং দেদার ঋণ করে ‘ঘি’ খাওয়ার এই প্রবণতা ডেকে আনছে বিপত্তি। তাই গত এক বছরে এ রাজ্যের ধারের অঙ্ক কার্যত ‘রেকর্ড’ তৈরি করেছে।
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০-১১ আর্থিক বছরে রাজ্য বাজার থেকে মোট ধার নিয়েছিল ৯,৫০০ কোটি টাকা (ধারের তালিকায় থাকা রাজ্যগুলির মধ্যে ষষ্ঠ)। কিন্তু ২০১১-১২ আর্থিক বছরের প্রথম দশ মাসেই বাজার থেকে ১৭,২৫০ কোটি টাকা ধার করে ফেলেছে (তালিকায় দেশের মধ্যে প্রথম)।
এ কথা সবাই মানছেন, কোষাগারের হাল ফেরাতে রাজ্যে বড় শিল্প দরকার। শুধু কৃষির উপরে ভরসা করে কোষাগারের হাল ফেরানো সম্ভব নয়। কিন্তু গত এক বছরে রাজ্যে নতুন শিল্প তো হয়নি বললেই চলে। তাই আয় বাড়ানোর পথ কী হতে পারে?
অর্থ দফতরের কর্তাদের বক্তব্য, আপাতত মদ-নীতির সামান্য পরিবর্তন করলেই কোষাগারে ফি বছর বাড়তি ১০ হাজার কোটি টাকা আসতে পারে। আর তাতেই বাজার থেকে করা ধারের পরিমাণও অর্ধেক হয়ে যাবে। কী ভাবে?
পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে তুলনীয় রাজ্যগুলি (অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরল ইত্যাদি) শুধু আবগারি খাতেই বছরে ১২ হাজার কোটি টাকার মতো রোজগার করছে। অথচ এই খাতে এ রাজ্যের আয় ২২০০ কোটির মতো। তা হলে কি এ রাজ্যের লোকেরা কম মদ খাচ্ছেন?
আবগারি দফতরের অফিসারেরা জানিয়েছেন, এ রাজ্যের বিপুল সংখ্যক নিম্নবিত্ত মানুষের নাগালের মধ্যে দেশি মদের সরকার অনুমোদিত দোকান নেই। তাই তাঁরা বেআইনি চোলাই মদ খেতে বাধ্য হন। এতে এক দিকে যেমন সরকারের বিপুল রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে, তেমনই বিষমদ খেয়ে মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে মানুষেরও। মাঝে মধ্যে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। মগরাহাটের বিষমদ-কাণ্ড তার একটি বড় উদাহরণ। বোঝার উপরে শাকের আঁটির মতো সরকার সেই মৃত্যুর জন্য কোটি টাকার ক্ষতিপূরণও ঘোষণা করে ফেলেছে।
অথচ আবগারি দফতর ও পুলিশ দিয়ে যে চোলাই কারবার স্থায়ী ভাবে বন্ধ করা যাবে না, তা জানেন অর্থ দফতরের কর্তারাও। অন্য রাজ্যের মতো ‘ভারসাম্য’ রেখে দেশি মদের দোকানের সংখ্যা বৃদ্ধি করলে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান হতে পারে বলেই মনে করেন তাঁরা। আর এ থেকেই কোষাগারে আসতে পারে বিপুল পরিমাণ অর্থ।
কিন্তু জনমোহিনী রাজনীতি টেনে ধরেছে অর্থনীতিকে। সমালোচনার ভয়ে সেই পথ থেকে বার বার সরে এসেছেন রাজ্যের নীতি-নির্ধারকেরা। তাই সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিজেদের রোজগার বাড়ানোর চেষ্টা করছে না রাজ্য।
তা হলে ভিখারি ভোলানাথের এই সংসার চালানোর জন্য অন্নপূর্ণার হাতে কী রইল?
হাতে রইল ঋণ! আর বিশেষ সাহায্যের জন্য ছোটাছুটি! |