|
|
|
|
|
|
প্রতি পক্ষ
|
নগরের ইতিকথা |
নগরীর সঙ্গে নাগরিকের সমীকরণ আর অ-সমীকরণকে
বিচিত্র বিভঙ্গে হাজির করেন শিল্পীরা। লিখছেন শোভন তরফদার |
মুম্বই সে আয়া মেরা দোস্ত, আমরা শুনেছি।
এঁরা বলছেন, ‘নভি মুম্বই’!
‘গুগল’ করলে দেখবেন, এই স্থানখণ্ডের জন্ম ১৯৭২, আদতে মুম্বইয়ের দোসর, ৩৪৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম পরিকল্পিত মহানগরী, ভাসি আর আয়রোলি সেতুর মাধ্যমে মূল মুম্বইয়ের সঙ্গে যুক্ত।
কিন্তু, এ সবই ছেঁড়া ছেঁড়া তথ্য। এই ভরা গ্রীষ্মের শহরে নভি মুম্বই থেকে উড়ে এল কিছু ‘দৃশ্য’!
আসলে, দৃশ্য বস্তু! ‘ইমেজ’! একের পরে এক কাজে চোখের সামনে পরতে পরতে খুলে যাচ্ছে রুদ্ধশ্বাস মহানগর।
‘সিমা’ গ্যালারির সাম্প্রতিক নিবেদন ‘পঞ্চ সেনা: আর্ট ফ্রম নভি মুম্বই’!
সঞ্জীব সোনপিমপেয়ার, রাউল হেমন্ত, সন্তোষ মোরে, তুষার পোতদার এবং পণ্ডিত ভিলা খয়েরনার।
রাউল ওড়িশার ছেলে, কর্মসূত্রে মহারাষ্ট্রে। বাকিরা কেউই নভি মুম্বইয়ের আদি বাসিন্দা নন। কিন্তু, এঁরা সকলেই জুড়ে আছেন ওই ভূখণ্ডের সঙ্গে।
কী ভাবে? গ্রহণ, না বর্জন? স্বীকার না প্রত্যাখ্যান?
মজা এই যে এই ধরনের কিছু চেনা ছকে নাগরিকের ভিতরে নগর, বা নগরীর মানচিত্রে নাগরিককে আর ধরা যাবে না।
সন্তোষ মোরে ফাইবার গ্লাসে বানিয়েছেন একটি বিখ্যাত, অতি গভীর, সিঁড়ির ধাপ-কাটা কুয়োর প্রতিরূপ। একেবারে মূল বস্তুটির মাপের নিখুঁত অনুপাত অনুযায়ী বানানো। কুয়োর গভীরে শোয়ানো আছে ভবিষ্যতের একটি বিচিত্র, ঝকঝকে নগরীর ছবি। কাজের নাম ‘প্রহিবিটেড টু’!
দেখতে গিয়ে মনে পড়বেই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কিংবদন্তি চরণ, ‘অনন্ত কুয়ার জলে চাঁদ শুয়ে আছে’!
এ কেমন চন্দ্রমা যা ধরা দেয় একটি ফিউচারিস্টিক মহানগরীর অবয়বে?
যা আমাদের হাতছানি দেয় অবিরাম, অথচ নিজে থেকে যায় নাগালের বাইরে, সর্বক্ষণ! অনেক উঁচু থেকে কুয়োর গভীরে তাকালে হঠাৎ যেমন বুকের ভিতরটা খালি হয়ে যায়, চকিতে ভেসে ওঠে নিষিদ্ধ হাতছানি, এখানেও তাই। শুধু, জলের জায়গায় আছে একটি কল্পনগরী!
আসলে সেই নগরী কোথায় আছে? জলের শরীরে ছায়া এসে পড়ে, আমরা জানি। তা হলে সন্তোষের বানানো সেই কুয়োর ভিতরেও কি আসলে ছায়া?
কার ছায়া? |
|
ছবিতে (বাঁ থেকে ডান দিকে) তুষার পোতদার, রাউল হেমন্ত,
সন্তোষ মোরে, সঞ্জীব সোনপিমপেয়ার এবং পণ্ডিত ভিলা খয়েরনার। |
কেন? যে উঁচু থেকে দেখছে, তার।
তা হলে, আমার ছায়াই কি আজ ওই মহানগরীর আকার নিয়েছে? কারণ, আমিই তো দর্শক। দেখব বলে উঁকি দিয়েছি জলের গভীরে?
নাকি, নিজেরই গভীরে?
এই ভাবে, নগরীর সঙ্গে নাগরিকের সমীকরণ আর অ-সমীকরণকে বিচিত্র বিভঙ্গে হাজির করেন শিল্পীরা।
এখানে চালের দানা, রজন, গম ইত্যাদি মিশিয়ে সঞ্জীব রোমান হরফে কিছু শব্দ লিখে দেন চিত্রপটের গায়ে। রেশন কার্ড প্যান কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্স ভোটার আই ডি পাসপোর্ট ফোটো... এমন আরও কত!
নাগরিকের অভিজ্ঞান!
এখানে রাউল হেমন্ত-র কাজে রং-ওঠা করোগেটেড সিট-এর গায়ে ছেঁড়া পোস্টার, আর তারই ওপরে ভেসে থাকে কঙ্কালের শরীর সংস্থান।
নাগরিকের শরীর!
এখানে তুষার আঁকেন ক্যানভাসের একেবারে মাঝখানে একটি মুখ, আর উপর, নীচ, ডান এবং বাঁ দিক থেকে চারটি উদ্যত তর্জনী সেই মুখচ্ছবিকে যেন বিদ্ধ করতে চায়।
নাগরিকের বদ্ধতা।
এখানে পণ্ডিত ভিলা খয়েরনার-এর অঙ্কিত চিত্রপটের মধ্যে কিছু নেই, অর্থাৎ কোনও চেনা আদল নেই, শুধু কিছু রং পাশাপাশি আছে, আলতো ভাবে, গোধূলির আকাশের মতো মিলে গিয়েছে একে অন্যের শরীরে।
নাগরিকের মুক্তি।
প্রশ্ন এই যে, সেই মুক্তি কোথায়? সেই বদ্ধতার স্থানাঙ্কই বা কী?
পাঁচ শিল্পীর সঙ্গে আলাপে উঠে এল নানা রকম ভাবনার টুকরো। কী ভাবে সময়ের সঙ্গে, সমকালের সঙ্গে, যে যাঁর নিজের স্থানের সঙ্গে চলে তাঁদের দেওয়া-নেওয়া! কী ভাবে অধুনা এই ব্র্যান্ড-শাসিত সভ্যতায় নিজের স্থানটি খুঁজে নেন, খুঁজে নিতে চান এঁরা।
একমুঠো লেখায় সেই দীর্ঘ সেই আলাপের বিস্তার পেশ করা অসম্ভব, তবু তার সারাংশটুকু এই যে, মহানগরী যতটা পার্থিব ভূগোল, ততটাই নিজস্ব মনোভূমিও বটে! ফলে, যিনি দেখছেন এই মহানগরী নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন একটি পরিসর, তিনিই আবার তাকে ছেড়ে যেতে পারছেন না, রুজির টানে, ফলে তার সঙ্গে গড়ে নিতেই হচ্ছে এক ধরনের যোগাযোগ। এই ভাবে নিজের ভিতরেই তৈরি হয়ে যাচ্ছে একাধিক টুকরো। ‘আত্মবিচ্ছেদ’ বললে হয়তো সঙ্গত হবে না, কারণ যাকে ‘আত্ম’, ইংরেজি পরিভাষায় ‘সেলফ’ বলা হয়, নগরীর ভিতরে তার নির্মাণ আর সৃষ্টির গড়নটাই বদলে গিয়েছে ঢের! এখানে বাতাস চিনাবাদামের মতো বিশুষ্ক। এখানে মুখ ঢেকে দেয় বিজ্ঞাপন। অথচ, সেই বাতাসই নাগরিকের ফুসফুসে প্রাণ সঞ্চার করে। সেই বিজ্ঞাপনের মধ্যেই হাতছানি দেয় মুক্তি!
কী ভাবে, তার এক-একটি আদল প্রতিটি নাগরিকের মনের মধ্যে হাজির। নভি মুম্বই থেকে এসেছে সেই প্রশ্নের আরও কিছু উত্তর।
দৃশ্য-ভাষায়।
পাঁচ শুনলেই পঞ্চেন্দ্রিয়, পঞ্চামৃত, পঞ্চপাণ্ডব ইত্যাকার নানাবিধ পাঁচালি মনে পড়তেই পারে, কিন্তু ভরা গ্রীষ্মের মহানগরে হাজির ‘পঞ্চ সেনা’।
এই পর্যন্ত সত্য, কিন্তু শেষ সত্য নয়।
ক্যাটালগ দেখাচ্ছে, ‘পঞ্চ’ শব্দটির বানানে পাশাপাশি ‘পি-ইউ-এন-সি-এইচ’!
তা হলে কি ‘পাঞ্চ’?
নির্ঘাত!
শহরের মুখের উপর একটি আঘাত!
সেই আঘাতে বিক্ষত হতে হতে, এই কবিপক্ষে, আমরা আরও এক বার নিজের দিকে তাকাই! নিজের শহরের দিকে তাকাই।
আপনি আমার কোনখানে, বেড়াই তারি সন্ধানে... |
|
|
|
|
|