ভারতীয় অর্থনীতি যে পথে চলিতেছে, তাহা সম্ভবত অর্থমন্ত্রীর দুশ্চিন্তার কারণ হইয়াছে। ফলে, তিনি জানাইয়াছেন, অর্থনীতির স্বাস্থ্যোদ্ধারকল্পে তিনি কয়েকটি ব্যবস্থার কথা ভাবিতেছেন। যথা, অতঃপর সরকারি অর্থে বিমানসফর করিতে হইলে তাহা ইকনমি ক্লাসে করিতে হইবে। এই শ্রেণির আসনের পরিসর তুলনায় সঙ্কীর্ণ, ফলে দীর্ঘতনু মন্ত্রী-আমলারা কোথায় পা রাখিবেন, অর্থমন্ত্রী অবশ্য সে বিষয়ে ঈষৎ চিন্তিত। সরকারি সমাবেশ ইত্যাদিও অতঃপর পাঁচতারা হোটেলে করা চলিবে না। সার, পেট্রোলিয়ামাদি পণ্যে ভর্তুকি কমাইবার ইঙ্গিতও করিয়াছেন অর্থমন্ত্রী। শুনিয়াই একটি প্রশ্ন জাগ্রত হয়। ভর্তুকি কমাইবার কথা, অথবা সরকারি অপব্যয়ে রাশ টানিবার কথা অর্থমন্ত্রীর এখন স্মরণে আসিল? আজ আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হইয়া অর্থমন্ত্রীর যে ব্যয়সংকোচের কথা স্মরণে আসিয়াছে, তাহা স্বাভাবিক অবস্থাতেই করা বাঞ্ছনীয়। কী কারণে কোনও অবস্থাতেই সরকারি কর্তারা বিমানের প্রথম শ্রেণির আসনে সফর করিবেন? কী কারণেই বা পেট্রোলিয়াম পণ্যে কোটি কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হইবে? যে সরকারের রাজকোষ খাঁ খাঁ করিতেছে, তাহার এত বিলাসিতা কীসের? এই কু-অভ্যাসগুলি বহু পূর্বেই বর্জনীয় ছিল। সরকার তাহা সযত্নে পুষিয়া রাখিয়াছে।
আসলে ইহা ভারতীয় রাজনীতির এক বহু পুরাতন ব্যাধি অর্থনীতির গাড়িতে রাজনীতির ঘোড়া জুতিয়া দেওয়া। সেই গাড়ি স্বভাবতই রাজনীতির পথে চলিতে চাহে। রাজনীতির পথ মানে ক্ষুদ্র রাজনীতির পথ যে পথের শেষে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ধ্রুব। অর্থনীতি বিষয়ে বিন্দুমাত্র কাণ্ডজ্ঞান আছে, এবং ক্ষুদ্র রাজনীতির স্বার্থ নাই, এমন ব্যক্তিমাত্রেই সরকারকে ভর্তুকি কমাইবার পরামর্শ দিয়াছেন। বলিয়াছেন, রাজকোষ উজাড় করিয়া, যথেচ্ছ ধার করিয়া এই জনমোহনের খেলা সুস্থায়ী হইতে পারে না। সরকার শোনে নাই। রাজনীতি আর কবে কাণ্ডজ্ঞানের তোয়াক্কা করিয়াছে? সমস্যা হইল, অর্থমন্ত্রীর নাম মনমোহন সিংহ হইলেও বাস্তব যেমন, প্রণব মুখোপাধ্যায় হইলেও তেমন। কু-অভ্যাস অপরিবর্তনীয়। রাজনীতির ঘোড়ার টানে যখন অর্থনীতির গাড়ি মুখ থুবড়াইয়া পড়িতেছে, তখন ব্যয়সংকোচের মাহাত্ম্যকীর্তন শোনা যাইতেছে। আরও একটি ধুয়া অবশ্য আছে তাহার নাম আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি। গ্রিসে সরকার গঠন সম্ভব না হইলে ভারতে তো তাহার প্রভাব পড়িবেই। কথাটি যে ভুল, তাহা নহে। কিন্তু, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ঘাড়ে সমস্ত দোষ চাপাইয়া দেওয়ার প্রবণতাটি বিপজ্জনক। যেহেতু সে পরিস্থিতি ভারতের নিয়ন্ত্রণের অতীত, ফলে তাহার দোষ হইলে ভারতীয় নেতাদের আর কিছু করিবার নাই, মনোভাবটি এমন। ভারতীয় অর্থনীতি যে মুখ্যত ক্ষুদ্র রাজনীতির শিকার এই কথাটি বলিতে হইবে।
ভারতীয় অর্থনীতির প্রকৃত সমস্যা কী, অর্থমন্ত্রী তাহা বিলক্ষণ জানেন। আন্তর্জাতিক বাজারে বিনিয়োগযোগ্য অর্থের জোগান নাই, এই কথাটি বলিলে চলিবে না। এই বাজারেও লাতিন আমেরিকায় যথেষ্ট বিনিয়োগ হইতেছে। আসলে, ভারতের উপর কাহারও আস্থা নাই। কেন, তাহাও বহুচর্চিত। এই দেশে রাজনৈতিক সুস্থিরতা নাই, সরকার কার্যত অমেরুদণ্ডী। ফলে, এই দেশে টাকা ঢালিলে তাহা কতখানি সুরক্ষিত, প্রশ্নটি বিনিয়োগকারীদের মনে উদ্বেগের সঞ্চার করিবেই। ফলে, ভারতে বিদেশি বিনিয়োগের ধারা শুকাইয়া গিয়াছে। ফলে, ডলারের ভাণ্ডারে টান পড়িয়াছে, টাকার দাম সর্বকালীন তলানিতে। আবার, টাকার দাম কমিতেছে বলিয়া ভারতে বিনিয়োগ হইতে প্রাপ্ত অর্থের ডলারমূল্য কমিতেছে। তাহা বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহ করিতেছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক রফতানিকারকদের ডলার বেচিতে বাধ্য করিয়া, বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির দ্বারা বাজারে ডলারের জোগান বাড়াইয়া পরিস্থিতি বড় জোর সাময়িক ভাবে সামলাইতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি সমাধান সরকারকেই করিতে হইবে। সুশাসনের মাধ্যমে, অর্থনৈতিক সংযমের মাধ্যমে। লোকদেখানো নহে, প্রকৃত সংযম। |