ভরা আইপিএলের মধ্যে চাঞ্চল্যকর স্টিং অপারেশন। অনামী পাঁচ ক্রিকেটারের সাসপেনশন। ওয়াংখেড়েতে নাইট রাইডার্সের মহানাটকীয় জয়। সব কিছুকে ছাপিয়ে আচমকা মহাবিতর্কের কেন্দ্রে এখন শাহরুখ খান বনাম মুম্বই ক্রিকেট সংস্থা!
বুধবার ভোর রাতে এই দিনটাকে শাহরুখ জায়গা দিচ্ছিলেন তাঁর জীবনের স্মরণীয়তম তিনটে দিনের মধ্যে। পাঁচ বছরে এই প্রথম মুম্বইয়ের মাঠে মুম্বইকে হারালেন। উচ্ছ্বাসে এমন বাঁধনহারা তখনও যে, ওয়াংখেড়ের রাতের গণ্ডগোল নিয়ে সরকারি ভাবে মুখ খুলতে চান না। তখনও আন্দাজ করতে পারছেন না, সেই দিনটাই আইপিএলে তাঁর জন্য সবচেয়ে বড় আগ্নেয়গিরি হিসেবে হাজির হবে। আর তার লাভাস্রোতে কঠিন সঙ্কটে পড়বে ভারতীয় বোর্ড। আইপিএল ম্যানেজমেন্ট কমিটি। বৃহস্পতিবার রাজীব শুক্লদের টেকনিক দেখে মনে হল, যেন সময় নিয়ে বিতর্কটাকে তাঁরা স্ট্র্যাটেজিক টাইম আউটে নিয়ে ফেলছেন।
আইপিএলের পাঁচ বছরের ইতিহাসে অভূতপূর্ব! কে ভেবেছিল ৩২ রানে জিতে উঠে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে টিম মালিকের নিজের শহরে তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ করবেন মুম্বই ক্রিকেট সংস্থার কর্তারা! মেরিন ড্রাইভ পুলিশ স্টেশনে তাঁরা অভিযোগ দায়ের করেছেন ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩২৩ (ইচ্ছাকৃত ভাবে আঘাত করা) এবং ৫০৬ ধারায় (অপরাধমূলক প্ররোচনা)। দোষী প্রমাণিত হলে এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড!
তবে যে অভিযোগ দায়ের হয়েছে তা নন-কগনিজেবল। অর্থাৎ, আদালতের নির্দেশ ছাড়া এ ক্ষেত্রে শাহরুখকে গ্রেফতার করতে পারবে না পুলিশ। মুম্বই পুলিশ কমিশনার তাই এসআরকে-র কোটি কোটি ভক্তকে আশ্বস্ত করেছেন, গ্রেফতারের ব্যাপার নেই। তবে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। অভিযোগ দায়েরেই থেমে থাকতে চান না মুম্বই কর্তারা। শুক্রবার সকাল এগারোটায় প্রেসিডেন্ট বিলাসরাও দেশমুখের সভাপতিত্বে সভায় বসছে এমসিএ ম্যানেজিং কমিটি। বিলাসরাও এমনিতে শাহরুখের ঘনিষ্ঠ। শাহরুখের সহকর্মী তাঁর ছেলে রীতেশ। সাধারণ অবস্থায় গাঁধী পরিবার ঘনিষ্ঠ শাহরুখের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা নয় বিলাসরাওয়ের। |
অথচ এ দিন মুম্বইয়ে ফোন করে কমিটি সদস্যদের যা মেজাজি মনোভাব দেখা গেল, বিলাসরাওয়ের উপর কিছু ছাড়া হবে বলে মনে হয় না। বরঞ্চ পুলিশে ডায়েরি করা অনুমোদন করবে কমিটি। ওয়াংখেড়ে-প্রবেশ থেকে শাহরুখকে আজীবন নির্বাসন দিতে চাইবে। ভারতীয় বোর্ডকে চিঠি লিখবে ফ্র্যাঞ্চাইজি মালিকের অভব্য আচরণের প্রতিবাদে উপযুক্ত কড়া ব্যবস্থা নিতে। ঘটনার ২০ ঘণ্টা বাদেও মুম্বই কর্তাদের উত্তেজনা কমার লক্ষণ নেই। তাঁদের দাবি অনুযায়ী বিলাসরাও-ও বলে দিয়েছেন, এসপার কি ওসপার।
আইপিএলে এত দিনকার লড়াই ছিল দাদা বনাম খান। শনিবার পুণেতে তারই দ্বিতীয় পর্ব। কিন্তু তা নিয়ে আর ঔৎসুক্য নেই। গোটা ভারত এখন ওয়াংখেড়ের মাঝরাত্তিরের ঘটনা নিয়ে বিভাজিত: শাহরুখের উত্তেজিত হওয়া ঠিক হয়েছে কি? র্যান্ডম স্যাম্পলিংয়ে মনে হচ্ছে, শাহরুখের দিকেই পাল্লা ভারী। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট এবং টেলিভিশনে দিনভর শয়ে শয়ে প্রকাশিত হতে থাকা সেন্টিমেন্টের সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন অনেক বিশিষ্টও। লালু প্রসাদ, চেতন চৌহান, প্রহ্লাদ কক্কর, কীর্তি আজাদ, বিজয় মাল্য এবং রোহন গাওস্কর। রোহন নিজে মুম্বইয়ের ছেলে হয়েও বলছেন “শাহরুখকে ওয়াংখেড়ে থেকে নিষিদ্ধ করে কী হবে? ও বছরে এক দিন ঢোকে কি না সন্দেহ। এটা তো এ রকম বলা যে, তেন্ডুলকরকে মেহবুব স্টুডিওয় ঢুকতে দেব না। কিছু এসে যায়?”
আশ্চর্যজনক ভাবে মুম্বই ইন্ডিয়ান্স এই দেশভাগ করে দেওয়া বিতর্কে সম্পূর্ণ নীরব। ব্যক্তিজীবনে শাহরুখের এত ঘনিষ্ঠ হয়েও তাঁর সমর্থনে অম্বানীদের মুখ না-খোলা জন্ম দিয়েছে একটা মতবাদের। তা হল, পরোক্ষে এমআইয়ের সমর্থন কি মুম্বই ক্রিকেট সংস্থার দিকে? আরও একটা জোরালো মতবাদ হল, কেকেআর না জিতলে রাত্তিরের ঘটনাটা অনুপস্থিত থাকত। ম্যাচ ঘিরে এমনিতেই উত্তেজিত ছিলেন শাহরুখ। তাঁর অ্যাড্রিনালিন আরও বাড়িয়ে দেয় নিজের শিবির থেকে ভেসে আসা ম্যাচ সংক্রান্ত নানা খবর। কিছু খবর, কিছু হয়তো গুজব।
টেনশন এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে, রাত্তির দুটোর সময় ট্রাইডেন্ট হোটেলের লবিতে দাঁড়িয়ে কেকেআর ক্রিকেটারদের অভিযোগ, ফন্দি এঁটে ম্যাচটা তাঁদের হারানোর চেষ্টা হয়েছিল। সাকিব আল হাসান তখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না, শূন্য রানে থাকা সচিনের বিরুদ্ধে তাঁর এলবিডব্লিউয়ের আবেদন নাকচ হল কী করে? “ওটা যদি আউট না হয় তা হলে আউট কোনটা,” প্রশ্ন সাকিবের। ইনিংসের শুরুতে ম্যাকালামকে যে ভাবে এলবি দেওয়া হয়েছে, তা নিয়েও বিস্তর ক্ষোভ। আম্পায়ার যেন ম্যাকালামের প্যাডে লাগার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এমনও ফিসফাস শোনা গেল যে, ম্যাচ রেফারি কাল মুদ্রাটা ভাল ভাবে না কুড়িয়েই হরভজনকে বলেন, তোমরা জিতেছ। হয়তো অভিযোগটা বাড়াবাড়ি। কিন্তু গম্ভীর বনাম হরভজন যে চরম অবিশ্বাস ও সন্দেহের বাতাবরণে খেলা হল, তা নিয়ে বাড়াবাড়ি নেই।
শাহরুখ বনাম নিরাপত্তারক্ষীদের গণ্ডগোলটা এই প্রেক্ষাপটেই এত বেড়ে গেল। রাত সওয়া বারোটা নাগাদ টিভিতে ম্যাচ দেখে শাহরুখ মাঠে ঢোকেন। বান্দ্রা থেকে আসতে আসতে পুরস্কার বিতরণও তখন হয়ে গিয়েছে। তাঁর সন্তান এবং জনা কুড়ি কিশোরকে নিয়ে তিনি মাঠে ঢুকতে যান। লক্ষ্য, বাচ্চারা টেনিস বলে খেলবে। ইডেনে ক্লাবহাউসের লনে মাঝেমধ্যে খেলেও।
কিন্তু মুম্বই সংস্থা শাহরুখ ছাড়া কাউকে ঢুকতে দিতে রাজি হয়নি।
এ দিন ফোনে এমসিএ শীর্ষ কর্তা বললেন, “ইডেনে যা হয় হয়, এটা মুম্বই। আমরা খেলা শেষ হওয়ার পর এখানে কাউকে ঢুকতে দিই না। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের কোনও কিশোরও এখানে কখনও খেলেনি।”
এসআরকে কিন্তু বলছেন, সূত্রপাতটা নিরাপত্তাকর্মীদের হাত ধরে। তাঁরাই অভব্যতা করেন। একটি বাচ্চা মেয়েকে ঠেলে দেন। এসআরকে বলেছেন, “এমসিএ-র উচিত আমার কাছে ক্ষমা চাওয়া।” তিনি মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন, এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তাঁর বক্তব্য, “আমায় মাঠে ঢুকতে দেবে না? যেতেও চাই না। যারা এত অসভ্য ব্যবহার করে, সেখানে না যাওয়াই উচিত।” আইপিএল মহাকর্তা সুন্দর রামন ঘটনার সময় সামনেই ছিলেন। শাহরুখকে তিনিই শান্ত করেন। সুন্দর যতই সহানুভূতিশীল হন, এই বিতর্কের আঁচ তাঁর গায়েও প্রবল ভাবে পড়ছে। মুম্বই ক্রিকেটকর্তারা দাবি করছেন, সিসিটিভি-র ফুটেজ দেখলেই বোঝা যাবে, শাহরুখ স্রেফ ইগো দেখিয়ে শাহরুখ শিবিরের আবার বক্তব্য, সুপার সেলিব্রিটির এই সমস্যা। সব সময়েই নামগোত্রহীন অনামী লোকেরা তাঁকে জড়িয়ে নিজেরা পাদপ্রদীপে আসতে চায়। এরা নিশ্চিত সিসিটিভি-র ফুটেজ দেখলেই বোঝা যাবে, রক্ষীরা কিশোরদের সঙ্গে কী পরিমাণ অভব্যতা করেছে। আর পুলিশি তদন্ত? শাহরুখ উত্তেজিত ভাবে বললেন, “করুক না আমায় গ্রেফতার। আমার বাচ্চাদের গায়ে হাত পড়লে আবার একই জিনিস করব।” প্লে-অফে বাকি কোন দুটো টিম পৌঁছবে, তাকে ছাপিয়ে আইপিএলের সর্বশেষ ঔৎসুক্য, খান বনাম এমসিএ কোন দিকে যাবে? |