|
|
|
|
পেশাদারি ছোঁয়ায় সাফল্য-মেলার পথে বর্ষপূর্তির সরকার |
‘প্রগতি’র প্রচারে নগরে রাজসূয় |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
পরিবর্তনের এক বছরে সরকারের ‘সাফল্য’-কে তুলে ধরতে সর্বাত্মক প্রচারের পথে নামছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর ‘সাফল্যের’ এই প্রচারযজ্ঞে কোন দফতর কতটা এগিয়ে থাকল, কাল শনিবার থেকে তার ‘পরীক্ষা’ শুরু হবে। বিচারকের আসনে থাকবেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই।
প্রায় সব ক্ষেত্রে ঢালাও প্রতিশ্রুতি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে এক বছর আগে। মুখ্যমন্ত্রীর উপলব্ধি, এই সময়ের মধ্যে তাঁর সরকার প্রতিশ্রুতির ৯০% কাজ করে ফেলেছে। বর্ষপূর্তির তিন দিন আগে রাজ্য মন্ত্রিসভার শেষ বৈঠকেও তাঁর প্রশংসা কুড়িয়েছে প্রায় সব দফতর। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন সাফল্যের ছবিটাকে সুসংহত করে ব্যাপক ভাবে প্রচারের আকারে নিয়ে যেতে।
সেই রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন প্রায় সারা। কাল শুরু হয়ে যাচ্ছে আট দিনের ওই প্রচারাভিযান। প্রাথমিক হিসেবে যার পিছনে খরচ সব মিলিয়ে ২০ কোটি টাকার কম নয়।
এবং মেলা-বই-সিডি-ভিডিও-হোর্ডিং মারফত ‘মা-মাটি-মানুষের’ সরকারের জয়গাথা সংবলিত প্রচারকে পেশাদারি ছোঁয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মহানগরের প্রান্তে প্রান্তে। বাইপাসের ধারে মিলনমেলা প্রাঙ্গণ, নগরকেন্দ্রের রবীন্দ্রসদন ও ধর্মতলায় মেট্রো চ্যানেল তিন জায়গায় সরকারের ৬০টি দফতর ‘সাফল্যের’ পসরা সাজিয়ে বসবে। ‘উন্নয়ন’-এর বার্তা দিতে স্টলে স্টলে থাকবে সরকারের এক বছরের কাজের খতিয়ান। পরিবর্তনের এক বছরে সরকারি পৌরহিত্যে আয়োজিত মেলার নাম ‘প্রগতি উৎসব।’ ‘নতুন সরকার নতুন প্রয়াস’ নামে সিডি-ও তৈরি। মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধে কাল বিকেলে মিলনমেলায় বর্ষপূর্তির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনও হাজির থাকবেন বলে সরকারি সূত্রে জানা গিয়েছে। |
|
মিলনমেলায় প্রস্তুতি। বৃহস্পতিবার। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক |
এক বছরের সরকারের কাছ থেকে রাজ্যবাসী কী পেল?
এর আগে নতুন সরকারের ১০০ দিন ও ২৪০ দিনের মাথায় কাজের খতিয়ান দিয়ে দু’টি বই প্রকাশ করে তার উত্তর দেওয়া হয়েছিল। সংখ্যাতত্ত্বের ঠাসবুনোন ও ঝকঝকে ছাপায় ফের নতুন বই আত্মপ্রকাশ করছে বর্ষপূর্তির মঞ্চে, যার পোশাকি নাম রাখা হয়েছে ‘প্রতিশ্রুতি ও প্রাপ্তি।’ রাজ্য প্রশাসনের ইচ্ছা, বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসা মমতা সরকারের সাফল্যের কাহিনি দেশে-বিদেশে বাঙালি-অবাঙালি বাড়ির বৈঠকখানায় পৌঁছে যাক। থাকছে বিজ্ঞাপন। আগামী ক’দিন সংবাদপত্রের পাতায়, টিভি’র পর্দায় যা দেখা যাবে। মমতা সরকারের সাফল্যকে তুলে ধরতে কলকাতা-সহ বিভিন্ন পুরসভাও এগিয়ে এসেছে। তাদের দেওয়া হোর্ডিংয়ে মুখ ঢেকেছে অনেক রাস্তা।
বৃহস্পতিবার মিলনমেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা গেল, উৎসবের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে জোরকদমে। লালবাতি লাগানো গাড়িতে একের পর এক সরকারি কর্তা এসে স্টল সাজানোর পর্ব দেখে যাচ্ছেন। প্রায় সওয়া লক্ষ বর্গফুট এলাকা জুড়ে বহু বর্ণের, নানা আকারের কাঠামো মাথা তুলেছে। মূল অনুষ্ঠানকেন্দ্রটি ২০ হাজার বর্গফুটের (মিলনমেলার সবচেয়ে বড় হ্যাঙ্গার), সেখানে ইস্পাতের কাঠামোয় সাজছে মঞ্চ। ‘হ্যাঙ্গার’টি হবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। মিলনমেলায় মোট ২৩টি ‘হ্যাঙ্গার’ রয়েছে। স্টল বসাতে সবগুলোই কাজে লাগানো হবে। সবুজ গালিচা আর নীল-সাদা কাপড়ে সেজে উঠেছে স্টলগুলো। পড়ছে রংয়ের প্রলেপ। চারটে হলেও কয়েকটি দফতরের স্টল থাকছে।
আয়োজন দ্রুত শেষ করতে ঠিকাদার সংস্থার হাজার দেড়েক কর্মী দিন-রাত কাজ করে চলেছেন। তাঁদের খাওয়া-দাওয়ার বন্দোবস্ত হয়েছে এখানেই। তিনটে তাঁবুতে রান্নাবান্না চলছে। এবং প্রশ্ন উঠেছে, মিলনমেলা প্রাঙ্গণে এ ভাবে উনুন জ্বালিয়ে রান্না করা যায় কি না। বস্তুত এই প্রশ্নে মেলা প্রাঙ্গণের নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে বিরোধও বাধছে ঠিকাদার সংস্থার। রবীন্দ্রসদন ও মেট্রো চ্যানেলেও মেলার প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে।
টেন্ডারের মাধ্যমে মিলনমেলায় মূল কাজের বরাত পেয়েছে দিল্লির এক বেসরকারি সংস্থা। টেন্ডারে অংশগ্রহণের জন্য দু’কোটি টাকা অগ্রিম জমা দিতে বলা হয়েছিল। তেমন সামর্থ্য না-থাকায় কলকাতার অনেক সংস্থাই টেন্ডারে সামিল হয়নি। দিল্লির সংস্থাটির এমডি জিতেন্দ্র কপূর জানান, মূল অনুষ্ঠানমঞ্চ ছাড়াও তাঁরা স্টলগুলোর ‘সুপার স্ট্রাকচার’ বানাচ্ছেন। সেই সঙ্গে ফ্লেক্সের ৫০টি হোর্ডিং, মেলা প্রাঙ্গণের বাইরের অংশের যাবতীয় আলোর ব্যবস্থা। “মাত্র সাত দিনে এত বড় কাজ শেষ করে এনেছি!” বলছেন তিনি।
জিতেন্দ্রদের সংস্থাকে দিয়েই বিভিন্ন দফতর নিজেদের স্টলের কাঠামো তৈরি করাচ্ছে। স্টলের কাজে অবশ্য অন্যান্য ঠিকাদার সংস্থাও হাত লাগিয়েছে। স্টলের আয়তন কারও পাঁচশো, কারও পাঁচ হাজার বর্গফুট। তাতে কী থাকবে?
সরকারি সূত্রের খবর: এক-একটা দফতর নিজেদের বিষয় নিয়ে স্টল সাজাবে। যেমন শিল্প দফতরের স্টলে থাকবে রাজ্যে ৮০ হাজার কোটি টাকা লগ্নির প্রস্তাব সংক্রান্ত নথি, বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সম্পাদিত ‘লিজ চুক্তি’-র তালিকা, নতুন জমানায় উৎপাদন শুরু করা কয়েকটি শিল্প-প্রকল্পের তথ্যাদি। ভূমির স্টলের মূল প্রতিপাদ্য জমি ব্যাঙ্কের সর্বশেষ পরিসংখ্যান, খনিজ উত্তোলন থেকে রাজস্ব আদায়ের হিসেব। মেট্রো চ্যানেলে যুব দফতরের স্টলে বিবেকমেলা, ছাত্র-যুব উৎসবের ছবির প্রদর্শনী-সহ নানাবিধ কাজের ফিরিস্তি। ক্রীড়া দফতরের প্রদর্শনীতে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে জঙ্গলমহলে বিভিন্ন খেলাধুলোর কর্মসূচি। সেই সঙ্গে সাতশো ক্লাবকে দু’লক্ষ টাকা করে অনুদান দেওয়ার অনুষ্ঠানের ছবিও। গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে আয়োজিত কলকাতা পুলিশের ‘ট্যাটু’ প্রদর্শনীর ছবি থাকছে মেট্রো চ্যানেলে। প্রায় সব দফতর ভিডিও দেখানোর ব্যবস্থা করেছে। তিন কেন্দ্রেই মেলার দিনগুলোয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে।
কিন্তু মূলত ‘নীরস’ তথ্য-পরিসংখ্যানের ওই মেলায় ভিড় কত হবে, তা নিয়ে খোদ প্রশাসনই সংশয়ে। ধরে নেওয়া হচ্ছে, ‘সাফল্যের’ প্রচারযজ্ঞ সফল করতে শাসকদলের লোকজন যথেষ্ট সংখ্যায় হাজির থাকবেন। তবু আরও নিশ্চিত হতে স্কুল-কলেজের পড়ুয়াদেরও আনার ব্যবস্থা হচ্ছে সরকারি উদ্যোগে।
প্রচারের এই উদ্যোগকে অনেকেই ‘ইতিবাচক’ মনে করছেন। বাণিজ্যিক জগতের একাধিক প্রতিনিধিদের মতে, “পেশাদারি দক্ষতায় প্রচার হলে তা বিনিয়োগ টানায় কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে।”
প্রশাসনের একাংশের বক্তব্য: যে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে, পঞ্চায়েত নির্বাচন পর্যন্ত তা ধরে রাখতে এমন প্রচার জরুরি। বিরোধীদের অবশ্য দাবি, কোনও কাজ হচ্ছে না বলেই এত প্রচারের দরকার পড়ছে। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র এ দিন বলেন, “মানুষ ভেবেছিল, নতুন সরকার আগের আমলের দুর্বলতা কাটিয়ে রাজ্যকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবে। অথচ দেখা যাচ্ছে, আগের সাফল্যগুলো আক্রান্ত হচ্ছে, এরা হাঁটছে পিছনের দিকে।” তাঁর কথায়, “এরা নিজেদের ঢাক নিজেরাই পেটাচ্ছে। কিন্তু এতে মানুষের আর্তনাদ চাপা পড়বে না।”
এই রংদার প্রচারাভিযানের পিছনে ব্যয়ের বহর ঠিক কত, তা নিয়ে অবশ্য সরকারি কর্তারা মুখ খুলছেন না। তবে প্রশাসনিক সূত্রের খবর, স্টল করতেই প্রতিটি দফতরের গড়ে ২০ লক্ষ টাকা লাগছে। সঙ্গে অন্যান্য খরচ। কোষাগারের টানাটানির মধ্যে এ কি বাড়তি চাপ নয়?
অর্থ দফতরের এক মুখপাত্রের বক্তব্য, “বিভিন্ন দফতর তাদের পরিকল্পনা খাতে, বাজেট-বরাদ্দ থেকে খরচ করছে। আমাদের কিছু বলার নেই।”
অর্থাৎ প্রশ্ন যা-ই থাক, আগামী ক’দিন সাফল্যের প্রচারেই মগ্ন থাকবে এক বছরের সরকার। |
|
|
|
|
|