|
|
|
|
রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক |
জমি বিল: কমিটির সুপারিশে আপত্তি রমেশের |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথে হেঁটেই বেসরকারি শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণে রাষ্ট্রের কোনও ভূমিকা থাকতে পারে না বলে জানিয়ে দিল সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। বরং কমিটির মতে, জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত বর্তমান বিলে ‘জনস্বার্থ’-র সংজ্ঞা পরিবর্তন করুক সরকার। বেসরকারি শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের হাতে যেটুকু ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব বিলে রয়েছে, তা-ও বিলোপ করা হোক।
কমিটির এই মতের সঙ্গে অবশ্য এক মত নন কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ। রাতে তিনি বলেন, “জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের একটা ভূমিকা অবশ্যই থাকা দরকার। সেটা কী, তা নিয়ে আলোচনার সুযোগ রয়েছে।” কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর এই মন্তব্যের পরে সংসদীয় কমিটির সুপারিশ সরকার কতটা মানবে তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। সরকারের বর্ষীয়ান এক মন্ত্রীর মতে, কমিটি যে ধরনের কড়া আইন করার কথা বলেছে, তা মানতে গেলে দেশে শিল্প করাই কঠিন হয়ে পড়বে।
জমি অধিগ্রহণ নিয়ে শতাব্দী প্রাচীন আইনটি বিলোপ করে নতুন আইন প্রণয়ন করতে প্রায় এক বছর আগে সংসদে ‘জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন এবং পুনর্স্থাপন’ বিল পেশ করে সরকার। সেই বিলের ৩ (জেড এ) ধারায় বলা হয়েছে, জনস্বার্থে প্রয়োজন এমন কিছু উৎপাদনের জন্য কোনও শিল্প প্রতিষ্ঠান কমপক্ষে ৮০% জমি অধিগ্রহণের পর যদি দেখা যায় বাকি জমি অধিগ্রহণে সমস্যা হচ্ছে, তা হলে সরকার বাকি জমি অধিগ্রহণে হস্তক্ষেপ করতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে প্রকল্প এলাকার সব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে পুনর্বাসন ও পুনর্স্থাপন নীতি অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
কিন্তু বিলটি বিবেচনা করে গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটি আজ যে সুপারিশ সংসদে পেশ করেছে, তাতে বলা হয়েছে, জনস্বার্থ সম্পর্কিত ওই ধারাটি সম্পূর্ণ বিলোপ করতে হবে। এমনকী, মুনাফা করার উদ্দেশে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণেও সরকারের এক্তিয়ার থাকবে না।
কমিটির মতে, উৎপাদনের মূল উপাদান তিনটি। জমি, মূলধন ও শ্রমিক। মূলধন ও শ্রমিক যখন সরকার সরবরাহ করে না, তখন সব থেকে মূল্যবান উপাদান জমি অধিগ্রহণে কেন সরকার হস্তক্ষেপ করবে? আমেরিকা, জাপান, কানাডা কোথাও এই নিয়ম নেই।
সংসদে রিপোর্টটি পেশ হওয়ার পর স্থায়ী কমিটির সদস্য, তৃণমূল সাংসদ দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “শিল্পপতিরা মুক্ত বাজারে বিশ্বাস করেন। মুনাফার অংশ যখন তাঁরা সরকারকে দেন না, তখন তাঁদের জন্য সরকারই বা কেন জমি অধিগ্রহণ করতে যাবে? যদি মুক্ত বাজারে বিশ্বাস করো, বাজার থেকে সরাসরি জমি কিনে নাও।”
তবে প্রশ্ন হল, স্থায়ী কমিটির এই সুপারিশ কি সরকার মানবে? এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার এক বর্ষীয়ান সদস্য আজ বলেন, “বর্তমান বিলটি সব শরিককের সঙ্গে কথা বলেই তৈরি হয়েছে। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও সঙ্গেও কথা বলেছিলেন জয়রাম রমেশ। বেসরকারি শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণে সরকারের ভূমিকা একেবারে বিলোপ করে দেওয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধা রয়েছে। সরকার প্রয়োজনে আর এক বার শরিকদের সঙ্গে কথা বলবে।” রমেশও আজ বলেন, তাঁর মন্ত্রকের তৈরি বিলটিতে কৃষি এবং শিল্পায়ন ও নগরোন্নয়নের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা হয়েছিল। মন্ত্রীর কথায়, “কৃষি যেমন দরকার, তেমনই শিল্পায়ন ও নগরোন্নয়নও সময়ের দাবি।” কিন্তু কমিটির সুপারিশ মানলে শিল্পায়নের পথ কঠিন হয়ে পড়বে বলেই কেন্দ্রীয় সরকারি সূত্রের মত।
সরকারি প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়ার যে সূত্র বিলে দেওয়া হয়েছে, তা নিয়েও আপত্তি তুলেছে স্থায়ী কমিটি। বিলে বলা হয়েছে, গ্রামীণ এলাকায় জমির মালিক বাজার মূল্যের চার গুণ ক্ষতিপূরণ পাবে। শহর এলাকায় পাবে বাজার মূল্যের দ্বিগুণ। সেই সঙ্গে দেওয়া হবে একশো শতাংশ সোলাসিয়াম। কিন্তু এই সূত্র নিয়ে আপত্তি রয়েছে কমিটির। তাদের বক্তব্য, শহর লাগোয়া গ্রামে বাজার মূল্যের চার গুণ দাম দিতে হলে প্রকল্পের খরচ বেড়ে যাবে। রাজ্য সরকারগুলিও কমিটির কাছে তাদের আপত্তির কথা জানিয়েছে। তাই কমিটির সুপারিশ, রাজ্য-ভিত্তিক কমিটি গড়ে দেওয়া হোক, যারা জমির মূল্য থেকে শুরু করে সামগ্রিক ক্ষতিপূরণের পরিমাণ হিসাব কষে বার করবে।
কৃষক তথা জমির মালিকদের স্বার্থে কমিটি আরও একটি দাওয়াই দিয়েছে। তা হল, জমি অধিগ্রহণের পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তা না হলে অতিরিক্ত সময়ের জন্য ক্ষতিপূরণের উপর সুদ দিতে হবে সরকারকে।
পাশাপাশি ‘এক্সিট পলিসি’ আরও সুনির্দিষ্ট করার প্রস্তাব দিয়েছে কমিটি। বর্তমান বিলে বলা হয়েছে, জমি অধিগ্রহণের পর ১০ বছরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শুরু না হলে তা রাজ্য সরকারের ‘ল্যান্ড ব্যাঙ্কে’ ফেরত দিতে হবে। কিন্তু কমিটির মতে, ১০ বছরের মেয়াদ কমিয়ে ৫ বছর করতে হবে। দ্বিতীয়ত, ওই জমি প্রকৃত মালিককে ফেরত দিতে হবে। জমির মালিক সেই জমির উপর দাবি না জানালে তবে তা ল্যান্ড ব্যাঙ্কে চলে যাবে। এ ছাড়াও সেচযোগ্য জমি ও আদিবাসী এলাকায় পারতপক্ষে জমি অধিগ্রহণ না করার পক্ষেই মত দিয়েছে কমিটি। কমিটির মতে, শুধু বহুফসলি জমি নয়, সেচযোগ্য জমির অধিগ্রহণও সীমিত না রাখলে খাদ্য সুরক্ষার উপর প্রভাব পড়বে। আর আদিবাসী এলাকায় একান্তই জমি অধিগ্রহণ করতে হলে, সেখানকার পরিবেশ, সংস্কৃতি, ভাষা ইত্যাদির চরিত্র যাতে না বদলায় তা সুনিশ্চিত করতে হবে।
সরকারের শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, কমিটির সঙ্গে আলোচনার সময় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের তরফে জানানো হয় যে বর্তমান বিলে কিছু সংশোধন করতে তারা প্রস্তুত। তবে কমিটির সব সুপারিশ মানা সম্ভব হবে না। সরকার যত শীঘ্র সম্ভব প্রয়োজনীয় সংশোধন এনে বিলটি চূড়ান্ত করবে। |
|
|
|
|
|