ছুটির ফাঁদ পাতা ভুবনে
ঠিকঠাক ছুটি কাটানো কি মুখের কথা! কখন বিপদ এসে জুটবে, কেউ জানে না। রতনবাবুও জানতেন না।
রতনবাবু গত ২৪ বছর ধরে কলকাতার জিয়োলজিকাল সার্ভে অফিসের কেরানি। প্রতি বছর পুজোর ছুটির সঙ্গে তাঁর বাৎসরিক পাওনা ছুটি গুনেগেঁথে বেড়াতে চলে যান।
সে বারেও তাই হয়েছিল। টাটানগরের অদূরে সিনি নামে একটা জায়গায় গিয়েছিলেন রতনবাবু। সেখানে মনিলালবাবুর সঙ্গে আলাপ। ভদ্রলোকের চালচলন, কথাবার্তা অবিকল যেন রতনবাবুর ‘ডাব্ল’। এমনকী, দু’ জনের জন্মদিন এক। মাইনেও এক। সত্যজিৎ রায়ের ‘রতনবাবু ও সেই লোকটা’ গল্পে এই ঘটনার বিশদ উল্লেখ রয়েছে। ছুটি যে প্ল্যানপ্রোগ্রাম করে কখনও কাটানো যায় না, তাঁর থেকে ভাল কে আর জানত! ফেলুদা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে লখনউ বেড়াতে গেল। কিন্তু সেখানে ‘বাদশাহী আংটি’ হারিয়ে গেল, ‘ভুলভুলাইয়া’য় ঘুরতে ঘুরতে এক ফাঁকে ফেলুদা চোরের চোখে ধুলো দিল, দুষ্কৃতীকে ধরার জন্য গোলমরিচভর্তি কৌটো পকেটে পুরে নিল। বেড়ানোটাই ঠিকঠাক হল না। আর সে বার বারাণসীতে? তোপসে, লালমোহনবাবু সবাই মজা করে দশাশ্বমেধ ঘাটে, বিশ্বনাথ মন্দিরে। ফেলুদা আটকে পড়ল মগনলাল মেঘরাজের জালে। গোয়েন্দাদের এটা ‘জব হ্যাজার্ড’। ছুটিতে গিয়েও ধান ভানতে হয়। ফেলুদার বহু আগে ব্যোমকেশ বক্সী সত্যবতী আর অজিতকে নিয়ে হাওয়াবদলের জন্য পশ্চিমে গিয়েছিলেন, তারপর ‘চিত্রচোর’-এর কেস ঘাঁটতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ছোটবেলায় ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বড় হয়ে তাই আমার আর গোয়েন্দা হওয়া হল না। ওরা ছুটি উপভোগ করতে জানে না যে!
সত্যজিৎ রায়কে দিয়ে এই লেখার শুরু। কারণ বাঙালির ‘ছুটি’ ধারণাটায় তাঁর মতো এত হরেক ‘প্রিজ্ম’-এর আলো ফেলে আর কেউ দেখেনি। রোজকার দশটা-পাঁচটার জীবনে আমরা যে ছকবাঁধা মানুষ, ছুটিতে গেলেই সেটা বদলে যায়। তখন ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে বেকার যুবকও দাপুটে রায়সাহেবের মুখের ওপর সটান বলে দিতে পারে, তার চাকরি চাই না। বড়লোকের মেয়ে মনীষা (প্রেসিডেন্সির ইংরেজি অনার্স) বাবার পছন্দসই পাত্রকে বাতিল করে বেকার যুবককে আমন্ত্রণ জানাতে পারে, ‘কলকাতায় আমাদের বাড়িতে আসবেন কিন্তু।’ এই যে বদলে-যাওয়া ব্যক্তিত্ব, এটি ছুটিতেই সম্ভব। রোজকার থোড়-বড়ি-খাড়া জীবনে নয়। ছুটি তো শুধু ছুটি নয়! তখন যে কোনও অভিঘাতে ব্যক্তি মানুষের মধ্যে ‘সামাজিক চেতনা’ জেগে উঠতে পারে। যাবতীয় মজা, হুল্লোড়, ‘মেমরি গেম’ পেরিয়ে শর্মিলা ঠাকুর হঠাৎ সৌমিত্রকে বাংলোর দারোয়ানের ভাঙা ঘরের সামনে এনে প্রশ্ন করতে পারেন, ‘এত অসুখ, জানতেন?’ ‘সীমাবদ্ধ’র টুটুল দিদির বাড়িতে ছুটি কাটাতে এসেই জানতে পেরেছিল, একটা কলকাতার মধ্যে দুটো আলাদা শহর আষ্টেপৃষ্ঠে লেপ্টে আছে। একটা শহরে ক্লাব, রেসকোর্স, বহুতল বাড়ির কেতাদুরস্ত জীবন। অন্যটায় বোমার গর্জন, দেওয়ালে স্লোগান ‘চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান।’ মনীষা থেকে টুটুল সকলে বদলে যায়... এখানেই ছুটির বিপদ!
বিপদ আরও আছে। কেউ কথা শোনে না। গাড়োয়ালের পাহাড় থেকে ভারত মহাসাগরের তীরে সর্বত্র এক দৃশ্য। ট্রাভেল এজেন্টের দৌলতে কুড়িটি বাঙালি পরিবার একত্রে। রাতে কেউ ঝিমঝিম আড্ডায়,কেউ বা ম্যানেজারের ঘরের সামনে চিৎকার করছেন, ‘কাল সকালে যেন লুচি আর বেগুনভাজা হয়,’ কেউ আবার সেই চিৎকার ছাপিয়ে মোবাইলে ফুল ভলিউমে গান চালিয়ে দিয়েছেন, ‘গভীরে যাও, আরও গভীরে যাও।’ ছুটি মানে, কাউকে পাত্তা না দিয়ে মনের আনন্দে নিজের কথা বলে যাওয়া। ১৯২৯ সালে কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ভাদুড়িমশাই’ নামে এক উপন্যাস লিখেছিলেন। সেই উপন্যাসে কলকাতার বাবুরা পুজোয় বেড়াতে গিয়েছেন। তার পর? ‘“কথার মাথামুণ্ডু নেই, সবই ছিন্নমস্তা, কারণ একের মুখ থেকে অন্যে ছোঁ মেরে নিচ্ছে। একজন বললেন, “ফেল্পস ছাড়া কারও কাট আমি ব্যবহার করি না। এই হোমস্পান (বিলেতে বোনা) উইন্ডসার গাল্ফ।” তাঁর শ্রোতাকে টেনে অপর এক জন নিজের হাতটা এগিয়ে আংটি দেখিয়ে বলছেন, “ব্যাটারা বলে স্বদেশী স্বদেশী! হ্যামিল্টন ছাড়া এ রকম পালিস কেউ করে দিক না দেখি।”’
ছুটিতে কোথায় যাব, সেটা ঠিক করাও বিপত্তি। যাদবপুরে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে আমাদের মাস্টারমশায় শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ছেলেবেলার অভিজ্ঞতা শুনিয়েছিলেন। ছুটির আগে বাড়িসুদ্ধু সকলে ভারতের মানচিত্রের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়তেন। এ বার কোথায় যাওয়া হবে? কেউ বলতেন, কাশ্মীর। অন্য জন সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে কাটান দিতেন, ‘দুর! ওর চেয়ে মহীশূর, উটি অনেক ভাল জায়গা।’ তিন দিন বাদে আর এক জন দুটি প্রকল্পই উড়িয়ে দিতেন, “আরে, ওয়াল্টেয়ারের মতো জায়গা আছে নাকি?” প্রায় চার-পাঁচ বছর ধরে এই ভাবনাচিন্তার নিরসন ঘটত এক বিশেষ বিন্দুতে এসে, “তা হলে মধুপুরে যাওয়া হোক। ওটাই সবচেয়ে ভাল জায়গা।” কে না জানে, এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ আজও জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। ভ্রমণসংক্রান্ত পত্রিকা, ইন্টারনেট ঘাঁটা, মেকমাইট্রিপে লগ ইন... কম হ্যাপা পোয়াতে হয় নাকি?
ঠিকঠাক ছুটি কাটানো ভাগ্যের ব্যাপার। বছর বারো আগে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে কাঠমান্ডু গিয়েছি। দুপুরে হোটেল থেকে বেরিয়ে পাটানের দিকে যাচ্ছি, রাস্তায় রাগী মুখের জটলা। সর্বত্র দোকানের শাটার নেমে আসছে, কোথাও মিছিল, কোথাও বা টায়ার পুড়ছে, কোথাও বা রড এবং বাঁশ হাতে লোকজন। হৃতিক রোশন নাকি নেপালিদের সম্বন্ধে কী একটা বাজে কথা বলেছেন, লোকে ভারতীয় দেখলেই পেটাচ্ছে। ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে সটান হোটেল, সন্ধ্যা থেকে লাগাতার কারফিউ। সাংবাদিকের বদভ্যাস যাবে কোথায়? ফিরেই অফিসে ফোন। ততক্ষণে নিউজ এজেন্সি ও টিভি মারফত ঘটনাটা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। দুঃখের কথা কী আর বলব! আমার ছুটি বানচাল হওয়া নিয়ে তখন কলকাতায় কেউ ভাবিত নয়। উল্টে খুব খুশি, ‘কপি পাঠাচ্ছিস তো?’ অগত্যা দিনের বেলায় বিভিন্ন জায়গায় ফোন করি, খবর লিখি, রাতে হোটেলের এক বেয়ারার হাতে লেখা কাগজগুলি কলকাতায় ফ্যাক্স করার জন্য ধরিয়ে দিই। তিন দিন বাদে রাজা বীরেন্দ্রর জন্মদিনে কারফিউ তুলে নেওয়া হল, উড়ানে টিকিট নেই, সঙ্গে সঙ্গে বাসস্ট্যান্ডে ছুট। সারা রাত জার্নি করে শিলিগুড়ি সীমান্তে এসে নিশ্চিন্ত। ওফ, পাড়ায় এসে গিয়েছি!
ছবি: দেবাশীষ দেব
এই সব অভিজ্ঞতা থেকে জানি, অফিস বড় বাজে জায়গা! ছুটি নিতে গেলে ক্যাজুয়াল, আর্নড লিভ ইত্যাদি হিসাব করতে হয়, ওপরওয়ালাকে দিয়ে কাঁচুমাচু মুখে ছুটি স্যাংশন করাতে হয়। এ রকম সময়ে উনিশ শতকের ব্রিটিশ লেখক জেরোম কে জেরোম-এর ‘থ্রি মেন ইন আ বোট’ মনে পড়ে। তিন বন্ধু পাহাড়ে না জঙ্গলে যাবে, নানা কথা ভেবেছে। তার পর ঠিক হয়েছে, মন্টমোরেন্সি নামে এক কুকুরকে নিয়ে টেম্স বেয়ে তারা কিংসটন থেকে অক্সফোর্ড অবধি নৌ-সফরে যাবে। তিন বন্ধুর এক জন ব্যাঙ্কে কাজ করে। রোজ সকাল থেকে বিকেল চারটে অবধি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ক্লান্ত। কে না জানে, এ হেন হাড়ভাঙা খাটুনি থেকে কয়েক দিন বাঁচতে ছুটি নেওয়াই সেরা পন্থা!
সমরেশ বসু কোনও দিন চাকরি করেননি, কিন্তু ছুটি স্যাংশনের ঝামেলাটা চমৎকার জানতেন। তাঁর ‘ছুটির ফাঁদে’ উপন্যাস নিয়ে এক সময় হিট ছবিও হয়েছিল। ডাকসাইটে ওপরওয়ালা ‘পিকভোট’ উৎপল দত্ত অধস্তন কর্মচারী সৌমিত্রকে ছুটি দেবেন না। ফলে সৌমিত্র ছুটি না নিয়ে লুকিয়ে স্ত্রী অপর্ণা সেনকে নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। আর যেখানে পিকভোটের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। অপর্ণা স্বামীর পরিচয় জানাতে পারছেন না, সৌমিত্র লুকিয়ে লুকিয়ে থাকছেন এবং উৎপল অপর্ণার প্রেমে পড়ে যাচ্ছেন।
ছুটির সবচেয়ে বড় বিপদ অন্যত্র। কোত্থাও কিছু ঘটে না। অল্প বয়সে জানতাম, ছুটিতে অনেক কিছু ঘটে। হাওয়া-বদলে গিয়েই সুরেশ ‘গৃহদাহ’র ক্লাইম্যাক্স ঘটিয়ে দেয়, বন্ধু মহিমের বউ অচলাকে ইলোপ করে। প্রতিবেশী কিশোরী মেয়েটিকে সাইকেলে চাপিয়ে শালবনের রাস্তায় নিয়ে গেলে ‘যে যেখানে দাঁড়িয়ে’ হয়ে যাবে। ‘অসময়’-এ বন্ধুর বাড়িতে গেলেই অবিন হয়ে যাব, বন্ধুর দিদি মোহিনীকে আবিষ্কার করব। নিদেনপক্ষে এক বার দিকশূন্যপুর চলে গেলেই বন্দনাদির সঙ্গে দেখা হয়ে যাবেই। বয়স বাড়লেও কামনার শেষ হয় না। মনে হয়, ছুটিতে কোনও সমুদ্রের ধারে বেড়াতে যেতেই পারে সে, আমার ‘বিকেলে ভোরের ফুল’।
এগুলি কিচ্ছু হয় না। উল্টে ছুটি ফুরিয়ে যায়, আবার সেই থোড়-বড়ি-খাড়া জীবন। ছুটি চিরকাল রোমান্সে থাকতে দেয় না, টান মেরে ফের বাস্তবের মরুভূমিতে ফিরিয়ে দেয়, এটাই সবচেয়ে বড় বিপদ!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.