জট যেখানে |
• শিল্প সংস্থার জন্য জমি অধিগ্রহণ নয়
• খসড়া অধিগ্রহণ-পুনর্বাসন বিল সেই তিমিরে
• জমি ব্যাঙ্কের ‘ব্যবহারযোগ্য’ জমি শিল্পের কাজে লাগেনি
• আইন সংশোধন করেও সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকল
• জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন বহাল, তবে পরিধি বাড়ল
• বন্ধ-রুগ্ণ কারখানার জমি অধরা |
|
প্রশ্ন উঠেছে, এতে শিল্পের জন্য জমি সমস্যার সমাধান হল কোথায়? আগের বাম সরকার কয়েকটি শিল্পক্ষেত্রকে ঊর্ধ্বসীমা ছাড়ের সুযোগ দিয়েও নিজেদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল। নতুন সরকার সেই পরিধিটাকে বাড়ালেও নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতেই রেখেছে। প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য, এক দিকে ‘ছাড়’ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। অন্য দিকে আবার ‘কেস টু কেস’ বিবেচনা করার কথাও বলছে সরকার! এর মধ্যে স্ববিরোধিতা রয়েছে। সংকীর্ণতায় আটকে পড়েছে সরকার।
শিল্পমহলেরও বক্তব্য, এতে লাভ কিছু হল না। তাদের মতে, এখনও সরকারের মর্জির উপরেই জমি-ছাড়ের বিষয়টি নির্ভর করছে, যেখানে বিনিয়োগকারীদের কোনও স্বাধীনতা থাকবে না। অথচ শিল্পের স্বার্থে ওই ধারা একেবারেই তুলে দেওয়া উচিত ছিল। যেমন তুলে দেওয়া উচিত ‘টাউন অ্যান্ড কান্ট্রি প্ল্যানিং’ আইন। তা না করে শুধু আইন সংশোধন করায় জমির সমস্যার কোনও পথ খুলবে না।
সংশোধন আরও হয়েছে। এ বার জমির মালিকদের ‘লিজ’ দেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়েছে। সংশোধিত আইনে সিলিংয়ের বেশি জমি রাখার ছাড়পত্র পাওয়া কোনও জমি-মালিক অথবা সাধারণ ভাবে কোনও ব্যক্তি বা সংস্থাও তাদের হাতে থাকা জমি ‘লিজ’ দিতে পারবে চারটি শিল্পক্ষেত্রের জন্য। এই শিল্পগুলি হল শিল্প পার্ক/হাব/এস্টেট, অর্থ তালুক, জৈবপ্রযুক্তি পার্ক এবং ফুড পার্ক। আরও বলা হয়েছে, ছাড়ের সুবিধা পাওয়া জমিতে তিন বছরের মধ্যে প্রকল্প না হলে ওই ছাড়পত্র ফিরিয়ে নেবে সরকার। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রকল্প রিপোর্ট পরীক্ষা করে সরকার অনুমতি দিলে তবেই জমি ‘লিজ’ দেওয়ার প্রশ্ন আসবে। এই সংশোধনেও ফের সেই সরকারের ‘দাদাগিরি’-র ছাপ স্পষ্ট।
বাম আমলের শেষের দিকে জমি-সমস্যার বাস্তবতা বুঝে সমাধানের পথ খুঁজতে উদ্যোগী হয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তাঁর সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি সরকারের ব্যর্থতা ও বিরোধীদের জমি-আন্দোলনের জন্য। একই বাস্তবতা মমতাও বুঝেছেন। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে কার্যত সেই একই পথে ঘুরপাক খাচ্ছেন তিনি। যেখানে লালবাড়ির ঠিক করে দেওয়া প্রেসক্রিপশনের বাইরে জমি পাওয়া যাবে না। জমি ব্যবহারও করা যাবে না। জমির মালিকদের কোনও স্বাধীনতা থাকছে না।
সরকারের শুরুতেই ঘোষণা ছিল, কৃষির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যকে ‘বিনিয়োগের গন্তব্যস্থল’ করা হবে। ২০ মে শপথ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, শিল্পের জন্য জমির সমস্যা মেটাতে ‘জমি-ব্যাঙ্ক’ তৈরি হবে। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিশ্রুতি ছিল, বন্ধ ও রুগ্ণ এবং শিল্পবিকাশ কেন্দ্রের পরিত্যক্ত জমিও শিল্পের কাজে লাগানো হবে।
এক বছর পর কী দেখা যাচ্ছে?
জেলা ও দফতরগুলিতে বছরভর সমীক্ষা চালিয়ে রাজ্য সরকার দেখেছে, প্রায় ২ লক্ষ ৮০ হাজার একর ফাঁকা জমি রয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে ‘ব্যবহারযোগ্য’ জমির পরিমাণ মাত্র ৬০ হাজার একর! এই জমি বড় ও মাঝারি শিল্পের কাজে লাগবে বলে মনে করে না প্রশাসনের একটা বড় অংশই।
রাজ্যের সরকারি-বেসরকারি বন্ধ ও রুগ্ণ কারখানার হাতে কত জমি আছে, তা জানতে বিগত সরকার নমুনা হিসেবে ৫০০টি বড় ও মাঝারি সংস্থায় সমীক্ষা চালিয়েছিল। ২০০৪ সালে পেশ করা সেই সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, ওই জমির পরিমাণ ৪১ হাজার একরের কিছু বেশি। নতুন সরকার নতুন সমীক্ষা শুরু করেছে। সরকারের ধারণা, এই সমীক্ষার তথ্য হাতে এলে শিল্পের জন্য জমি মিলবে। কিন্তু যাবতীয় ‘জটিলতা ও দায়’ মিটিয়ে বাস্তবে ওই জমি পাওয়া কতটা সম্ভব, তা নিয়ে প্রবল সংশয়ে শিল্পমহল। শিল্পের জন্য সরকার গঠিত ‘কোর’ কমিটির বৈঠকে বাণিজ্যিক সংস্থার প্রতিনিধিদের কাছে পরিত্যক্ত জমি ফেরত দেওয়ার জন্য শিল্পমন্ত্রী বারবার আবেদন জানিয়েছেন। কিন্তু তাতে এখনও সাড়া মেলেনি!
ক্ষমতায় এসে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছিলেন, বেসরকারি বিনিয়োগ, এমনকী, যৌথ উদ্যোগের প্রকল্পের জন্যও জমি অধিগ্রহণ করবেন না। সেই সিদ্ধান্ত মতো জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন বিলের খসড়া তৈরি হলেও তা এখনও বিধানসভায় পেশ করা হয়নি। এই বিল আইনে পরিণত হলেও জমি সমস্যার যে কোনও সমাধান হবে না, তা বলাই বাহুল্য। প্রশাসনের একাংশ অবশ্য যৌথ উদ্যোগের প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের পক্ষে সওয়াল করতে শুরু করেছে। তাতে মুখ্যমন্ত্রী সাড়া দিয়েছেন, এমন কোনও খবর নেই।
বিনিয়োগ টানতে রাজ্যে ১৭টি শিল্প পার্ক করার কথা ঘোষণা করেছে সরকার। কিন্তু প্রস্তাবিত শিল্প পার্কের বেশির ভাগ বাম আমলেই তৈরি হয়েছে। যেমন, রঘুনাথপুর (৩২২৫ একর), খড়্গপুর (১১৬৩ একর), গোদাপিয়াশাল (১৫৪ একর), শালবনি (৪৩২০ একর), নৈহাটি (৯৭ একর)-সহ কয়েকটি। এই পার্কগুলি তৈরি করার জন্য আগের সরকার জমি অধিগ্রহণ করেছিল। এখনকার সরকার জমি অধিগ্রহণ না করেই কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, বীরভূমের মতো জেলায় শিল্প পার্ক তৈরি করতে চায়। রাজ্যের সিদ্ধান্ত, সরকারের হাতে থাকা ‘খাস’ জমি ব্যবহার করেই এই নতুন শিল্প পার্ক গড়া হবে। কিন্তু পার্কের জন্য একলপ্তে কত ‘খাস’ জমি পাওয়া যাবে, তা নিয়েই সংশয় রয়েছে। ফলে শিল্প কোথায় হবে, সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের কোনও উত্তরও এখনও সরকারের কাছে নেই।
সব মিলিয়ে তাই জমির সমস্যাতেই আটকে রয়েছে
রাজ্যের শিল্প-ভবিষ্যৎ। এমনকী, শিল্পের অভাবে রাজ্যে বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত হওয়ারও প্রবল সম্ভাবনা। অথচ এটাই এখনও পর্যন্ত রাজ্যের বিনিয়োগ-মানচিত্রের ললাটলিখন। যে কারণে তৈরি হচ্ছে না কর্মসংস্থানও। |