|
|
|
|
|
|
|
অদ্ভুত আঁধার এক |
দৃষ্টিহীন মানুষটি রাষ্ট্রের অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অক্লান্ত। অতএব রাজরোষ।
রাষ্ট্রের নাম চিন,
সুতরাং অন্ধকার দূর হবে কি না, কেউ জানে না, ওয়াশিংটনও না।
চেন গুয়াংচেং-এর রুদ্ধশ্বাস বৃত্তান্ত জানাচ্ছেন সেমন্তী ঘোষ |
এক একটা রাতের অন্ধকার একদম অন্য রকম। এত কালো, এতই জমাট-বাঁধা কালো যে মনে হয় সামনে এগোতে গেলে ধাক্কা খেতে হবে। মনে হয় নিজেকেই নিজে ঠাহর করা যাচ্ছে না। ২২ এপ্রিলের অমাবস্যার রাতটা ছিল ঠিক সেই রকম। আকাশে চাঁদ তো নেই-ই, তারাও নেই, মেঘে ঢাকা পড়েছে আকাশের নিজের আলোটুকুও। কপাল খুবই ভাল। পালানোর জন্য ঠিক এই রাতটাই দরকার ছিল। এতটাই আঁধার হবে না জানলেও একটা ধুকপুকে আশা ছিলই মনে, এপ্রিলের অমাবস্যাগুলো তো এমনিই হয় প্রতি বছর। পাঁচিলের সামনে দাঁড়িয়ে এক সেকেন্ডের জন্য অন্ধকারের দেবতাকে নিঃশব্দে ধন্যবাদ জানিয়ে ক্ষিপ্র বেগে পাঁচিল বেয়ে উঠতে শুরু করলেন চেন।
বিরাট উঁচু পাঁচিল, কাঁটাতার ঘেরা, কিন্তু তাতে কী? এ সব তাঁকে দমাতে পারবে না। তারের ফাঁক দিয়ে গলে ওই দিকে তরতরিয়ে নামার জন্য কত দিন ধরে শরীরে মনে প্রস্তুতি। উঁচু, কাঁটা, এবড়োখেবড়ো, কিছুতেই কিছু আসে যায় না, ভয় শুধু ওই বন্দুকধারী রক্ষীগুলোকে। দোর্দণ্ডপ্রতাপে সারা দিন টহল দেয় ওরা, নজর তো নয়, ভাবলেশহীন পাথর-কোঁদা মুখগুলোতে যেন শিকারি বাঘের চাউনি, রাতের ঘুমও ওদের কাচের মতো, পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে ভেঙে যায়। ওদের ফাঁকি দেওয়ার জন্যই না এই ঘন-আঁধারের রাতটা বেছে-নেওয়া। পাশের লোককেও দেখা যায় না, এত বড় চৌহদ্দির পাঁচিলের দিকে নজর রাখবে কে! ধন্যবাদ, অন্ধকারের দেবতা!
কিন্তু... উঃ! পাঁচিলের ও পাশ দিয়ে নামার সময়ে পা-টা হঠাৎ পিছলে গেল, এক পা সড়াত্ করে নেমে গেল অনেকটা, দুম্ করে মাটিতে পড়ল চেন। কী হবে... কী হবে এ বার? কেউ যদি শুনতে পায়? ওই তো, দপ্ করে আলো জ্বলে উঠল না? চেন-এর বাড়ির লাগোয়া প্রতিবেশীর ঘরের আলো। ওই যে তিনি নেমে আসছেন সিঁড়ি দিয়ে। কী হবে তা হলে? শুরুর আগেই তরী ডুববে? না, কিছুতেই না! ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়লেন চেন। দুই চোখই অন্ধ তো কী, অনেক দিনের চেনাশোনায় তিনি ভাল মতোই জানেন এ বাড়ির দালান কোথায়, সিঁড়ি কোথায়, চাল কোথায়। যত দূর সম্ভব পায়ের শব্দ না করে ছুটতে ছুটতে সিঁড়ি বেয়ে চালে উঠে পড়লেন, ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করলেন, যত ক্ষণ না প্রতিবেশী নীচে নেমে হাঁটাহাঁটি করে কীসের আওয়াজ বুঝতে না পেরে আবার ঘরে ঢুকে যান। ঘরের আলো নিবে যেতেই আবার সব আঁধার! চাল থেকে নেমে দ্রুতপায়ে আবার শুরু পালানো। অন্ধ চেন-এর এই সফর যে অনেক লম্বা, পদে পদে তাঁর যে অসংখ্য বিপদ, মুহূর্তের ভুল হলে সাক্ষাৎ মৃত্যু। দাঁড়ানোর ফুরসত কই, দৌড় দৌড়।কবে থেকে অপেক্ষা এই রাতের জন্য। অন্ধ চেন জানেন, অন্ধকারই তাঁর সঙ্গী, অন্ধকারই তাঁর সহায়। যে অন্ধকার তাঁর দু’চোখের চির দিনের সাথি, সেই অন্ধকারই পারে অসহনীয় বন্দিদশা থেকে তাঁকে মুক্ত হওয়ার সুযোগ দিতে। সেই অন্ধকারই পারে সকল চক্ষুষ্মানের দৃষ্টি কালো করে দিয়ে চেন-এর সঙ্গে তাদের সমানে সমানে এক জায়গায় এনে দিতে। তার পর দেখাই যাক না, প্রাণ হাতে করে পালিয়ে বাঁচার খেলায় কে জেতে কে হারে। তাই কবে থেকে অপেক্ষা অন্ধকারতম রাতটির জন্য। ২২ এপ্রিল, রবিবার।
কবে থেকে অপেক্ষা! আজ দু’বছর ধরে নিজের বাড়িতে বন্দি চেন গুয়াংচেং। চিন দেশের পুব দিকে, বেজিং শহরের ৫০০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে শানডং প্রদেশের প্রত্যন্ত অনামা গ্রাম ডংশিগু-তে তাঁর বাড়ি। বাড়িটাকেই জেলখানা বানিয়ে দেওয়া হয়েছে এখন। জানলাগুলো ঢেকে দেওয়া হয়েছে বড় বড় লোহার পাতে, টেলিফোন টেলিভিশন ইন্টারনেট সব কানেকশন কেটে দেওয়া হয়েছে। দু’এক বার বাইরের লোক দেখা করতে এলে তাদের হাত দিয়ে খবর চালাচালির চেষ্টা করে ধরা পড়ে শাস্তি জুটেছে বেধড়ক মার, মার খেয়েছে বউ আর ছেলেমেয়েও, তাদের বয়েস দশ আর ছয়। কিন্তু হাল ছাড়ার লোক তো তিনি নন, এখানেই তো তাঁর লড়াকু জীবন শেষ হতে পারে না, পালাতে তাঁকে হবেই।
|
|
এ কি আজকের কথা? সেই নব্বইয়ের দশক থেকে লড়াই শুরু। বাল্যেই অন্ধ, তাও কোনও মতে লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর থেকেই একটার পর একটা সামাজিক লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছেন। নব্বইয়ের দশকে আন্দোলন করেছেন, তাঁর মতো প্রতিবন্ধীদের জন্য রাষ্ট্রের যে অর্থসাহায্য দেওয়ার কথা, গরিব লোকরা তা পায় না বলে গ্রামে গ্রামে প্রচার করেছেন। শানডং-এর কাগজ-তৈরির কারখানা যে ভাবে রাসায়নিক বর্জ্য অবারিত ভাবে নদীতে ফেলে নদীর জল দূষিত করছে, ২০০০ সালে তার প্রতিবাদে মামলা করেছেন। তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছে দেশময়, বিদেশেও। গ্রামে গ্রামে মানুষের দুর্দশার প্রতিকারের প্রতিজ্ঞা নিয়ে খালি পায়ে ঘুরে বেড়াতেন বলে তাঁর নাম হয়েছিল ‘রিক্তপদ উকিল’, ‘বেয়ারফুট ল’য়ার’। বেজিং সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছিল, স্বাভাবিক, কেননা এই নেহাত ছোট মাপের ‘কান্ট্রি ল’য়ার’ মানুষগুলোই যে পিপলস রিপাবলিকের অপ্রতুল ক্ষমতার গভীরে অন্তর্ঘাত হানার জোর রাখে, অসীম প্রতাপশালী নেতৃবৃন্দের নজর তা এড়াবে কেমন করে!
এরই মধ্যে ২০০৫ থেকে শানডং প্রদেশ জুড়ে বিরাট আন্দোলন গড়ে তুললেন চেন, চিনা রাষ্ট্রের এক-সন্তান-নীতির কড়া প্রয়োগের লক্ষ্যে সরকারি কর্তারা যে ভয়াবহ অত্যাচার চালাচ্ছেন তার বিরুদ্ধে। গ্রাম উজাড় করে মহিলাদের জোর করে ধরে এনে অনুর্বরা করে দেওয়া হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য পূরণের তাগিদে অবর্ণনীয় শারীরিক অত্যাচার করা হচ্ছে তাঁদের ওপর, ভয়ে পলাতকা যাঁরা, তাঁদের ধরে এনে নির্মম শারীরিক নিগ্রহে সারা জীবনের মতো শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে এ সবের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠলেন তিনি। বহু মানুষ তাঁর পাশে জড়ো হল গ্রামের সাধারণ মানুষ। শানডং প্রশাসন বিনা বিচারে তাঁকে জেলে পুরল ২০০৬ সালে। চার-চারটে বছর জেল খেটে ২০১০-এ ছাড়া পেলেন, এবং সেই মুহূর্তেই আবার গৃহবন্দি হলেন। সেই ২০০৬ থেকে এই ২০১২-র ২২ এপ্রিল পর্যন্ত খোলা হাওয়ায় দাঁড়ানোর সুযোগ পাননি চেন। অথচ হাজতবাস বা গৃহবন্দিত্ব, কোনওটারই পিছনে কিন্তু কোনও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই তাঁর বিরুদ্ধে। নিরপরাধ স্বাধীন নাগরিক তিনি, তবু বন্দি। দেশের যে কোনও প্রান্তে নিজের অধিকারেই অবাধে চলাচল করার কথা, তবু দাগি অপরাধীর মরণবাঁচন দৌড় দিচ্ছেন আজ অমাবস্যায়। হ্যাঁ, ওরা যতই যা করুক, এখনও আশা শেষ নয়। তিনি পালাবেন।
পালাবেন, কিন্তু কী ভাবে? প্রথমে কিছু কাল প্রবল অসুস্থের ভান করে শুয়ে রইলেন চেন, বাড়ির মধ্যেও হাঁটাচলা করলেন না। বাড়ি ঘিরে দিনরাত পাহারায় যে শ-খানেক রক্ষী, তারা যেন ভেবে নেয়, চেন যখন এতই অসুস্থ, পালানোর চেষ্টার প্রশ্নই ওঠে না। তার সঙ্গে সঙ্গে অনেক যত্নে অনেক দিন ধরে চলল গোপন পরিকল্পনা। শেষ পর্যন্ত এই অমাবস্যার রাত। চেন আজ পালাবেন। যত দিন, যত রাত দৌড়তে হয় দৌড়বেন, যত বার পড়তে হয় পড়বেন, পা ভাঙতে হয় ভাঙবেন, কিন্তু পালাবেন। বেজিং-এ পৌঁছবেন। তবেই হয়তো বন্ধুরা তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারবে। সরকারের রোষনজর থেকে মুক্তিলাভের কিছু একটা উপায় মিলবে। হয়তো দুরাশা। কিন্তু একমাত্র আশা।
টানা ১৯ ঘণ্টা। কত মাইল দৌড়লেন এই অন্ধ পলাতক, কত পুলিশ কত গার্ডের নজর এড়িয়ে বাঁচলেন, কত বার মুরগি কিংবা শুয়োরের খামারের দুর্গন্ধী কোনায় জিরোলেন, ২০০ বার হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লেন, পায়ের তিনটে হাড় ভাঙার পর ছুটতে না পারলে হামাগুড়ি দিয়ে পথ পেরোলেন! বেজিং-এর কাছাকাছি এক জায়গায় গাড়ি অপেক্ষা করবে, সেই গাড়িতে থাকবে বিশ্বস্ত বন্ধু হে পেইরং, দুনিয়া চুলোয় গেলেও পেইরং-এর গাড়ির কাছে পৌঁছতে হবে তাঁকে। শেষ অবধি তা-ই হল, পেইরং একটি ট্রাক চালিয়ে এসে বিধ্বস্ত চেন-কে রাস্তা থেকে তুলে নেওয়ার পর এ গাড়ি ও গাড়ি সে গাড়ি বদল করতে করতে চুপিসাড়ে তাঁকে বেজিং-এ ঢুকিয়ে দিলেন। সেখানকার মার্কিন দূতাবাসের লক্ষ্যে গাড়ি ছুটল। ইতিমধ্যেই কতিপয় ফোন মারফত দূতাবাসে খবর এসেছে, গৃহবন্দি চেন গুয়াংচেন পালিয়েছেন, গোটা দেশই তাঁর কাছে বিপজ্জনক, তাই তাঁকে সোজা মার্কিন দূতাবাসে আশ্রয়ের জন্য নিয়ে আসা হচ্ছে। বিস্ময়াহত মার্কিন দূতাবাস কর্মীরা দৌড়োদৌড়ি লাগিয়ে দিলেন। এমনিতেই সে সময় তাঁদের দম ফেলার জো নেই, ওয়াশিংটন থেকে ক’দিন পরেই বেজিং-এ এসে নামছেন মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি রডহ্যাম ক্লিন্টন। |
|
দূতাবাসে ছ’ছটা দিন কেটে গেল চেন-এর। এই ছ’দিন দূতাবাসে যেন ঝড় বইল সারাক্ষণ। বৈঠকের পর বৈঠক, ফোনের পর ফোন, সংকট পর সংকট, চিনা ও মার্কিনি অফিসাররা কখনও ঠান্ডা কখনও গরম, কখনও আলোচনা কখনও প্ররোচনা। কী হবে শরণার্থী চেন-এর? কোথায় যাবেন তিনি এর পর? কী চান তিনি নিজে? কী চায় চিনা সরকার? কী অবস্থান মার্কিন পক্ষের? অদ্ভুত পরিস্থিতি: এক চিনা নাগরিকের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিনকেই সে দিন অনবরত দর-কষাকষি করে যেতে হচ্ছে দুনিয়ায় তার সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ দেশটির সঙ্গে। একটিমাত্র মানুষকে ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দুই দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, উত্তাল হয়ে উঠেছে বিশ্ব-কূটনীতির মঞ্চ। চিনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নিয়মিত মানবাধিকার ভঙ্গের অভিযোগ করে আসে যে আমেরিকা, বিশ্বের দরবারে বেজিংকে হেয় করতে যে ওয়াশিংটনের এটাই প্রধান অস্ত্র, মে মাসের প্রথম সপ্তাহে, হায় সেই অভিযোগের জলজ্যান্ত প্রমাণ কোলে নিয়ে বসে আছে বেজিং-এর মার্কিন দূতাবাস! কী পরিহাস, মার্কিন আশ্রয়ক্রোড় থেকেই বেজিংকে আজ ফেরত পেতে হবে তাদের বিতর্কিত মানবাধিকার কর্মী, শানডং প্রদেশের রাজনৈতিক আইকন চেন গুয়াংচেংকে। ২ মে এসে পৌঁছলেন হিলারি, প্রথমটা তিনি এ নিয়ে মুখ না খুললেও ক্রমেই দেখা গেল, প্রেসিডেন্ট হু জিনতাও আর হিলারি ক্লিন্টনের বৈঠকের গতি তীব্র বেগে ঘুরতে শুরু করেছে এই অভাবিত নতুন বাঁকে। বিশ্ব-অর্থনীতি থেকে শুরু করে উত্তর কোরিয়ার পরমাণু-শক্তি নির্মাণ, সব আলোচ্য বিষয়ই গৌণ হয়ে গেল দ্রুত, প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়াল: চেন গুয়াংচেং। কী করা যায় তাঁকে নিয়ে? ইতিমধ্যে ছ’দিন পর দূতাবাসের দরজা খুলে রাস্তায় পা রাখলেন চেন, তিনি নাকি জানিয়ে দিয়েছেন, না, দেশ ছেড়ে যাবেন না তিনি, মার্কিন মধ্যস্থতায় এখানেই তাঁর থাকা এবং আইন নিয়ে আরও পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দিতে নাকি রাজি বেজিং। চললেন তিনি হাসপাতালে, সেখানে তাঁর ভাঙা পায়ের চিকিৎসা হবে। চাওয়্যাং হাসপাতালে ইতিমধ্যে আনা হয়েছে চেন-এর স্ত্রী ও পুত্রকন্যাকেও।
হুইলচেয়ারে বসা চেন-কে হাসপাতালে ঢুকে যেতে দেখা গেল কাচের জানলা দিয়ে, পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন আলোকচিত্রীরা। ভালই করলেন। ধরা রইল একটি মুহূর্ত, যে মুহূর্তটি থেকেই শুরু ভয়ঙ্কর এই কাহিনির ভয়ঙ্করতর পরবর্তী পর্ব।
হাসপাতালের ঘরে দেখা হতেই জানালেন চেন-এর স্ত্রী, দুই দিন টানা তাঁকে চেয়ারে বেঁধে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে শানডং-এর পুলিশ, একটু বেচাল হলেই ছেলেমেয়ে-সুদ্ধ প্রাণে মারার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কী ভাবে চেন পালালেন, কী ভাবে এই গোপন পরিকল্পনা করা হল, তার বিশদ তথ্য জানতে প্রতিহিংসায় উন্মাদ হয়ে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব অনেককে গ্রেফতার করেছে, নিয়মিত হুমকি দেওয়া হচ্ছে বাকিদের। অল্প একটুক্ষণ ফোনে কথা বলতে পারলেন চেন, এক প্রতিবাদী সমাজকর্মী বন্ধুর সঙ্গে। বন্ধু তাঁকে কয়েকটি মাত্র বাক্য বলার সুযোগ পেলেন: পালাও পালাও, সরকারি অফিসাররা এখনই হয়তো কিছু করবে না তোমায়, এখন বড্ড বেশি লাইমলাইট, কিন্তু আলো ফিকে হলেই তোমার উপর নেমে আসবে ভয়ঙ্করতম শাস্তি। শুধু হাজতবাস বা গৃহবন্দিত্ব নয়, তার চেয়ে আরও অনেক ভয়ানক কোনও দুর্বিপাক। পালাও। শক্ত হয়ে গেল চেন-এর মুখ, টানা ছ’ দিন ধরে অনেক প্রত্যক্ষ পরোক্ষ চাপ সত্ত্বেও নিজের দেশের মাটি ছেড়ে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু হাসপাতালে এসে ঘণ্টার কাঁটা ঘুরতে না ঘুরতেই পাল্টে গেল তাঁর সিদ্ধান্ত, নিমর্ম ধাক্কায় বোধোদয়ের মাটিতে আছড়ে পড়লেন তিনি। চার বছরের হাজত, দুই বছরের গৃহবন্দিত্ব, ছ’দিনের দূতাবাস-আশ্রয়, কোনওটাতেই যা বুঝে উঠতে পারেননি, এ বার সেটা বুঝতে শুরু করলেন যতই ভালবাসুন দেশকে, বাঁচতে চাইলে, পরিবারকে বাঁচাতে চাইলে দেশ ছাড়তে হবে। পালাতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। |
আরও যাঁরা |
চেন একা নন। চিন দেশের নানা প্রান্তে এখন বেশ কিছু মুখ, বেশ কিছু নাম, যাঁরা তাঁদের রাষ্ট্রের অত্যধিক নিয়ন্ত্রণ কিংবা মানবাধিকার হরণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছেন, এবং সরকারের তীব্র কোপে পড়ছেন। গুণী শিল্পী আই উইউই এমন একটি নাম। সরকারের আর্থিক দুর্নীতি ফাঁস করে, টুইটারে জনমত তৈরির চেষ্টা করে গ্রেফতার হয়েছিলেন ২০১১-র এপ্রিলে, বেজিং এয়ারপোর্টে। বিশ্বের শিল্পমহল উত্তাল হয়ে ওঠে তাঁর মুক্তির দাবিতে। লন্ডনের টেট গ্যালারি অব মডার্ন আর্ট-এ তাঁর প্রদর্শনীর সামনে আন্দোলন শুরু হয়: ‘ফ্রি আই উইউই’! ২২ জুন তাঁকে জামিনে ছাড়া হয়। আপাতত তিনি সরকারের কড়া নজরদারিতে, টেলিফোনও চব্বিশ ঘণ্টা ‘ট্যাপ্ড’। এর মধ্যেই চেন-প্রসঙ্গে উইউই যেটুকু মন্তব্য করতে পেরেছেন: ‘...If he doesn’t trust anybody, he has enough reason not to trust them.’ |
পূর্বসূরি |
কমিউনিস্ট চিনে এর আগে আর এক জন বিদ্রোহীই পালিয়ে গিয়ে বিদেশি দূতাবাসে আশ্রয় নেন। সে-ও ছিল মার্কিন দূতাবাস। তিয়েন-আন-মেন স্কোয়্যার কাণ্ডের পিছনে যাঁদের প্রভাব ছিল, পদার্থবিদ ফ্যাং লিঝি তাঁদের অন্যতম। তাঁর বিখ্যাত উক্তি: ‘It is better to study socialism than to love socialism...’ গণতন্ত্রের দাবিতে সরব ফ্যাং চিনা সরকারের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায় সবচেয়ে উপরের নাম তখন। গ্রেফতারের আশঙ্কা টের পেয়ে তিনি ও তাঁর স্ত্রী ১৯৮৯-এর জুনে বেজিং-এর মার্কিন দূতাবাসে ঢুকে আশ্রয় প্রার্থনা করেন ও ‘অ্যাসাইলাম’ পান। এই সময়ে তাঁর আর একটি বিখ্যাত লেখা ‘দ্য চাইনিজ অ্যামনেশিয়া’ কমিউনিস্ট চিনের প্রবল মানবাধিকার-দলন ও সে বিষয়ে বিশ্বময় উপেক্ষা এর বিষয়বস্তু। এক বছর ওই দূতাবাসেই থাকার পর তাঁরা দেশ ছাড়েন, ব্রিটেন হয়ে আমেরিকায় আসেন। গত ৬ এপ্রিল অ্যারিজোনায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে। |
|
কোথায়ই বা যাবেন, আমেরিকা ছাড়া? চাওয়্যাং হাসপাতালে ঢোকার সময় তিনটি ফোন হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন মার্কিন দূতাবাসের বন্ধুরা, কিন্তু এখন ফোনে নিজের মত পরিবর্তনের কথা জানাতে গিয়ে চেন দেখেন, কোনও ফোনেই লাইন পাওয়া যাচ্ছে না। কথা শুরু করতেই ডেড হয়ে যাচ্ছে লাইন। কেবিনের দরজা বন্ধ, টিভি ফোন ইন্টারকম কিচ্ছুটি নেই কেবিনে, নিজস্ব ফোনও জ্যামড্। অর্থাৎ? অর্থাৎ আবার তিনি বন্দি, আবার সপরিবারে। বিকেল সন্ধে রাত, ক্ষুধার্ত ছেলেমেয়ে ক্ষুধার্ত স্বামী-স্ত্রী কোনও খাবার পেলেন না, নার্সের কাছে খাবার চাইলে সে মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। রাত কাটল এমনি করেই।
পরের দিন সকালে হঠাৎ গোপনে খবর, মার্কিন কনসুলেট-এর প্রতিনিধি নীচে হাসপাতালের বাগানে অপেক্ষমাণ, চেন-এর স্ত্রী যেন কোনও ছুতোয় কথা বলে আসেন তাঁর সঙ্গে। গেলেন স্ত্রী, জানিয়ে এলেন চেন এখনই দেশ ছাড়তে চান, সম্ভব হলে হিলারি ক্লিন্টন যে বিমানে ফিরবেন, সেই বিমানেই। খানিকটা বিস্মিত হয়েই আরও একটা ফোন চেন-এর স্ত্রী-র হাতে ধরিয়ে দিলেন মার্কিন শুভানুধ্যায়ী। এই ফোনটি শেষ পর্যন্ত কাজ করল, ঐতিহাসিক একটি ভূমিকা পালন করল। কেননা, কিছু ক্ষণ পরে সেই ফোনেই চেন-এর গলা ভেসে এল বেজিং-এর কনসুলেট-এ, বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে তা পৌঁছে গেল খাস ওয়াশিংটনেও, দুনিয়া জুড়ে ধ্বনিত হল চেন-এর বক্তব্য: আই ওয়ান্ট টু লিভ দিস কান্ট্রি। আই ওয়ান্ট টু গো টু আমেরিকা।
না, হিলারির প্লেনে জায়গা হল না তাঁর। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ওবামার ফোন এল বেজিং-এ, এবং আবারও শুরু হল হাই-প্রোফাইল ডিপ্লোম্যাটিক চ্যানেলে চাপ ও উল্টো চাপ। ক্রমে যা দাঁড়াল, হ্যাঁ, আমেরিকা এই পরিবারটিকে কার্যত ‘অ্যাসাইলাম’ দিয়ে নিয়ে যেতে রাজি, মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ইচ্ছানুসারে পঠনপাঠনের ব্যবস্থা করতেও রাজি। বেজিং দৃশ্যতই অত্যন্ত ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ। কিন্তু চেন এই মুহূর্তে এত বড় আন্তর্জাতিক খবর যে সতর্ক পা ফেলা দরকার, সেটাও বুঝতে পারছে তারা।
কিংবা, কে জানে সত্যিই বুঝতে পারছে কি? চেন কিন্তু এখনও হাসপাতালের সেই গোপন গহনেই। তাঁর বড় ভাইকে জেলে পোরা হয়েছে, ভাইপোও গ্রেফতার ইতিমধ্যে। ভাইপোটির সামনে নাকি ইতিমধ্যেই মৃত্যুদণ্ডের খাঁড়া। চেন-এর দৃষ্টান্তে উদ্বুদ্ধ আইনজীবীরা এগিয়ে এসেছেন ছেলেটির হয়ে মামলা লড়তে, কিন্তু ইতিমধ্যেই তাঁদের দুই জনকে ঢোকানো হয়েছে ফেংতাই-এর ডিটেনশন সেন্টারে, বাকি ক’জন হুমকি পেয়েছেন শানডং-এর কাছাকাছি যেন তাঁদে এই লেখা যখন প্রকাশিত হবে, সম্ভবত তখনও অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে না কোনও, মার্কিনগামী বিমানেও তখনও চেন-এর জায়গা হয়ে উঠবে না, খোলা আকাশের তলায় তাঁদের দেখা যাবে না তখনও, জানা যাবে না কেমন আছেন তিনি। অদ্ভুত নীরবতা এক। আর সেই জমাট নীরবতা চিরে চিরে তীব্র আতঙ্কের বিদ্যুৎপ্রবাহ। সবই বড় চুপচাপ। জানা যাবে না বোঝা যাবে না বেশি কিছু। দু’একটা মানুষের মাথা হয়তো দূর থেকে দেখা যাবে। আমরা দূর থেকে জানব, এক ব্যক্তি এক পরিবার একটি সমাজ একটি দেশ পুড়ছে শব্দহীন বিদ্যুৎ-দহনে, চুপ-রিপাবলিকের অতলে। |
|
|
|
|
|