আগের দুই ‘পরীক্ষা’য় ফল ভাল হয়নি। তাই তৃতীয়বারেও সেই তিক্ত অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি রুখতে মরিয়া অর্থ মন্ত্রক। যে কারণে নয়াদিল্লিতে পা রাখা ফিচ রেটিংস-এর প্রতিনিধিদের সামনে বৃহস্পতিবার ভারতীয় অর্থনীতির আশাব্যঞ্জক দিকগুলিই যত্ন করে তুলে ধরল তারা। যদিও তলানিতে ঠেকা টাকার দাম আর বাড়তে থাকা ঘাটতির বহরের মধ্যে সেই চেষ্টা কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকে।
এর আগে ভারতের ঋণ ফেরত দেওয়ার ঝুঁকি নিয়ে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গী (আউটলুক) নামিয়ে এনেছিল মার্কিন মূল্যায়ন সংস্থা স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর্স (এসঅ্যান্ডপি)। এ দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গী ‘স্থিতিশীল’ (স্টেবল) থেকে ‘নেতিবাচক’-এ নামিয়ে এনেছিল তারা। একই সঙ্গে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল যে, পরিস্থিতি দ্রুত না-বদলালে বা সংশোধনী ব্যবস্থা না-নিলে কমানো হবে ভারতের ক্রেডিট রেটিং-ও। একই দিনে কেন্দ্রীয় সরকারকে অস্বস্তিতে ফেলেছিল আর এক মার্কিন মূল্যায়ন সংস্থা মুডিজ-এর শাখা মুডিজ অ্যানালিটিকসের মন্তব্যও। তারা জানিয়েছিল, বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ভারতে বৃদ্ধির হারকে শ্লথ করে দিচ্ছে নিষ্ফলা রাজনীতি আর সিদ্ধান্ত গ্রহণে কেন্দ্রের দ্বিধাগ্রস্ততা। এমনকী এ বিষয়ে মনমোহন সিংহের ‘প্রশাসিনক অক্ষমতা’ এবং গাঁধী পরিবারের ‘সুযোগ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে ব্যর্থতা’র দিকেও আঙুল তুলেছিল তারা। তাই এই পরিস্থিতিতে তৃতীয় (এই তিনটিই বিশ্বের প্রধান তিন মূল্যায়ন সংস্থা) জনের কাছে অন্তত পাশ নম্বরটুকু তুলতে মরিয়া প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মন্ত্রক।
গত দু’বছর ধরেই ভারতীয় অর্থনীতি সম্পর্কে ফিচ-এর দৃষ্টিভঙ্গী ছিল ‘স্থিতিশীল’। আগামী মাসেই ভারত সম্পর্কে নিজেদের নয়া মূল্যায়ন প্রকাশ করবে তারা। তার আগে এ বিষয়ে কেন্দ্রের বক্তব্য জানতেই এ দিন অর্থ মন্ত্রকের অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন আন্তর্জাতিক মূল্যায়ন সংস্থাটির কর্তারা।
অর্থ মন্ত্রকের এক কর্তার দাবি, বিশ্ব জোড়া আর্থিক সঙ্কটের আবহেও ভারতীয় অর্থনীতির বুনিয়াদ যে এখনও পোক্ত রয়েছে, সেই পরিসংখ্যানই তুলে ধরা হয়েছে ফিচের সামনে। জানানো হয়েছে, ইউরোপ-সহ উন্নত দুনিয়ার এই টালমাটাল সময়েও ভারতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ আসা থমকে যায়নি। যথেষ্ট ভাল বিদেশি আর্থিক সংস্থাগুলির লগ্নি আসার পরিসংখ্যানও। একই সঙ্গে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে সব ধরনের ঘাটতি কমাতে কেন্দ্রের পরিকল্পনাও। যেমন জানানো হয়েছে যে, রাজকোষ ঘাটতিতে রাশ টানতে ভর্তুকির অঙ্ক জাতীয় আয়ের ২%-এ বেঁধে রাখতে চায় কেন্দ্র। কমাতে চায় লেনদেন খাতে ঘাটতির পরিমাণও।
কেন্দ্র বিলক্ষণ জানে, এসঅ্যান্ডপি আর মুডিজ অ্যানালিটিকসের পর এ বার দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে ফিচের দৃষ্টিভঙ্গী বা মূল্যায়নও বিরূপ হলে, আরও বেশি করে বিনিয়োগকারীদের আস্থা হারাবে ভারতীয় অর্থনীতি। ফলে সে ক্ষেত্রে আরও মুখ থুবড়ে পড়বে ফের আর্থিক বৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত হওয়ার সম্ভাবনা। আর সেই কারণেই ফিচের সামনে আশার ছবি তুলে ধরতে এত আগ্রহী ছিল অর্থ মন্ত্রক।
কিন্তু পরীক্ষার খাতায় ‘ভাল উত্তর’ লিখে এসেও যে নম্বর ভাল মিলবে, এ ক্ষেত্রে তা হলপ করে বলা শক্ত। কারণ, নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গী বদলানোর পক্ষে এসঅ্যান্ডপি-র যুক্তি ছিল, ভারতে বিনিয়োগের গতি শ্লথ হয়েছে। কমেছে বৃদ্ধির হার। তেল আমদানির বাধ্যবাধকতা ও ডলারের সাপেক্ষে পড়তে থাকা টাকার দামের কারণে গত আট বছরের সর্বোচ্চ জায়গায় (জাতীয় আয়ের ৪ শতাংশ) পৌঁছেছে লেনদেন খাতে ঘাটতি। ঘাড়ে চেপে থাকা বিপুল ভর্তুকির (তেল, সার ইত্যাদি ক্ষেত্রে) কারণে অস্বস্তিকর জায়গায় রয়েছে রাজকোষ ঘাটতিও (মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের প্রায় ৬ শতাংশ)। দেশে বিদেশি বিনিয়োগের স্রোত বাড়লে, এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া অনেকটাই সহজ হত। কিন্তু সেই পথেও বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে আর্থিক সংস্কার থমকে যাওয়া। ফলে, সব মিলিয়ে আগামী দিনে দেশের অর্থনীতির পরিস্থিতি আরও সঙ্গীন হওয়ার সম্ভাবনা। অর্থনীতির এই বেহাল দশার জন্য রাজনীতিকে কাঠগড়ায় তুলেছিল মুডিজ-ও। বিশেষজ্ঞদের মতে, আশঙ্কার বিষয় হল এই সমস্ত সমস্যাই এখনও পুরোদস্তুর বহাল। বরং মাঝের সময়ে কেন্দ্রের রক্তচাপ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ডলারের সাপেক্ষে টাকার দরের বেনজির পতন। এমনকী এ দিন এক সময় তা নেমে গিয়েছিল ৫৪.৬০ টাকার খাদে। পরিস্থিতি এতটাই সঙ্গীন যে, তা সামাল দিতে প্রায় রোজই হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হচ্ছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক।
তাই এই পরিস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রকের তুলে ধরা যুক্তি কতটা ধোপে টিকবে তা নিয়ে সন্দিহান অনেকেই। এ কথা ঠিকই যে, পরিস্থিতি সামাল দিতে ইতিমধ্যেই উদ্যোগী হয়েছে কেন্দ্র। যেমন, ঘাটতি কমাতে ব্যয় সঙ্কোচের পথে হাঁটার কথা বলেছেন প্রণববাবু। রফতানি বাড়াতে বেশ কিছু উৎসাহবর্ধক পদক্ষেপ করার কথা বলেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মাও। কিন্তু এই সব পদক্ষেপের বিবরণ ফিচ কর্তাদের আদৌ কতটা সন্তুষ্ট করল, তার উত্তর দেবে সময়ই। |