চির রোম্যান্টিক। চির প্রতিবাদী। চির বাউন্ডুলে। এক অনন্ত প্রতিভাধর মানুষ। যাঁর জীবনটা যতটা সৃষ্টিতে উদ্ভাসিত, ততটাই গভীর দুঃখে জর্জরিত।
বাঙালি তাঁকে নিয়ে এখনও মেতে উঠতে পারে যে কোনও আড্ডায়। কারও কাছে তিনি জিনিয়াস। কারও কাছে তিনি সেই হাউইয়ের মতো প্রতিভা যিনি নিজের সৃষ্টির আগুনে পুড়ে, নিজেই শেষ হয়ে গেলেন। তাঁর জীবনের পরতে পরতে যে জমে আছে এমন সব ঘটনা যা নিয়ে মানুষের কৌতূহলের অন্ত নেই।
ঋত্বিক ঘটক।
তাঁর সেই প্রবাদপ্রতিম জীবনের ছায়াতেই এবার তৈরি হচ্ছে সম্পূর্ণ একটা বাংলা ছবি। ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের প্রযোজনায় সে ছবি পরিচালনা করছেন কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। এখনও ছবির নামকরণ হয়নি। তবে ঋত্বিকের চরিত্রে অভিনয় করছেন বব বিশ্বাস - অর্থাৎ শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় । ৩ জুন থেকে ছবির শুটিং শুরু। প্রথম দিনের শুটিং পুরুলিয়ায়।
ছবিতে থাকবে সত্যজিৎ রায় থেকে হেমাঙ্গ বিশ্বাস, শম্ভু মিত্র থেকে সমরেশ বসু, অনিল চট্টোপাধ্যায় থেকে উৎপল দত্তর মতো বিশিষ্ট মানুষজনের প্রসঙ্গ। “হ্যাঁ, এটা ঠিক এই সব কিংবদন্তি মানুষজনের কথা বা আদল থাকবে আমার ছবির নানা জায়গায়। কিন্তু কোনও চরিত্রকে সরাসরি আঙুল তুলে দেখিয়ে বোঝানো যাবে না তিনি কোন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। কিছু কিছু মানুষের প্রসঙ্গ আসবে শুধুই কথার মাধ্যমে। যেমন ধরুন সত্যজিৎ রায়.... সেই চরিত্রে কোনও অভিনেতা অভিনয় করবেন না,” বলছেন পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়।
এ বছর পুজোতেই মুক্তি পাবে এই ছবি। “ছবি করিয়ে হিসেবে তিনি এমনই একজন মানুষ যাঁর জীবন অসম্ভব টানাপোড়েন আর উত্তেজনায় ভরা। এক দিকে তিনি যেমন বিশ্ব সেরা ছবি বানিয়েছেন অন্য দিকে কৌতূহল জাগিয়েছে তাঁর মনের গতিপ্রকৃতি। শেষ জীবনে উনি শারীরিক ও মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এমনকী অ্যালকোহলজিমের শিকার হন। শেষমেশ তাঁকে মানসিক হাসপাতালেও পাঠানো হয়।
ওখানে থাকাকালীন তাঁকে শক থেরাপিও দেওয়া হয়। সেই সময় তিনি পালমোনারি টিবি রোগে ভুগছেন। সেই মানসিক হাসপাতাল থেকেই এ ছবির গল্প শুরু হচ্ছে,” বলছেন পরিচালক কমলেশ্বর।
গত দু’বছর ধরে তিনি ঋত্বিক ঘটকের জীবন নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন।
কমলেশ্বর বলে চলেন, “অনেকেই হয়তো জানেন না যে ঋত্বিক মানসিক হাসপাতালে বসেও নাটক লিখেছেন। এবং সেই মানসিক হাসপাতালের সঙ্গীদের দিয়ে তিনি অভিনয়ও করিয়েছেন। সে সময়ে ওঁর কিন্তু ছ’টা ছবি করা হয়ে গিয়েছিল। এর পরও তিনি দু’টো ছবি করেন। সেটাই আমার এই ছবির শুরুর জায়গা। সেখান থেকে চিত্রনাট্য কখনও এগিয়েছে, কখনও ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গেছে।”
ঋত্বিক ঘটকের জীবনের ছায়ায় তৈরি ছবি। অবশ্য প্রযোজক শ্রীকান্ত মোহতা বলছেন এ ছবিকে পুরোপুরি জীবনীমূলক ছবি বলা যাবে না কিছুতেই। |
“অনেকেই মণি রত্নমের ‘গুরু’ দেখেছেন এবং জানেন যে কার জীবন নিয়ে এ ছবি তৈরি হয়েছে। তেমনটাই ঘটছে এই ছবির ক্ষেত্রেও। আমরা ঋত্বিক ঘটকের ‘স্পিরিট’টাকে ধরার চেষ্টা করেছি। সেটাই আসল। সেই কারণেই শাশ্বতকে নেওয়া হচ্ছে, যাতে গল্পের চরিত্রের সঙ্গে আসল মানুষটির শারীরিক গঠন বা চেহারার হুবহু মিল না থাকে,” বলছেন
শ্রীকান্ত মোহতা।
ঋত্বিক চরিত্রের রূপকার শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় কী বলছেন? অনেকে ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করেছেন সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার এ ছবি থেকেই তাঁর গল্ফ গ্রিনের পাঁচ তলার ফ্ল্যাটে ঢুকবে। “আমার কেরিয়ারের অন্যতম চ্যালেঞ্জিং রোলে কাজ করতে চলেছি। এমন একজন মানুষের চরিত্রে অভিনয় করা অত্যন্ত সম্মানের। ছবি করার আগে ওঁর মনের গভীর জায়গাগুলোকে জানার জন্য পড়াশোনাও চলছে পুরোদমে। এই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য একটা বিশেষ বডি-ল্যাঙ্গোয়েজও তৈরি করছি। ওজনও কমাচ্ছি,” বলছেন সেই শাশ্বত, এই ছবিতে যাঁর নাম নীলকণ্ঠ। তাঁর স্ত্রীর নাম দুর্গা। অনন্যা চট্টোপাধ্যায় তাঁর স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করছেন। কেন এই দুটি নাম? কেন নীলকণ্ঠ আর দুর্গা? “নীলকণ্ঠ নামটার মধ্যে এমনিই একটা ট্র্যাজিক ব্যাপার আছে। আর একটা কারণ। ‘যুক্তি তক্ক গপ্পো’ ছবিতে মুখ্য চরিত্রের নাম নীলকণ্ঠ আর দুর্গা,’’ বলছেন কমলেশ্বর।
ছবির গল্প শুরু যে মানসিক হাসপাতাল থেকে, সেই হাসপাতালের ডাক্তারের ভূমিকায় রয়েছেন আবির চট্টোপাধ্যায়। এবং এই চরিত্র নিয়ে তিনি দারুণ উত্তেজিত। “এ রকম কাজ খুব একটা হয়নি। অসম্ভব ইন্টারেস্টিং একটা স্ক্রিপ্ট। তাই পুরো ছবিটাকেই আমাদের খুব ডেলিকেট ভাবে হ্যান্ডেল করতে হবে। টালিগঞ্জের এই সুদিনে এমন একটা ছবি বাংলা সিনেমাকেই অন্য মাত্রা দেবে,” বলছেন আবির।
একই বক্তব্য অনন্যা চট্টোপাধ্যায়েরও। “হ্যাঁ, আমি ঋত্বিক ঘটকের স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করছি। আমি কিন্তু সুরমা ঘটকের সঙ্গে শুটিংয়ের আগে দেখা করতে চেয়েছিলাম। কমলেশ্বরদা’র সঙ্গে সে রকম কথাও হয়েছিল। কিন্তু উনি অসুস্থ, তাই দেখা করতে পারছি না। তবে এখনও শুটিং শুরু হতে কিছু দিন দেরি আছে। একটা শেষ চেষ্টা করব। আর এই মুহূর্তে আমি আর পরিচালক ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে ভাবছি না। আমি ভাবছি মানুষটার কথা, তাঁর চরিত্রের নানা দিকের কথা। যেটা আমাকে ওঁর স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করতে সাহায্য করবে,” বলছেন অনন্যা। |
এ ছবিতে শোভা সেনের আদলে তৈরি একটা চরিত্রও আছে। তাতে অভিনয় করছেন বিদীপ্তা চক্রবর্তী। “হ্যাঁ, শুনেছি আমার চরিত্রটা শোভা সেনের আদলে,” বলছেন বিদীপ্তা। “এ রকম একজনকে নিয়ে ছবি হচ্ছে। সেই ছবিতে আমি একটা চরিত্রে
অভিনয় করছি। নিজেকে সম্মানিত মনে হচ্ছে।”
ক্যামেরায় থাকছেন সৌমিক হালদার। শিল্পনির্দেশনায় তন্ময় চক্রবর্তী। সংগীত পরিচালনায় দেবজ্যোতি মিশ্র। ছবির ‘লুক’ কেমন হবে সে সম্পর্কে প্রযোজক এই মুহূর্তে মুখ খুলতে চাইছেন না। “ছবির প্রেক্ষাপটটা বিরাট হবে, এটুকু বলতে পারি। ছবিটি দেখতে কেমন হবে তা ক্রমশ প্রকাশ্য। এখনই কিছু জানাতে চাইছি না,” শ্রীকান্তের বক্তব্য।
চমকের এখানেই শেষ নয়। শোনা যাচ্ছে এ ছবিতে অনিল চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্রের আদলে তৈরি চরিত্রে অভিনয় করছেন রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়। রাহুল কী বলছেন? “দুর্দান্ত চিত্রনাট্য। আর অনিল চট্টোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীর আদলে তৈরি চরিত্রে অভিনয় করতে চলেছি ভেবেই দারুণ ভাল লাগছে। শিশুশিল্পী হিসেবে আমি প্রথমবার পুরস্কার নিয়েছিলাম ওঁর হাত থেকেই,” বলছেন তিনি।
প্রশ্ন একটাই। প্রযোজক পরিচালকেরা কি ঘটক পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন? ঋত্বিক ঘটকের স্ত্রী সুরমা ঘটক এখনও জীবিত। সিল্ক স্মিতার জীবন নিয়ে ‘ডার্টি পিকচার’ করার সময় একতা কপূরকে যে ধরনের বিপত্তির মুখোমুখি হতে হয়েছিল তেমন কোনও পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়।
“আমরা ঋত্বিক ঘটকের পরিবারের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছি। সুরমা ঘটকের কাছ থেকে লিখিত অনুমতি পেতেও চাই। কিন্তু তাঁর শরীর একদম ভাল নেই। শারীরিক অবস্থার উন্নতি হলেই তাঁর সঙ্গে
নিশ্চয়ই কথা বলব,” জানাচ্ছেন কমলেশ্বর।
|