প্রবন্ধ...
ওস্তাদ থামতে জানে?
মাফ করবেন। আমায় মাফ করবেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। সেই কবে থেকে আপনার ভক্ত! মাখনের মতো কভার-ড্রাইভের কথা ছেড়ে দিন। বরাবরের ভক্ত আপনার ফিরে-আসার। আমি পারি না। আমরা পারি না। আপনি পারেন! আপনি পারেন। অমিতাভ বচ্চন পারেন। প্রসেনজিৎ পারেন। মুছে দিলেও ফুটে উঠতে পারেন। যাবতীয় চক্রান্ত নস্যাৎ করে ফিরে আসতে পারেন। লড়তে পারেন। লড়ে জিততে পারেন। আমি-আমরা, যারা বড্ড সাধারণ, দিন-আনি দিন-খাই, কোনও অন্যায়ের জুতসই জবাব দিতে পারি না, সিস্টেমের সঙ্গে অহরহ আপস করি, সভয়ে সবলের দিকে তাকাই বা তাকাতেও পারি না অনেক নিচু থেকে, আপনি ছিলেন তাদের ‘আইকন’। তাদের মনোবলের কারিগর।
অমিতাভ বচ্চন পারেন। বলিউডের একদা সুপার না মেগা, কী যেন স্টার। ঘাড়ে ১০০ কোটির দেনা (এ-ক-শো কো-টি! একের পর ক’টা শূন্য বসালে হয় যেন? আমাদের পকেটে তত টাকা থাকলেই মাথাটা খারাপ হওয়ার জোগাড় হবে। আর দেনা!)। বাংলো ক্রোক করে নিচ্ছে ব্যাঙ্ক। তারকার ইগোটাই তো মুখ থুবড়ে পড়বে। অমিতাভ সেখান থেকেও পারেন ঘুরে দাঁড়াতে। প্রসেনজিৎ পারেন। একের পর এক গেঁয়ো বাংলা সিনেমা। টালমাটাল ব্যক্তিগত জীবন। সেখান থেকে পারেন নিজের হাল নিজে ধরতে।
আর পারেন আপনি!
কত নিদ্রাহীন রাতে, কত অপমানজনক দিনে দাঁতে-দাঁত চেপে আপনার কথা ভেবেছি! ভেবেছি, আপনি পারলে আমি পারব না কেন! আচ্ছা, পারি বা না-পারি, অন্তত চেষ্টা তো করি! চাকা যে ঘোরে, আপনিই তো দেখিয়ে দিয়েছেন। দড়ির ভিতর ব্যাটে জবাব দিয়ে দড়ির বাইরে একের পর এক ম্যাচ জিতেছেন।
আর আমরা নিজেদের বলেছি তবে? কে বলে আন্ডারডগদের দিন শেষ? কে বলে অকুণ্ঠ সততা আর পরিশ্রম নিয়ে জীবনকে দেখলে জীবনও সমুদ্রের মতো তা ফিরিয়ে দিয়ে যায় না? আপনার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার সেই খটমট জায়গাটা, পোচেস্ট্রুম না কী যেন, অর্ধেক লোক নামটাও ঠিকঠাক উচ্চারণ করতে পারে না, স্রেফ ক্রিকেটীয় লোকগাথায় ঢুকে পড়ল! আপনার জন্য গ্রেগ চ্যাপেল, জন বুকানন, শাহরুখ খানরা আমাদের কাছে চিরকালীন ভিলেন হয়ে গেলেন!
আপনি আমাদের আধুনিক অভিমন্যু। চারদিক থেকে রথী-মহারথীরা ঘিরে ধরে মারতে চাইছে। কিন্তু চক্রব্যূহ কেটে আপনি ঠিক বেরিয়ে আসছেন। যা পুরাণের অভিমন্যু পারেননি।
আমাদের সমস্ত ফ্যান্টাসি অতিক্রম করে আপনি ছিলেন ল্যাতপেতে বঙ্গ-মানসিকতার সমাজ থেকে বেরিয়ে আসা জাতীয় বীর। যিনি নিজের আইন নিজেই তৈরি করেন। অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেন না। কোনও শর্ট-কাটে বিশ্বাস করেন না। যে জন্য আপনাকে পিষে মারার চেষ্টা হয়। কিন্তু আপনি দিনের শেষে জিতে মাথাটা উঁচু আর শিরদাঁড়াটা সোজা রাখেন।
টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে আপনি দেশের সেরা ক্যাপ্টেন। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে, পাকিস্তানে গিয়ে পাকিস্তানকে, লর্ডসে গিয়ে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে এসেছেন। আপনার সঙ্গে সঙ্গে ঘটেছিল ‘দাদা’ নামের এক অবিশ্বাস্য উত্তরণ। নেহাতই ছা-পোষা বাঙালি এক সম্বোধন উড়াল দিয়েছিল আন্তর্জাতিক আকাশে। ‘দাদাগিরি’ শব্দটা তার অসামাজিক বৃত্ত পেরিয়ে কৌলীন্য পেয়েছিল। আপনার মতো ক্রিকেটীয় আইকনের হাত ধরে হাঁটতে-হাঁটতে আমরাও কখন যেন ঢুকে পড়েছিলাম ক্রিকেট-জাদুঘরে। মোক্ষলাভ হয়েছিল।
এই আইপিএল-টা যখন খেলতে নামলেন, মনে একটা কু-ডাক দিয়েছিল ঠিক হচ্ছে তো? দিব্যি তো কমেন্ট্রি করছিলেন! সোজাসাপ্টা। কারও কাছে নাড়া বাঁধা নেই। সেই চিরাচরিত মস্তানি। আপনার অফ-ড্রাইভের মতো। মসৃণ। ফালাফালা করা। ভাল লাগছিল। খুব ভাল লাগছিল। মনে হচ্ছিল, ক্রিকেট সমৃদ্ধ হচ্ছে। আমাদের মতো ক্রিকেটামোদীরাও। সম্মান-মর্যাদা সব নিয়েই আপনার আত্মা ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল। একটা নিরাবেগ, ফ্যালো কড়ি মাখো তেলের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট আপনাকে সেই গরিমা থেকে কোথায় আছড়ে নিয়ে ফেলল! যেখানে আপনার ব্যাটিংয়ের চেয়ে বেশি আলোচনা হল আপনার চুলের ছাঁট নিয়ে! জীবনে কোনও দিন ব্যাট-বলে হাত না-ছোঁয়ানো মালিক ঠিক করে দিলেন আপনার ব্যাটিং-অর্ডার।
স্কুলপড়ুয়া আমি এক ক্রিকেটারের আকণ্ঠ ভক্ত ছিলাম। পড়ার ঘরে পোস্টার টাঙিয়ে রাখতাম। স্ক্র্যাপবুক বানাতাম তাঁর ছবি, তাঁর সম্পর্কে যাবতীয় লেখা কেটে কেটে। যৎসামান্য যা ক্রিকেট খেলেছি, তাঁকেই নকল করে। ১৯৮৫ সালে অস্ট্রেলিয়ায় বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপটা জিতে যখন অবহেলায় দেশের ক্যাপ্টেন্সিটা ছেড়ে দিলেন সুনীল গাওস্কর, ভিকট্রি স্ট্যান্ডের বক্তৃতাটা এখনও মনে পড়ে, “স্ট্যান্ডিং ইন দ্য টোয়াইলাইট অফ মাই কেরিয়ার, আই হ্যাভ ডিসাইডেড টু লিভ ইন্ডিয়ান ক্যাপ্টেন্সি।” রান করেছেন প্রচুর। অগুনতি রেকর্ড। কিন্তু কেরিয়ারের গোধূলিতে দাঁড়িয়ে তাঁর ওই মাস্টারস্ট্রোকটার জন্য এখনও আমার মতো তাঁর এলেবেলে ভক্ত কলার তুলে ঘোরে। গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ, কপিল দেবের ফ্যানদের এখনও বলতে পারি, “তোদের লোকটা বুড়ো হওয়ার পরেও খেলে যাচ্ছিল।
লোকে বলছিল, ব্যাটা যাচ্ছে না কেন এখনও! আমাদের লোকটা যখন গেল, লোকে বলল, কেন গেল এখন?” মনে হয়, ভক্ত হলে এঁরই হওয়া যায়। যাঁর নিজের সম্পর্কে, নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণাটা খুব স্বচ্ছ। খুব বাস্তব।
সেই নবতিপর গায়কের কথাও মনে হয়, যাঁর হয়ে হেমন্ত-ভক্তদের সঙ্গে এখনও লড়ে যাই। গানের পর গান তুলে তুলে বলি, “অমন ক্লাসিক্যাল বেস ছিল হেমন্তর? স্রেফ উত্তমের লিপে গেয়েছিলেন বলে পপুলারিটি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন!” মান্না দে এখনও গান গাইতে বসেন। চড়ায় গলা ওঠে না। আতঙ্ক হয়। মনে হয়, স্মৃতির উপর অহেতুক অত্যাচার করছি। দুঃখে চ্যানেল বদলে ফেলি।
যেমন এখন পুণের খেলা থাকলে আতঙ্ক হয়।
কে জানে, হয়তো এর পরেও আবার আপনার অবিশ্বাস্য কোনও কাম-ব্যাক হবে (না-হলেও আপনার কিছু যায়-আসে না। ইতিহাসে আপনি ঢুকেই পড়েছেন)। কিন্তু লোকমুখে শোনা একটা ঘটনার কথা খুব মনে হয়। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ছেলে দিলীপকুমার রায় রবীন্দ্রনাথকে এক কালোয়াতি ওস্তাদের গান শোনাতে চেয়েছিলেন। অনেক প্রশংসা করেছিলেন সেই ওস্তাদের। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “ও দিলীপ, তোমার ওস্তাদ গায় তো ভাল, থামতে জানে তো?”
মাফ করবেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। আপনি আমার, আমাদের ওস্তাদ।
আপনার লড়াই থেকে জীবন শুষে-নেওয়া আমরা সাধারণস্য সাধারণ। আমাদের সেই তুচ্ছ কানে অহরহ বাজছে, “তোমাদের ওস্তাদ যে থামতে জানে না!”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.