মেঘ, শিলাবৃষ্টি, ট্রেকিং এবং তেনজিং
কোজাগরী লক্ষ্মীপূর্ণিমার মাঝরাতে রুপোলি চাঁদটা যখন গবগবিয়ে জ্যোৎস্না ঢালছে মাঠে, ঘাটে, বিশ্বচরাচরে, ঠিক তখন চড়ে বসলাম রাঁচি আলিপুরদুয়ার ট্রেনটাতে। যাব শিলিগুড়ি হয়ে ইয়াকসাম। সেখান থেকে হাঁটাপথে সমিতি হ্রদ। যাওয়া আসা মিলে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দিন সাতেকের হাঁটা। ‘পথে নারী বিবর্জিতা’ পণ্ডিতদের নিদাঘ উপেক্ষা করেই তিন মহিলা আমাদের সঙ্গিনী।
সারাটা রাত অযথা দৌড়ঝাঁপ করে আর সকাল থেকে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে ট্রেনটা বেলা দেড়টায় নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে ভাতঘুমটুকু দিতে থামল। তখন আকাশের মুখভার। বৃষ্টি এল বলে। ভাড়া গাড়িতে পেলিং রওনা হওয়া মাত্র আকাশটা আর চোখের জল ধরে রাখতে পারল না। কী এক অভিমানে কুয়াশার র্যাপার জড়িয়ে বেদম কান্নাকাটি জুড়ে দিল। দিনের আলোটাও মন খারাপ করে বিকেলের মধ্যেই ছুটি নিয়ে চলে গেল। পেলিং পৌঁছলাম রাত দশটায়। চারি দিক শুনশান। রাস্তায় জনপ্রাণী নেই। হাঁকডাক করে গায়ের জোরে ‘হোটেল প্রবেশ’-এর একটা ছোট ঘরে ঠাসাঠাসি করে ঢুকে চমৎকার একটা শীতঘুম দিতেই সকালে জানলার বাইরে কাঞ্চনজঙ্ঘা।
হোটেল মালিকের ঠিক করে দেওয়া গাড়িতে চড়ে ভাঙাচোরা পাহাড়ি পথে দোল খেতে খেতে পৌঁছলাম ৪২ কিলোমিটার দূর ইয়াকসাম-এ। ‘ডেমাজং’ হোটেলের দোতলায় পাশাপাশি দু’টো ঘরের দখল নিতে না নিতেই এসে গেল মণিলাল লেপচা। সে গাইড হয়ে যেতে চায় আমাদের সঙ্গে। তার ঘাড়েই চার জন পোর্টার জোগাড় করার গুরুদায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে মধ্যাহ্নভোজ সেরে বাইরে এসে দেখি বরফমাখা কাবরু সাউথ উঁকিঝুঁকি মেরে আমাদের খোঁজ করছে।
পাহাড়ঘেরা ইয়াকসামই ছিল সিকিমের প্রথম রাজধানী। ১৬৪১ সালে তিন লামার উপস্থিতিতে প্রথম চোগিয়ালের রাজ্যাভিষেক হয় কার্থোক লেকের পাড়ে নরবুগাং-এ। এখনও করোনেশন থ্রোন আছে। পাহাড়ের মাথায় সিকিমের দ্বিতীয় প্রাচীন (১৭০১ খ্রিস্টাব্দ) দুবদি গুম্ফা। সেখানকার প্রধান লামা ইয়েতিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন শুনে দলের মহিলা সদস্যরা মুখ শুকিয়ে বেন জনসনের গতিতে ফেরার পথ ধরল। তাদের পিছু পিছু আমরাও হোটেলে ফিরে এলাম।
সকালে ঘুম ভাঙাল মণিলাল। সঙ্গে চার পোর্টার বুদ্ধুমান, হিপি সিং, লালবাহাদুর আরহ সুখমান সুব্বা। তার পর পুলিশ চেকপোস্ট, সিকিম ট্যুরিজমের অফিস, বনবিভাগের অফিস পরপর হার্ডলস টপকে বিস্তর টাকাপয়সা জমা দিয়ে, সমস্ত আইনকানুন লক্ষ্মীছেলের মতো মেনে চলব, বনের গাছে হাত দেওয়া তো দূরের কথা, ফিরেও তাকাব না এসব শপথটপথ করে ট্রেকিং শুরু করলাম। আসলে সমিতির পথটা ১৭৮৪ বর্গকিলোমিটার ব্যাপ্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা ন্যাশনাল পার্কের বুক চিরে গেছে। তাই এত কড়াকড়ি।
ঢুকে পড়েছি পাইন, জুনিপারের জঙ্গলে। রোদ উঠেছে, ঝিঁঝিঁর বাজনার সঙ্গে পাখিদের গানটা জম্পেশ জমেছে। পাহাখোলার ওপর ছোট্ট কাঠের প্রথম ব্রিজটা পেরিয়ে চড়াইপথ ধরলাম। আগেকার লোহার সেতুটা বেআক্কেলে নদীটা ভেঙে দিয়েছে। ঘণ্টাখানেক বাদে এল দ্বিতীয় ব্রিজ। তুঁতেখোলার ওপর লোহার সেতুটা বীরবিক্রমে পেরিয়ে পৌঁছলাম। তৃতীয় ব্রিজের এখন অস্তিত্ব নেই। পাথরের ওপর দিয়ে নদী পেরোতে হয়।
বড় বড় গাছের নীচে এক চিলতে ঢালু জমিতেই তাঁবু ফেলা হল। সকালবেলাতেও মেঘপিওনের ব্যাগের ভেতর মনখারাপের দিস্তা ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরেই চলেছে। রেনকোট পরে, রুকস্যাক পিঠে এমনিতেই আমরা জবুথবু, তার সঙ্গে জোঁকের অত্যাচার। লোহার চতুর্থ ব্রিজটা অনেক ক্ষণই পেরিয়েছি। বৃষ্টিটাও আরও জোরে নেমেছে। কাদার ওপর দিয়ে স্কি করতে করতে পৌঁছলাম বাখিম। মেঘেরা তখন মর্নিং শিফট সেরে বাড়ি ফিরেছে। দেখাদেখি বৃষ্টিটাও চম্পট দিয়েছে।
সকালে দেখি রোদ উঠেছে। পান্ডিম আর তেনজিং পর্বত উঁকি মারছে ট্রেকার্স হাটের পিছনে। সোফা এ পথের শেষ গ্রাম। প্রতিটা ঘরেই লাগোয়া দোকান। সেখানে চাল, ডাল, নুন, টুপি, গ্লাভস, ক্যামেরার রিল সবই পাওয়া যায়। গ্রামবাসীরা শাল, গম, আলুর পাশাপাশি ইয়াক প্রতিপালন করেন। সোফার ছোট্ট জলাশয়টার পাশ দিয়ে চড়াইপথ ধরলাম। আজ যাব ফেডাং (১২,৫০০ ফুট)। মাত্র চার কিলোমিটার হাঁটা। আরিব্বাস! কী কাদা! তাঁবু ফেলব কোথায়? অনেক হিসেবটিসেব কষে টেন্টপিচ করে ভিতরে ঢোকামাত্র কুয়াশায় ঢেকে গেল চার পাশ। আবার বৃষ্টি।
ভোরবেলাটা কী দারুণ! ঝকঝকে নীল আকাশ। ময়দানের ও পারেই পান্ডিম, তেনজিং পাহাড়গুলো হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে। সূর্য উঠেই তাদের মাথায় রংবাজি শুরু করল। এখান থেকে একটা রাস্তা চলে গিয়েছে সোজা কোকচুং, আর একটা জোংরির দিকে। আমরা জোংরির পথটাই ধরলাম। তেনজিং আর নরসিং পাহাড় দুটো সমানে আমাদের কড়া নজরে রেখেছে। দিব্যি রোদ ছিল। দেওরালির পরেই শুরু হল মেঘেদের উৎপাত। দল পাকিয়ে জিন্দাবাদ করতে করতে খাদ থেকে উঠে আমাদের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সঙ্গে শিলাবৃষ্টির চড়-চাপড়। ভাগ্যিস জোংরির ট্রেকার্স হাট-এ পৌঁছে গিয়েছিলাম। না হলে মাথায় যে ক’টা স্টিচ পড়ত! মুহূর্তে চার দিক সাদায় সাদা। বরফ পড়েই চলেছে। ভোরে জোংরি টপ যাওয়া যাবে কি না এ নিয়ে মারকাটারি তর্ক করে কাটিয়ে দিলাম সন্ধেটা।
পিক পিক করে মোবাইলের অ্যালার্ম বাজতেই ধড়মড়িয়ে উঠে ফটাফট সব ক’টা শীতের পোশাক গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বৃষ্টির কথা আর মাথাতেই নেই। কখন যে থেমেছে, জানি না। ভোররাতের আকাশে তারাদের জলসা। চাঁদটা আলো দেখিয়ে আমাদের গাইড করছে। ট্রেকার্স হাট থেকে আমরা বেরিয়েছিলাম শতাব্দী এক্সপ্রেসের স্পিডে, চড়াই পথে প্রথমে মালগাড়ি, শেষে গরুর গাড়ির স্টেটাস পেলাম। তার জন্য কি শুধু চড়াই আর আমাদের অপদার্থতা দায়ী? না। যত উঠছি, চাঁদের আলো মেখে বরফ পাহাড়গুলো এমন মায়াবী সেজেছে, যে মুগ্ধ হয়ে হাঁটতে ভুলে গিয়েছি। ঘাসে ঘাসে বরফ পড়ে চিকচিক করছে। ঘণ্টা দেড়েকের কষ্টকর চেষ্টায় যখন জোংরি টপে (১৪,০০০ ফুট) উঠে এলাম, তখন দিনের আলো চোখ মেলছে, সূর্য উঠব উঠব করছে। ওপরে রঙিন পতাকাগুলো বাতাসের ঝাপটায় পত পত করে উড়ছে। সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘা (২৮,১৫৬ ফুট) মহারানীর মতো রাজসিংহাসনে বসে। তাকে ঘিরে আছে রাথোং (২১,৯১১ ফুট), কাবরুডোম (২১,৬৫০ ফুট), ব্ল্যাক কাবরু, কাবরু সাউথ (২৪,০০২ ফুট), কাবরু নর্থ (২৪,০৭৫ ফুট), সিম্ভো, পান্ডিম, তেনজিং, নরসিংরা। সূর্য উঠল। আলোর ঝরনাধারায় রঙের উৎসব শুরু হল পাহাড় জুড়ে। রাঙিয়ে দিল মন। ঘোর লাগল চোখে।
কোকচুংয়ের পথটা মাখো মাখো রোম্যান্টিকতায় ভরা। পান্ডিমের ছায়ায় ছায়ায় পথ চলা। মাইলের পর মাইল ঢেউ খেলানো সবুজ বুগিয়াল। অসংখ্য ঝোরা ছুটে এসে লুটিয়ে পড়ছে পায়ে। ক্ষণে ক্ষণে মেঘ-রোদের পালাবদল চলছে পাহাড়চূড়ায়। শুরু হল উতরাই। সে এক ভয়াবহ ঢালু পথে নেমে চলা। নামছি তো নামছিই। ধুপধাপ পড়ছি, আর উঠে বোকার মতো হেসে আরও একটু নামছি। কোকচুং (১২,৩৬০ ফুট) পৌঁছতে বিকেল হল। আজ আর ট্রেকার্স হাট-এ ঘর মিলল না। নদীর তীরে তাঁবু ফেলা হয়েছে। দুর্বার গতিতে বড় বড় বোল্ডারের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে প্রেকচু। ধীরে ধীরে সন্ধের ছায়া ঘনাচ্ছে ও পারের জঙ্গলে।
সকালে সোনা রোদ লুটিয়ে পড়ছে পান্ডিমের মাথায়। নদী পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকলাম। ঝিলিমিলি পাইনের ছায়ায় ফুরফুরে মেজাজে হাঁটছি। গান গাইতে গাইতে পৌঁছলাম পান্ডিমের বেস ক্যাম্প থানসিং (১২,৪০০ ফুট)। পান্ডিমের কোলে সবুজ ময়দান। রঙিন তাঁবুগুলো আরও কনট্রাস্ট বাড়িয়েছে। এক দল ঘোড়া মনের সুখে ঘাস খাচ্ছে। সামনেই কাঞ্চনজঙ্ঘা। হঠাৎই কুয়াশায় ভরে গেল চার পাশ। শুরু হল বৃষ্টি। মেঘ-কুয়াশার দল এসে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর পান্ডিমকে ঢেকে দিলে। শুধু তো বৃষ্টি নয়। সঙ্গে বরফকণা। জবুথবু আমরা কাবু হয়ে পৌঁছলাম লামোনী। বিকেল শেষে বৃষ্টি থামলে বাইরে এলাম। দিনের আলোয় টান লেগেছে। মেঘ ভাসছে পাহাড়ে পাহাড়ে। হাঁটতে হাঁটতে এলাম প্রেকচু’র তীরে। হঠাৎ মেঘের মশারি সরিয়ে উঁকি দিল পান্ডিম, ঠিক আমাদের মাথার ওপরে। বিদায়ী সূর্যটা অমনি টুক করে রক্ততিলক পরিয়ে দিল তার ফরসা কপালে। মায়াবী আলোয় ভরে উঠল নিরালা লামোনী।
জোংরি টপের মতোই অন্ধকার থাকতে বেরিয়ে পড়েছি ভালুক সেজে। চাঁদটা যথারীতি জ্যোৎস্না জ্বেলে পথ দেখাচ্ছে। আর সেই সুযোগে কাঞ্চনজঙ্ঘাও রূপোলি সাজে সেজেছে। মনে মনে কাঞ্চন সুন্দরীর প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে পৌঁছে গেলাম সমিতি (১৪১৩৪ ফুট)। আর এক নাম সুমেথাং, মানে পাখির চোখ। কোথায় যে মিল, ঠিক বুঝলাম না। ছোট্ট কাঠের তক্তার ওপর দিয়ে নদী পেরিয়ে লেকের পাড়ে দাঁড়ালাম। পান্ডিম হুমড়ি খেয়ে পড়ছে ঘাড়ের ওপর। ঠান্ডায় জল জমে বরফের আস্তরণ পড়ছে। সেখানে কাঞ্চনজঙ্ঘার পূর্ব গাত্রের ছায়া।

যাওয়ার সেরা সময় এপ্রিল-মে,অক্টোবর-নভেম্বর।
কী করে যাবেন
হাঁটা শুরু ইয়াকসাম থেকে। ইয়াকসাম থেকে বাখিমের দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার, বাখিম থেকে সোকা ২ কিমি, সোকা থেকে ফেডাং ৪ কিমি, ফেডাং থেকে জোংরি ৫ কিমি, জোংরি থেকে কোকচুং ৮ কিমি, কোকচুং থেকে থানসিং ৩.৫ কিমি, থানসিং থেকে লামোনী ৪ কিমি, লামোনী থেকে সমিতি ৪ কিমি। বনপথে থানসিং থেকে সোকা ২১ কিমি।
সমিতি হ্রদের ছবি: লেখক



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.