বাবা ও মাকে কুপিয়ে খুন করে থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করলেন এক যুবক। বুধবার বান্দোয়ান থানার বুড়িঝোর গ্রামের ঘটনা। পুলিশ গ্রামে গিয়ে সুখরাম মুর্মু (৫৬) ও তাঁর স্ত্রী নীলমণি মুর্মু-র (৪৭) দেহ উদ্ধার করে। বাজেয়াপ্ত করা হয় তাঁদের খুনে ব্যবহার করা কুড়ুল ও একটি ছুরি। গ্রেফতার করা হয় রবি মুর্মু নামের ওই যুবককে। পুলিশ সুপার সি সুধাকরের কথায়, “খুনের কারণ স্পষ্ট নয়। ওই যুবককে জেরা করা হচ্ছে।”
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন সকালে বন্দোয়ান থানায় উসখোখুসকো অবস্থায় রবি হাজির হয়ে পুলিশ কর্মীদের জানান, সে তার মা ও বাবাকে খুন করে এসেছে। সে আত্মসপর্মণ করতে চায়। এরপরেই পুলিশ বুড়িঝোর গ্রামে যায়। রবিদের বাড়ি গ্রামের এক প্রান্তে। বাড়ি থেকে প্রায় দেড়শো মিটার দূরে সুখরামবাবুর দেহ পড়েছিল। তাঁর গলায় ও বুকে ছুরির আঘাত ছিল। উঠোনে পড়েছিল রক্তমাখা কুড়ুলটি। ঘরের ভিতরে পুলিশ কর্মীরা ঢুকে দেখেন মেঝের উপর নীলমণিদেবীর দেহ পড়ে রয়েছে। তখন বাড়ির উঠোনে ঘুরছিল রবির চার বছরের মেয়ে পার্বতী ও আড়াই বছরের ছেলে ইন্দু। এক কোনে শুয়েছিল রবির মাস ছয়েকের ছেলে চরণ। |
ধৃত রবি মুর্মু। নিজস্ব চিত্র। |
পুলিশ দেহ দু’টি নিয়ে আসার সময় ওই তিনটি শিশুকেও থানায় নিয়ে আসে। এ দিন দুপুরে বান্দোয়ান থানায় গিয়ে দেখা যায়, পুলিশ লকআপে দুই হাঁটর ভিতর মুখ গুঁজে বসে রয়েছে রবি। লকআপের বাইরে তাঁর তিন শিশু সন্তান। ওদের কারোর মুখে কথা নেই। পার্বতী শুধু বলল, “বাড়ি যাব।”
খুনের কারণ কী? রবি কোনও জবাব দেয়নি। গ্রামে তাঁর পড়শিরা জানালেন, নীলমণি রবির সৎমা। রবিবর স্ত্রী ঝুনুর সঙ্গে নীলমণির মাঝে মধ্যেই নানা কারণে ঝগড়া হত। ঝুনু প্রায়ই নানা রোগে ভুগতেন। এপ্রিল মাসের মাঝমাঝি তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন তাঁকে প্রথমে বান্দোয়ান স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ও পরে বাঁকুড়া মেডিক্যালে ভর্তি করানো হয়। কিছু দিন পরে সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়। এরপরেই রবি মানসিক অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়েন। ঝুনুর মৃত্যুর জন্য সে নীলমণিদেবীকে দোষ দিত। নীলমণিদেবীকে ডাইনি বলেও অপবাদ দিয়ে তাকে ঝগড়া করতে বাসিন্দারা দেখেছেন বলে জানান। অনেক সময় সুখরামবাবু তাঁদের ঝগড়া থামাতে না পারলে পড়শিরা এসে শান্ত করতেন। পুলিশের দাবি, জেরায় রবি তাঁদের কাছে জানিয়েছে, মঙ্গলবার পাশেরা কুচিয়া গ্রামে রাতভোর মেলা ছিল। তার বাবা সুখরামবাবু সেখানে গিয়েছিলেন। অসুস্থ বলে নীলমণিদেবী সন্ধ্যা থেকে ঘরের ভিতরে একটা ছেঁড়া মাদুরে শুয়ে ছিলেন। রাতে তার তিন ছেলেমেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পরে রবি ঘুমন্ত মায়ের গলায় কুড়ুলের কোপ মারে। ভোরের দিকে সে থানায় আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছিল। তখন বাড়ি ফিরছিলেন সুখরামবাবু। বাড়ি থেকে খানিক দূরে রবির সঙ্গে দেখা হতে তার কাছে নীলমণিদেবীর খুন হওয়ার কথা জানতে পারেন। এ নিয়ে তাঁদের বাবা-ছেলের মধ্যে ঝগড়া বাধে। সেই সময় রবি পকেট থেকে একটি ছুরি বের করে বাবার গলায় ও বুকে বসিয়ে দেয়। এরপর সে থানার দিকে হাঁটা লাগায়।
সুখরামবাবুর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একটি ঘরে পড়ে রয়েছে নীলমণিদেবীর রক্ত মাখা মাদুর। বাড়ির উঠোনেও রক্ত পড়েছিল। অল্প কয়েকজন পড়শি উঁকিঝুঁকি মারছিলেন। তবে কেউ তাঁদের নাম জানাতে চাননি। পুলিশ জানিয়েছে, বান্দোয়ানের কাররু গ্রামে রবির শ্বশুরবাড়ি। খবর পেয়ে সন্ধ্যায় রবির এক শ্যালক এসে শিশু তিনটিকে নিয়ে যান। পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের পুরুলিয়া জেলা সম্পাদক নয়ন মুখোপাধ্যায় বলেন, “ডাইনি সন্দেহে নির্যাতনের ঘটনা এই জেলায় আগের থেকে অনেকটাই কমেছে। সম্ভবত ওই যুবক খানিকটা মানসিক বিকার গ্রস্ত। তবে এ নিয়ে সচেতনতার প্রয়োজন এখনও রয়েছে।” |