‘অনিলায়তনে’ ঘা মেরে শুরু
সুনামি না-ই বা হোক, ভূমিকম্প তো বটেই! আর তাতেই ফাটল ধরেছে ‘অনিলায়তন’-এ।
এত দিন ধরে তিলতিল করে গড়ে উঠেছিল সেই ইমারত। অভিযোগ ছিল, তার প্রতিটি ইট গাঁথা হয়েছে দলতন্ত্রের ভিতের উপর। রাজ্যে ‘পরিবর্তনের’ সরকার এসে প্রথমেই ঘা দিয়েছে তাতে।
এবং বলতেই হবে, সেই আঘাত নেহাৎ বিফলে যায়নি। রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে রাজনীতির কবলমুক্ত করতে নতুন আইন প্রণয়ন এবং প্রেসিডেন্সির পুরনো ‘গৌরব’ ফিরিয়ে দিতে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাবিদদের নিয়ে মেন্টর গ্রুপ গঠন থেকেই তা স্পষ্ট।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক বছরের রাজ্য-পরিচালনা খতিয়ে দেখলে এটাই তাঁর প্রথম (হয়তো সব চেয়ে উল্লেখযোগ্য) ‘সাফল্য’। এমনকী, এক বছর পেরোনোর আগেই তিনি আইন করে কলেজগুলির পরিচালন-ব্যবস্থাকেও দলবাজির বাইরে বের করে আনার কথা ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরপর কয়েকটি অশান্তির ঘটনায় তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িয়ে পড়াকে তিনি যে ভাল চোখে দেখছেন না, সেটাও পরিষ্কার করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার প্রতিটি স্তরে দলীয় নিয়ন্ত্রণকে মজবুত রাখার পদ্ধতি কায়েম করে ফেলেছিল বিগত বামফ্রন্ট সরকার। শিক্ষা-প্রশাসনের প্রতিটি পদক্ষেপ, শিক্ষক থেকে উপাচার্য প্রতিটি নিয়োগ নিয়ন্ত্রিত হত আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের সিদ্ধান্তে। সেই ‘কৌশল’ শিখিয়েছিলেন প্রয়াত সিপিএম নেতা অনিল বিশ্বাস।
অমর্ত্য সেনের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা। ফাইল চিত্র
এই ভাবেই মাথা তুলেছিল ‘অনিলায়তন’। অনিলবাবুর ছায়া এতটাই দীর্ঘ ছিল যে, তাঁর প্রয়াণের পরে বহু চেষ্টা করে প্রেসিডেন্সিকে বিশ্ববিদ্যালয় করতে পারলেও তাকে আলিমুদ্দিনের ‘দখল’ থেকে দূরে রাখতে পারেননি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কথা তো দূরস্থান।
মমতার কাছে তাই এটা ছিল এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। ঘরে এবং বাইরে। বাইরে, মানে ভোটের আগে প্রকাশিত দলীয় ইস্তাহারে তৃণমূল জানিয়েছিল, তারা ক্ষমতায় এলে ‘নিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে’। কিন্তু নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী হাতেকলমে সেই কাজে নেমে মুখ্যমন্ত্রী অনুভব করলেন, শিক্ষা-পরিচালন ব্যবস্থাকে রাজনীতিকদের ‘খপ্পর’ থেকে বের করে আনা খুব সহজ নয়। মহাকরণের অন্দরে এটা অনেকেই জানেন, এতদিনকার চালু বিধি সংশোধন করে মমতা যখন তাঁর শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জন্য নতুন অর্ডিন্যান্স তৈরি করালেন এবং জানালেন, কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন-কমিটিতে (সেনেট, সিন্ডিকেট, কোর্ট ইত্যাদি) বিধায়ক-সাংসদ-ছাত্র ইউনিয়ন-কর্মী ইউনিয়নের প্রতিনিধিত্ব থাকবে না, তখন তাঁর নিজের ঘরেও গুঞ্জন উঠেছিল। কেউ কেউ এমনও বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে, এর ফলে ভবিষ্যতে শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অর্থাৎ শিক্ষক ও ছাত্র সমাজে দলের ‘অস্তিত্ব বিপন্ন’ হতে পারে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা তাতে টলেন নি। বরং সিদ্ধান্তে দৃঢ় থেকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ‘অনিলায়তন’ ভেঙে এগোতে তিনি বদ্ধপরিকর। সেই অর্ডিন্যান্স ইতিমধ্যেই পরিষদীয় ধাপ পেরিয়ে আইনে পরিণত হয়েছে। যার ফলে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সর্বোচ্চ পরিচালন কমিটিগুলিতে রাজনীতিক-জনপ্রতিনিধিদের কোনও স্থান নেই। প্রাধান্য পেয়েছেন তাঁরাই, যাঁরা শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে যুক্ত। উপাচার্য নিয়োগের জন্য সার্চ কমিটি তৈরি এই আইনের আর একটি বড় দিক। কোনও উপাচার্য পদে বসে ‘রাজনীতি’ বা অন্য কোনও ‘অনৈতিক’ আচরণ করলে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার সংস্থানও আছে। এর আগে উপাচার্যদের চার বছরের কার্যকাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের কোনও অবস্থাতেই পদ থেকে সরানো যেত না।
এ কথা ঠিক যে, উপাচার্য নিয়োগের জন্য সার্চ কমিটি গড়ার সিদ্ধান্ত হলেও এখনও পর্যন্ত তার কাজ সে ভাবে চালু হয়নি। কলকাতা এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে কেবল সংশ্লিষ্ট সার্চ কমিটিগুলি কাজ শুরু করেছে। রিপোর্ট জমা পড়েনি। ফলে এই মুহূর্তে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই উপাচার্যেরা অস্থায়ী ভাবে কাজ চালাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে সরকারের আরও একটু তৎপরতা প্রয়োজন ছিল বললে তা ভুল হবে না। শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্যবাবু অবশ্য বলেন, “সার্চ কমিটি তৈরি করার কাজ সরকারের নয়। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলি স্বশাসিত। তাই সেখানে পরিচালন-কাউন্সিলগুলি তৈরি না হলে সবই আটকে যাবে। বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও ডিন নির্বাচনই হয়নি। যার জন্য হয়নি কাউন্সিল গঠন। সেই সব মিলিয়ে এই দেরি।” কিন্তু এটাও বলা দরকার, কোনও নতুন পদ্ধতি চালুর সূচনায় কিছু বিলম্ব হলেও যে লক্ষ্য সামনে রেখে এই উদ্যোগ, তার ইতিবাচক দিক অস্বীকার করার নয়।
প্রেসিডেন্সির মেন্টর গ্রুপ গঠনের ক্ষেত্রেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের সদর্থক ভাবনার পরিচয় মেলে। এই মেন্টর গ্রুপের সঙ্গে উপদেষ্টা হিসেবে মমতা যুক্ত করতে পেরেছেন অমর্ত্য সেনের মতো ব্যক্তিকে। গ্রুপের মাথায় হার্ভার্ডের অধ্যাপক সুগত বসু। আছেন এমআইটি-র অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের হিমাদ্রি পাকড়াশি, হরিশচন্দ্র রিসার্চ ইন্সটিটিউটের অশোক সেন প্রমুখ যশস্বী শিক্ষাবিদ। মেধার উৎকর্ষ কেন্দ্র হিসেবে প্রেসিডেন্সি যাতে তার হৃত গৌরব ফিরে পায়, কাজ শুরু হয়েছে তার জন্য। বাকিটা সময়ের অপেক্ষা।
তবু বলতেই হবে, এই আশার আলো কিছুটা ম্লান করে দেয় বিভিন্ন স্কুল-কলেজে ধারাবাহিক রাজনৈতিক দাপাদাপি, যার কেন্দ্রে শাসক তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। আশঙ্কা বাড়ে, যখন দেখা যায় রায়গঞ্জের কলেজে স্থানীয় তৃণমূল নেতা ও তাঁর দলবলের আস্ফালনকে মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং ‘ছোট ছোট ছেলেদের কাজ’ বলে লঘু করতে চান। ভাঙড় কলেজে আর এক তৃণমূল নেতার (ঘটনাচক্রে তিনি ওই কলেজ পরিচালন কমিটির সভাপতি) ‘ঔদ্ধত্য’কে কার্যত প্রশ্রয় জুগিয়ে সেই কলেজের এক শিক্ষিকার ব্যক্তিগত কোনও বিষয়কে ‘সরকারি আক্রমণের’ নিশানা করা হয়।
যদিও শেষ পর্যন্ত কোথাও একটা রূপোলি রেখা দৃষ্টি এড়ায় না। তাই এত কিছুর পরেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা যখন মহাকরণে নিজের দলের ‘উদ্ধত’ নেতা-কর্মীদের ডেকে পাঠিয়ে কড়া ধমক দেন, দলের সভায় দাঁড়িয়ে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, স্কুল-কলেজে কোনও রকম বিশৃঙ্খল আচরণ আর তিনি বরদাস্ত করবেন না, কলেজগুলির পরিচালন কমিটিতেও দলবাজি বন্ধ করার জন্য আইন বদলের কথা ভাবতে শুরু করেন তখন মনে হয়, সব কিছু পেয়ে যাওয়ার পক্ষে শুধু একটি বছর হয়তো যথেষ্ট দীঘর্র্ সময় নয়। অপেক্ষার সুযোগ এখনও আছে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.