|
|
|
|
|
|
রবিবাসরীয় গল্প |
পালানোর নেশা |
সঙ্গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
শিয়ালদা স্টেশনে নেমে মডার্ন প্রিন্টিংয়ের অফিসে পৌঁছতে শান্তনুকে প্রায় মিনিট কুড়ি হাঁটতে হয়। ক্রিক রো দিয়ে ঢুকে গলির তস্য গলি পার হয়ে সরু একটা গলির কর্নারের তিন তলা, পোড়ো, ইট বের করা, শ্যাওলা ধরা বাড়িটাই মডার্ন প্রিন্টিংয়ের অফিস-কাম-কারখানা। একতলাটা ব্যবহৃত হয় ডিটিপি, হিসেব-নিকেশ, অর্ডার নেওয়া, মাল ডেলিভারি দেওয়া এ সব কাজে। বাড়ির পিছনের চাতালটা অ্যাসবেসটসের ছাউনি নিয়ে ঘিরে, গ্রিল টিল লাগিয়ে কারখানাটাকে দাঁড় করানো হয়েছে। মডার্ন প্রিন্টিংয়ের এখন প্রায় উঠে যায় যায় দশা। শান্তনু রোজই অফিসে আসার পথে ভাবতে ভাবতে আসে গিয়ে হয়তো দেখবে বাস্তবিকই অফিসের দরজায় তালা ঝুলে গিয়েছে। মালিক গুরুদাসবাবুর বয়স কম করে পঁচাত্তর হবে। গুরুদাসবাবুর ছেলে সরকারি চাকরি পেয়েছে, রাইটার্সে। তার এই মান্ধাতার ছাপাখানা নিয়ে বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। তার ওপর এই বাড়ির মালকিন শ্রীমতী বনলতা দেবী গুরুদাসবাবুকে রোজই উকিলের চিঠি পাঠাচ্ছেন বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার জন্য। জমির হিসেবে অনেকটা জমি, তাই প্রোমোটার বাড়িটা নিয়ে নিতে উঠে পড়ে লেগেছে। এখন যদি গুরুদাসবাবু বাড়িটা মানে মানে ছেড়ে দেন, তা হলে বরঞ্চ তাঁর কিছু লাভ হলেও হতে পারে। জগমোহন প্রোমোটার তাঁকে সেই রকম আশ্বাসই দিয়েছে। অতীতেও যে ছাপাখানাটার বিরাট কিছু রমরমা কারবার ছিল না, সে খবর শান্তনু রাখে। এখানে ওখানে একটা চাকরির কথা শান্তনু বলে রেখেছে কবে থেকেই। অন্যত্র কিছু ব্যবস্থা হলেই সে কেটে পড়বার তালে আছে। মাত্র হাজার পাঁচেক টাকা মাইনে, তাও গুরুদাসবাবু এমন এলোমেলো করে মাইনে দেন যে বলার নয়। গত মাসের শেষে আড়াই হাজার দিয়ে বললেন বাকি আড়াই এ মাসের শুরুতে একসঙ্গে দিয়ে দেবেন। এ মাসের শেষে এসে দিলেন আড়াই। তার মানে এ মাসের গোটা মাইনেটাই বাকি রয়ে গেল। এ ভাবেই চলছে গত ছ’মাস। তেইশ বছর বয়স হল শান্তনুর।
তার দু’বছরের ছোট ভাই কিছু পড়াশোনা না শিখেও তার থেকে বেশি রোজগার করছে চামড়ার কারখানায় কাজ করে। ডেলি আড়াইশো টাকা। তার ওপর নাইট শিফ্ট করলে এক্সট্রা। শান্তনুর মনটা ভাই প্রতাপের তুলনায় অনেক বড়। যা টাকাই সে পায়, মায়ের হাতে তুলে দেয়। প্রতাপ আবার টাকাপয়সার ব্যাপারে খুব চালাক। তা ছাড়া প্রতাপের জামাকাপড়ের খুব শখ আছে। একটা মেয়ের সঙ্গে প্রতাপের প্রেমও আছে। রাতে সে ভাইকে ফোনে প্রেমালাপ করতে শোনে। পারলে বিয়েই করে নেয়। মা অবশ্য বলেছে আগে শান্তনু বিয়ে করবে তার পর প্রতাপ। রোজগারটা একটু বাড়লে, একটা ভাল চাকরি পেলেই শান্তনু বিয়ে করতে পারে। তাদের গ্রামের দিকে বাইশ-তেইশের ছেলেরা সব বিয়ে করে বসে আছে। বিয়ে শান্তনু করতে চায় অন্য কারণে। বাড়ি বাড়ি রান্নার কাজ করে মা একা হাতে তাদের দুই ভাইকে মানুষ করেছে। বাবা অন্য মেয়েমানুষ নিয়ে ঘর বেঁধেছে বহু বছর আগে। দুই ভাইকেই মা লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করেছিল। শান্তনু এইচ এস-টা কোনও মতে দিল। প্রতাপ ক্লাস এইটের পর আর পড়তেই চাইল না। ছোটবেলায় মা কামারপাড়ায় যে বাড়িতে রান্না করত, সেই বাড়ির দাদু শান্তনুর হাত দেখে বলেছিল, শান্তনু পড়াশোনার লাইনেই যাবে। তা শান্তনু তো মুটেমজুর হয়নি, পড়াশোনার লাইনেই আছে। পুরনো কম্পিউটারে বসে ভাল ভাল বাংলা শব্দ, ইংরেজি শব্দ টাইপ করতে করতে
শান্তনু নিজেকে এই বলেই সান্ত্বনা দেয়। ইদানীং মায়ের শরীরটা একদম ভেঙে গিয়েছে। ভোরবেলা উঠে রান্নাবান্না করে ট্রেন ধরে কলকাতায় কাজে আসতে মায়ের ভীষণ কষ্ট হয়। একটা বউ থাকলে বাড়ির কাজকর্ম মাকে আর কিছু করতে হত না। বউই সব করত।
আজও ভোরবেলা উঠোন ঝাঁট দিতে দিতে মা তাকে বউয়ের কথাই বলছিল। বলছিল, ‘প্রতাপ তোর থেকে অনেক সেয়ানা শান্তনু। ও কেমন গুছিয়ে চলছে তুই ভেবে দেখ!’ ‘কী রকম?’ জানতে চাইল শান্তনু। কেরোসিন স্টোভ জ্বেলে ভোরের চা-টা সে নিজেই করেছিল মা আর তার জন্য। অনেক রাত অবধি টুনির সঙ্গে গল্প করে প্রতাপ এখন গভীর নিদ্রামগ্ন।
টিউবওয়েল পাম্প করতে করতে মা বলল, ‘প্রতাপ এখন টুনিকে নিজের পয়সায় পড়াচ্ছে। মাধ্যমিক পাশ করাবে, বারো ক্লাস পাশ করাবে, বিয়ে করে বউকে চাকরি করাবে।’ সে বলল, ‘এ তো অতি উত্তম সংকল্প!’ |
|
‘উত্তম’ বা ‘সংকল্প’ দুটোই মা বুঝল কিনা কে জানে। মা বলল, ‘তবে আর বলছি কী! প্রতাপ বলেছে এর মধ্যে যদি টুনির বাড়ি থেকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, তা হলে ও আগেই বিয়ে করে নিয়ে আসবে টুনিকে।’ ‘আনলে আনবে।’ শান্তনু বলল। ‘আমি বলেছি, বিয়ে করবি, ঘর কোথায়? একটা ঘর আমার, একটা ঘর তোর বড় ভাইয়ের। তুই বিয়ে করলে সে কি বারান্দায় থাকবে? তাই প্রতাপ ঠিক করেছে এখনই আর একটা ঘর তুলবে পশ্চিম দিকে। প্রতাপ কেমন আঁটঘাট বেঁধে চলছে দেখ শান্তনু, তুই-ই কেমন বোকাটা রয়ে গেলি।’
লোহার বালতিতে চাদর ভেজাতে ভেজাতে মা বলতে লাগল, ‘ভালই হবে, ইস্কুলে-পড়া বউ আনবে প্রতাপ, সে আমার হাতে হাতে কোন কাজ করে কোন উপকারটা করবে, না উল্টে আমাকেই তাকে রেঁধেবেড়ে খাওয়াতে হবে? তোর যে একটা বিয়ে দেব, তা এমন চাকরি জুটিয়েছ মাইনেই দেয় না! এ মাসের মাইনেটা চেয়েছিলি শান্তনু?’
মায়ের এ সব কথা ভাবতে ভাবতেই শান্তনু ক্রিক রো পার হয়ে গলির তস্য গলিঘুঁজিতে ঢুকে পড়ল। তার পর একটা যথারীতি ভাঙাচোরা দোতলা বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে যেতে গতি রোজকার মতো শ্লথ হয়ে এল তার। সে নিজের দুটো চোখ সম্পূর্ণ খুলে, বড় বড় করে তাকাল দোতলার ঘরের শিক ভাঙা জানলার দিকে। জানলায় সেই মুহূর্তে কেউ ছিল না, কিন্তু সে তাকাতেই মেয়েটা ঝট করে এসে দাঁড়াল জানলা জুড়ে, সাদা সরু সরু আঙুলের হাতটা রাখল কাঠের পাটাতনের ওপর। মেয়েটা ঝুঁকে পড়ল এমন, যেন দোতলা থেকে লাফ মারবে। কে জানে কোনও গোপন স্থান থেকে মেয়েটা লক্ষ করে তার গলিতে ঢোকাটা। প্রতিদিন প্রতিদিন শান্তনু চোখ তুলে তাকাল মাত্র মেয়েটা দৃশ্যমান হয়। এই এক বার যাওয়ার পথে, এই এক বার ফেরার পথে আর মাঝে কোন কারণে অফিস থেকে বেরিয়ে এসে এই গলির এই বাড়ির জানলায় চোখ রাখা মাত্র মেয়েটা এসে হাজির হয়। গত দু’মাস নাকি তিন মাস এই অদ্ভুত খেলাটুকুয় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে শান্তনু। আজকাল সে ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝে মেয়েটাকে স্বপ্নেও দেখে। স্বপ্ন দেখলে সে উঠে পড়ে মায়ের কাজের বাড়ি থেকে চেয়ে আনা এবং ট্রেনে বয়ে আনতে গিয়ে সামান্য চিড় খেয়ে যাওয়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের মুখের দিকে তাকায়। তার মুখটা কেমন যেন একটা! না লম্বা, না গোল! গালগুলো উঁচু উঁচু, চোখ ছোট ছোট, গালে ব্রন! আর তার থেকেও বড় কথা, তাকে দেখলেই বোঝা যায় সে গরিব বাড়ির ছেলে। গ্রামের ছেলে। এখনও সে চুলে তেল মাখে ও জামাকাপড় পরার কায়দা জানে না। প্রতাপ যে এত চেন লাগানো চকমকে জামা গায়ে দেয়, ওকেও দেখলে বোঝা যায় রগরগে লেবার ক্লাস! বোঝা যায়, তবু মেয়েটা তার জন্য রোজ এসে দাঁড়ায় কেন? অপেক্ষা করে কেন? এ রকম একটা শহরের ফর্সা মেয়ে? কাঁধ অবধি চুল।
মেয়েটার বয়স আন্দাজ আঠারো-উনিশ হবে। স্কুলে বা কলেজে পড়ার কথা। কিন্তু স্কুল-কলেজের টাইমে মেয়েটা তো বাড়িতেই থাকে! শান্তনুর মনে এ সব প্রশ্ন ওঠে। সে জানে উত্তর পাবে না, কিন্তু মেয়েটাকে দেখাটা তার কাছে নেশার মতো হয়ে গিয়েছে। শীর্ণ লম্বা মুখ, বড় বড় চোখ। শান্তনু ঠিক করেছে চাকরি ছেড়ে দিলেও মাঝে মাঝে এসে মেয়েটাকে দেখে যাবে।
আজ জানলার নীচে পৌঁছতেই একটা অপ্রত্যাশিত ব্যাপার ঘটল। একটা ছেঁড়া পাতা মেয়েটার হাত থেকে ভেসে ভেসে নীচে নেমে আসতে লাগল। শান্তনু ধরে নিল পাতাটা।
সাদা পাতার এক কোণে লেখা, ‘গির্জার সামনে, সাড়ে তিনটের সময়।’
ছেঁড়া পাতাটা হাতে নিয়ে শান্তনু বিমূঢ়ের মতো তাকাল জানলার দিকে। তখনই মেয়েটাকে কেউ বোধ হয় ডাকল বাড়ির ভেতর থেকে, ‘যাই’ বলে সরে গেল মেয়েটা। শান্তনু ছেঁড়া পাতাটা পকেটে ভরল যত্ন করে। মডার্ন প্রিন্টিংয়ের কম্পিউটারের সামনে বসে সে দেখল তার বুদ্ধি কাজ করছে না। মেয়েটা তার সঙ্গে দেখা করতে চায়? কেন? মেয়েটা কি তাকে ভালবেসে ফেলেছে? রোজ দেখতে দেখতে ভালবেসে ফেলেছে? তার সম্পর্কে মেয়েটা কিছুই জানে না, সে কী এমন ছেলে, যাকে দেখেই পছন্দ করে ফেলবে কেউ? শহরের ভদ্রবাড়ির মেয়ে তাকে পছন্দ করল?
শান্তনুর রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠল। গির্জা? গির্জাটা কোথায়? সে তো জানে না। কী হবে তা হলে? কোন গির্জার সামনে মেয়েটা সাড়ে তিনটের সময় দাঁড়িয়ে থাকবে? আজই সাড়ে তিনটে? সেটা তো লেখা নেই। শান্তনু কী করে বুঝবে?
কাজে মন দিতে পারল না শান্তনু। অফিসে তারই বয়সি আর একটা ছেলে আছে, সমীর। সমীর খুব চালাকচতুর, চোখেমুখে কথা বলে। পোড়া কালো দুটো ঠোঁট টিপে পিচিক পিচিক হাসে। শান্তনু সমীরকে জিজ্ঞেস করল, ‘এখানে গির্জা কোথায়?’ ‘গির্জা? লেনিন সরণির ওপর একটা গির্জা আছে। কেন রে?’ বলল সমীর। ‘নাহ্, এমনি।’ শান্তনু মুচকি হাসল। ‘এমনি-ফেমনি নয় বাবা, সত্যি বল!’ সমীর চেপে ধরল তাকে। অগত্যা কিছুটা বলতে চেয়ে, কিছুটা সহায়তার প্রত্যাশায় শান্তনু বলে ফেলল সব কথা সমীরকে।
সমীর নেচে উঠল, ‘আরে ওই মেয়েটা তো? দেখতে হেভি! লেগে পড়!’
শান্তনু বলল, ‘আমার ভয় করছে। যাব? সত্যি? ঠিক হবে?’ ‘একশো বার যাবি। কী করবে মেয়েটা? তোকে কিডন্যাপ করবে? আরে আমি যাব তোর সঙ্গে। পেছনে থাকব, দেখ না কী বলে!’
তিনটে পনেরো নাগাদ সমীর আর শান্তনু পৌঁছে গেল গির্জার সামনে। একটু অপেক্ষা করতেই দেখতে পেল মেয়েটা ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে হেঁটে আসছে গির্জার পিছন দিক দিয়ে। একটা সাদা ফুল ছাপ সালোয়ার কামিজ, নীল ওড়না পরনে। আসতে আসতে মেয়েটা বার বার ভয়ার্ত চোখ মেলে তাকাচ্ছে এ দিক ও দিক, সামনে, পিছনে, পাশে। এই প্রথম মেয়েটাকে সর্বাঙ্গীন দেখল শান্তনু। খুব রোগা, কিন্তু লাবণ্য আছে। গ্রামের মেয়েদের এমন সুষমা থাকে না। এই মেয়েটা কেন তার সঙ্গে দেখা করতে চাইল? শান্তনু দ্বিগুণ ভয় পেল এ বার, সে চলেই যেত কিন্তু সমীর হাত চেপে ধরল তার। তাদের সামনে এসে মেয়েটা চট করে ওড়না দিয়ে মাথা ঢেকে ফেলে বলল, ‘সর্বনাশ হয়েছে। আমাদের সদর দরজাটা বাইরে থেকে টানলেই ছিটকিনি পড়ে যায়। আমি একটা কাঠি গুঁজে রেখে আসব ভাবলাম, কিন্তু হাওয়ায় ছিটকিনি পড়ে গেল। এখন আমি বাড়ি ফিরতে পারব না। বাইরে বেরোনোর জন্য আমাকে বেধড়ক মারবে!’ মেয়েটার চোখ ছলছল করে উঠল। শান্তনু কী বলবে ভেবেই পেল না, সমীর বলল, ‘মারবে কেন? বাইরে বেরোলে কী হয়েছে?’ ‘সে অনেক কথা! আমার তো বাবা-মা নেই, কাকা, কাকিমা ভীষণ মারে। আমার বিয়ে দিয়ে টাকা রোজগার করবে মতলব করেছে। আমি সেই ছেলেকে বিয়ে করব না।’ মেয়েটার মুখটা করুণ হয়ে যায়, ‘আমি অনেক দিন ধরে তোমাকে ভালবাসি।’ শান্তনুর দিকে তাকাল মেয়েটা।
শান্তনুর বুকে কেমন তোলপাড়, এমন কথা সে এ জীবনে শোনেনি, ‘ভালবাসি’, শান্তনুর নিশ্বাস পড়তে পারে না, আর সমীর পাশে দাঁড়িয়ে দেখল বলে গর্বও বোধ করে সে। সমীর বলে, ‘তা হলে কী হবে এখন?’
মেয়েটা তার দিকে তাকায়, ‘আমি আর বাড়ি যাব না। আর ফিরব না। আসতে আসতেই আমি ভেবে নিয়েছি!’ ‘কী?’ সমীর বলে। ‘আমি তোমার সঙ্গে পালাব।’ মেয়েটা
শান্তনুকে বলে। ‘মানে? পালাব মানে?’ কোনও মতে
বলে শান্তনু।
সমীর বলে, ‘সে আবার কী? কথা নেই বার্তা নেই পালালেই হল।’
মেয়েটা বলে, ‘কেন? তুমি আমাকে
খাওয়াতে পারবে না? তুমি তো রোজগার করো। চাকরি করো।’
সমীর বলে, ‘অ্যাই তোমার নাম কী?’ ‘রিয়া।’ ‘রিয়া, তুমি ওকে চেনো না জানো না, ওর সঙ্গে পালাবে?’
রিয়া জেদি জেদি মুখ করে বলে, ‘বললাম তো, আমি ওকে ভালবাসি।’
একটা মিছিল যাচ্ছে লেনিন সরণি দিয়ে, শান্তনুর মনে হল চট করে সরে পড়ে ওই মিছিলের ভিড়ে মিশে যায়। কিন্তু তার পরই তার মনে হয় মেয়েটা তাকে ভালবাসে! মেয়েটা বিপদে পড়েছে, সত্যি যদি বাড়ি ফিরলে ওর কাকা কাকিমা ওকে বেধড়ক ঠ্যাঙায় তা হলে? এই মুহূর্তে অসহায় মেয়েটাকে সেও প্রাণপণ ভালবেসে ফেলে। ‘ভালবাসি’ শব্দটাই বিরাট আদেশনামা জারি করে যেন শান্তনুকে। যাকে ভালবাসে তাকে বাঁচাতে পারবে না সে কেমন পুরুষ! সমীর তার থেকে দেখতে-শুনতে ভাল, তবু মেয়েটা তাকেই চায়, শান্তনুর তেইশ বছর বয়েসের জীবনে এর থেকে বেশি স্বীকৃতি কল্পনা করা যায় না। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, বলে, ‘আমার নাম শান্তনু। আমার মা পাঁচ বাড়ি রান্নার কাজ করে, আমাদের পিয়ালি গ্রামে বাড়ি। আমরা প্রায় গরিব, তবে তোমাকে খাওয়াতে পারব, তোমার পোষাবে তো?’
মেয়েটা ঘোমটাটা একটু সরায়, ‘পিয়ালি গ্রাম কি অনেক দূরে?’ ‘শিয়ালদা থেকে দেড় ঘণ্টা।’ ‘তবে খুব ভাল, আমার কাকা আমাকে কখনও খুঁজে পাবে না।’
সমীর বলে, ‘আমি কিন্তু এর মধ্যে নেই। আমি চললাম। শেষে পুলিশ কেসে ফেঁসে যাব। শান্তনু জেনে নে, ওর আঠেরো বছর বয়স হয়েছে কি না?’
রিয়া বলে, ‘নাহ্, আমার সতেরো।’ ‘খেয়েছে!’ সমীর বলে, ‘শান্তনু, বুঝে শুনে এগো কিন্তু!’
রিয়া বলে, ‘আপনি ওকে ভয় দেখাচ্ছেন কেন?’
সমীর বলে, ‘জানাজানি হবে যখন? ওকে তো এখানেই কাজ করতে আসতে হবে। ঠ্যাঙাবে ধরে, তখন?’
শান্তনু বলে, ‘তুই ছাড় না। আমাদের ব্যাপার আমরা বুঝে নেব!’
রিয়া বলে, ‘এখুনি মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করে নিলে আর তো আমাদের ছাড়াছাড়ি করাতে পারবে না! পুলিশের বাবাও পারবে না। দু’মাস পরেই আমার আঠেরো হয়ে যাবে। এই দু’মাস আমি পিয়ালির বাড়ি থেকে বেরোব না! লুকিয়ে থাকব।’
শান্তনু বলে, ‘তুমি কি এখনই আমার সঙ্গে চলে যেতে চাও?’ ‘আর নইলে উপায় কী? তুমি আমাকে এখনই বিয়ে করে নাও। এক বার সিঁদুর পরে নিলেই আমি তোমার বউ!’ ‘বউ’? আবার শিহরিত হয় শান্তনু। সে ভাবে এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে গেলে গ্রামে তার বেশ নামডাক হবে। স্মার্ট, সুন্দর, শহুরে মেয়ে, চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে, ভুরুটা কেমন উঠে যায় তখন। বিয়ের জল গায়ে পড়লে একটু গত্তি লাগবে। লাল শাড়িতে কেমন যে দেখাবে ভেবে পায় না শান্তনু। সে মনে মনে হাসে। ভাইয়ের আগেই সে বিয়ে করে ফেলল? |
|
শান্তনু সমীরকে বলে, ‘সমীর, তুই ভাই একটু হেল্প করে দে। আমাদের বিয়েটা দিয়ে দে! বিয়ে করে ঘরে তুললে মা আর আপত্তি করতে পারবে না!’ ‘তোরা যা খুশি কর। আমাকে এর মধ্যে টানিস না!’
রিয়া বলে, ‘সমীরদা প্লিজ, বন্ধুর জন্য এটুকু করুন! আর আমি তো আপনার ছোট বোনের মতো।’
সমীর চুলের মধ্যে হাত চালায়, ‘মাইরি, বহুত গণ্ডগোল হবে!’ বলে কাকে একটা ফোন লাগায়,‘বউবাজার কালীবাড়ির সামনে দাঁড়া, একটা বিয়ে দিতে হবে।’ সমীরকে বেশ গুরুগম্ভীর দেখায়।
এক ঘণ্টার মধ্যে সিঁদুর পরিয়ে বিয়ে হয়ে যায় শান্তনুর সঙ্গে রিয়ার। রিয়ার হাতে এখন কালীবাড়ির লাল শাঁখা, গলায় রজনীগন্ধার মালা। রিয়া মালা দুলিয়ে হাসে। খিলখিল করে হাসে। শান্তনু মুগ্ধ হতে থাকে, ছটফট করতে থাকে গ্রামের লোকেদের সামনে, মায়ের সামনে, প্রতাপের সামনে বউকে নিয়ে যেতে। তার তর সয় না। সমীর, সমীরের দুই বন্ধু চঞ্চল, রাজেশ, শান্তনু, রিয়া একটা এসি মিষ্টির দোকানে ঢোকে মিষ্টি খেতে। সমীরের মধ্যে এখন বেশ একটা বরকর্তা বরকর্তা ভাব। রিয়া বলে, ‘এত টেনশন হচ্ছিল, এসি-তে ঢুকে একটু আরাম হল।’ শান্তনু হঠাৎ বলে, ‘আমাদের বাড়িতে কিন্তু লাইট নেই। ইলেকট্রিক নেই। গ্যাসও নেই। কল নেই, সব তোলা জল।’ ‘ইলেকট্রিক নেই?’ রিয়া হাঁ করে তাকায়।
এই সময় সমীরের ফোনে একটা ফোন আসে। কথা বলে ফোন ছেড়ে দিয়ে সমীর বলে, ‘বিভাসদা তোকে আমাকে খুঁজছে। হেভি খচে গিয়েছে। তুই কি অফিসে এক বার যাবি? আমাকে যেতেই হবে।’
শান্তনু বলে, ‘রিয়াকে ফেলে আমি কী করে যাব?’
রিয়া মিষ্টির দোকানের বেসিনে হাত ধুতে ধুতে সামনের আয়নায় নিজেকে দেখছিল। রিয়ার মুখটা একটু গম্ভীর। রিয়া বলে, ‘তুমি কি আর এই অফিসে যাবে না? কাজ ছেড়ে দেবে?’ ‘কেন? কে জানবে তুমি আমার সঙ্গে পালিয়েছ?’ ‘তা হলে তুমি এখন অফিসে যাও। ঘুরে এসো এক বার।’ ‘তুমি কী করবে?’ রিয়াকে বউই মনে হয় শান্তনুর। ‘এ দিক ও দিক ঘুরে বেড়াই। অফিস থেকে বেরিয়ে তুমি আমাকে মিট করে নিয়ো।’ ‘তাই হয় নাকি? একা মেয়ে ঘুরে বেড়াবে?’ ‘একটা কাজ করি না?’ রিয়া তার জামা ধরে টান দেয়, ‘সিঁদুরটা মুছে এক বার বাড়ি ফিরে যাই? একটু মারবে মারুক! পাঁচ দশ দিন পরে আবার পালাব সুযোগ করে। তত দিনে তুমি একটু ইলেকট্রিক লাইটও এনে নিতে পারবে না বাড়িতে?’ ‘ইলেকট্রিক? পাঁচ দিনে?’ ‘দেখো যে ছেলেটার সঙ্গে আমার বিয়ের ঠিক হয়েছে, তাদের বাড়িতে এসি আছে। কিন্তু আমি পালিয়ে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। ছোট্ট থেকে! শুধু একটা ফ্যান হলেও চলবে। তা ছাড়া গ্রামে কত সাপখোপ! লাইট না হলে আমার ভয় করবে।’
শান্তনুর ঠোঁটের ওপর মিষ্টির রস চ্যাটচ্যাট করতে থাকে।
রিয়া বলে, ‘পারবে না?’
শান্তনু বলে, ‘জানি না!’ পকেট থেকে একশো টাকা বের করে সে মিষ্টির দাম দেয়। ঠোঁটের রসটা মোছে না সে।
সমীর তাড়া দিয়ে বেরিয়ে যায় দোকান থেকে বন্ধুদের নিয়ে। রিয়া হাতে ধরা মালাটা শান্তনুকে দেয়। লাল শাঁখা খুলে তার পকেটে ভরে দেয় নিজেই। নরম সরু সরু আঙুলের চাপে। বেসিনের ওপর ঝুঁকে দ্রুত সিঁদুর ধুয়ে ফেলতে ফেলতে
তাকায় তার দিকে। ফিক করে হাসে। বলে, ‘সাবানও আছে!’
সমীরকে ব্যাপারটা বোঝাতে বোঝাতে মডার্ন প্রিন্টিং-এ ফিরে আসে শান্তনু। সমীর শুধু বার বার বলতে থাকে, ‘যাব্বাবা, যাব্বাবা!’
অফিসে ঢুকতেই শান্তনু দেখে বিভাসদার সামনে একটা রোগা মতন, ফর্সা মতন, চোখে চশমা ভদ্রলোক বসে আছেন। বিভাসদা তাদের দেখেই বলে ওঠে, ‘পাড়ার লোকেরা বলেছে ওঁর ভাইঝি রিয়া তোর সঙ্গে পালিয়েছে সমীর!’
সমীর শান্তনুর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে, তার পর চোয়াল ঝুলিয়ে দিয়ে বলে, ‘আমার সঙ্গে না, ওর সঙ্গে পালিয়েছিল। একটু আগে বাড়ির মেয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছে।’ ‘বাড়ি ফিরে গিয়েছে?’ ভদ্রলোক উঠে দাঁড়াল। ‘হ্যাঁ, মাথার স্ক্রু পুরো ঢিলে আছে আপনার ভাইঝির!’
আরে! ‘অনেক কিছু বলতে চেয়ে সমীর শুধু বলল, ‘ধুস, থানায় গেলে যান। যা খুশি করুন।’
ভদ্রলোক লজ্জিত চোখে শান্তনুর দিকে তাকান এক বার, ‘এত বার পালিয়েছে যে থানায় আর ডায়রিই নিতে চায় না। হাসাহাসি করে।’
সমীর আরও চটে যায়। শান্তনুকে বলে, ‘তুই কিছু বলবি? আমি হলে তিনশো টাকা ফেরত চাইতাম!’
শান্তনু বলে, ‘না!’ ভদ্রলোক বলেন, ‘পালানোটা ওর নেশা! পালায়, সিঁদুর পরে, আবার সিঁদুর তুলে ফিরে আসে। ফোন করে বলে কাকা, ছেলেটা ভাল না, আমায় ফেরত নিয়ে চলো। কখনও বলে, তোমাদের জন্য মন খারাপ লাগছে!’ |
ছবি: সুমন চৌধুরী |
|
|
|
|
|