|
|
|
|
ইডেনে জয় হারানোর শোক শেষ বলের ছক্কায় |
গম্ভীরের মহল্লায় ‘বদলা’ ধোনির |
সব্যসাচী সরকার • কলকাতা |
ইডেনে নাইটদের আগের সাতটা ম্যাচে ডাগআউটের ধারে-কাছেও কেউ তাঁকে দেখেনি। বি ব্লকের বাঁ দিকের রেলিংয়ের কোণে দলবল সহ দাঁড়িয়ে থাকাই আইপিএল ফাইভের শাহরুখ খান। নাইট মালিকের সামান্য অন্য রকম ছবি দেখছিল সোমবার রাতের ইডেন। একা নেমে এসেছেন ডাগআউটে। সোফায় বসে চোখে-মুখে গভীর বিষণ্ণতা-সহ লক্ষ্য করছিলেন, কী ভাবে তাঁর সাধের নাইটদের বোলিং নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে হাসি-বিজয় জুটি। নারিনের স্পিন-মন্ত্র দুটো উইকেট তুলতে ফের উত্তাল ইডেন। তারপর ধোনি ধামাকা, ডি’লাঞ্জের ১৯ নম্বর ওভারে ১৮ রান তুলে ম্যাচের রঙ বদলে দেওয়া। শেষ ওভারে আবার ছক্কা মারতে গিয়ে বোল্ড, ফের জয়ের হাতছানি। পঞ্চম বলে ব্র্যাভোর হাত থেকে ব্যাট পড়ে যাওয়ার নাটক ও শেষ বলে যখন দরকার ৫, ভাটিয়ার হাত থেকে বেরোল চেতন শর্মা মার্কা ‘কুখ্যাত’ লো ফুলটস। শারজার মিয়াঁদাদের মতোই ব্র্যাভো ওড়ালেন গ্যালারিতে। রুদ্ধশ্বাস থ্রিলারের যাবতীয় উপাদান মজুত ছিল ইডেনে, শুধু পরিণতিটা বিয়োগান্ত। শেষ ওভারে পরিণত ‘টেম্পারামেন্ট’ দিয়ে বাজিমাত টিম ধোনির।
|
|
যবনিকা: শেষ বলে ছক্কা ব্রাভোর। |
মুম্বই ম্যাচে হারের হ্যাংওভার কাটতে না কাটতে ফের হোঁচট। শেষ বলে ছয় খেয়ে নাইটদের ঘোড়া থমকে গেল কিংসের রাজদরবারে। প্লে অফে এক বা দুই হওয়া অনিশ্চিত। রাতের ইডেন নিশ্চুপ সাক্ষী রইল কী ভাবে নাইটদের মহল্লায় এসে চিপকে হারের ‘বদলা’ নিয়ে গেলেন শহরের জামাই মহেন্দ্র সিংহ ধোনি।
ম্যাচ উইনার ঠিকই, মিস্ট্রি বোলার ঠিকই। কিন্তু ম্যাচ জেতাতে গেলে তো নারিনেরও দরকার উপযুক্ত পুঁজি। ১৫৮ ইডেনের উইকেটে আর যাই হোক, ম্যাচ জেতার জন্য যথেষ্ট ছিল না। আরও ভয়ের, প্লে অফের ছাড়পত্র পাওয়ার মরিয়া লড়াই যত ক্লাইম্যাক্সের দিকে এগোচ্ছে, তত নাইটদের এ বারের অভিযানের মর্মার্থ খুব সহজে পড়া যাচ্ছে। গম্ভীরের ব্যাট চললে নাইটদের চ্যাম্পিয়নসুলভ, অপ্রতিরোধ্য লাগে। আর না চললে শাহরুখের দলকে মনে হয় মাস্তুলবিহীন জাহাজ। দিশাহীন, কোনওরকমে টালমাটাল হয়ে ভাসমান। পরপর বহু ম্যাচে এই এক কাটা রেকর্ড বাজছে। বেঙ্গালুরুতে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স, ইডেনে কিংস ইলেভেন, পুণে ওয়ারিয়র্স। গ্যাস বেলুনের গ্যাস ফুরিয়ে গেলে যেমন মাটিতে নেমে আসে, অধিনায়ক ফিরলেই ঠিক সে ভাবে যেন আকাশ থেকে আছড়ে পড়ে নাইট ব্যাটিং।
অথচ সোমবার শুরুতে প্লটটা কত অন্য রকম ছিল। টস হেরে আগে ব্যাটিং এবং খুনখারাপি মেজাজে গম্ভীরের শুরু। জাকাতির স্পিন দিয়ে ধোনির শুরু এবং গম্ভীরের দ্বিতীয় বলেই তাঁকে স্কোয়ার লেগ বাউন্ডারিতে পাঠানো। পাওয়ার প্লে-তে ৫০-০, ১১ ওভারে ৯৬-০। এর চেয়ে ভাল শুরু হয়? কেকেআরের হয়ে তাঁর প্রথম সেঞ্চুরিটা নাইট অধিনায়ক তুলে নেবেন কি না তাই নিয়ে শুরু জল্পনা। সম্ভাব্য স্কোর বলতে ন্যূনতম ১৭৫ ধরা হচ্ছে। সেখান থেকে মেরেকেটে ১৫৮! ভুল বোঝাবুঝিতে ম্যাকালামের একটা রানআউট। পরের ওভারে ব্যাটের ভিতরে কানায় লেগে গম্ভীরের বোল্ড হওয়া। ব্যস, নাইটদের রান তোলার গতিতে ‘ব্রেক’। ৯৯-০ থেকে ১৫৮ অন্তত একটা টিমের মিডল অর্ডারের কঙ্কালটাই তুলে ধরে। যা প্লে অফের আগে শাহরুখ খানের টিমের জন্য একেবারেই ভাল বিজ্ঞাপন নয়।
|
|
ম্যাচের শেষে বিজয়ী ধোনির পাশে হতাশ গম্ভীর। |
লিগ টেবিলে এক বা দুই নম্বরে থেকে প্লে অফে ঢুকতে গেলে সোমবার রাতের ইডেন থেকে দুটো পয়েন্ট খুবই মহার্ঘ্য ছিল। সাদা চোখে দেখলে হয়তো ছিল নাইট আর সুপার কিংসের লড়াই। আরও ঢের বেশি তাৎপর্যের দ্বৈরথ ছিল যুযুধান দুই নেতার। ফটো ফিনিশে যেখানে টক্কর হওয়ার কথা। এক দিকে যুদ্ধং দেহি শরীরী ভাষা এবং একার কাঁধে টিমকে টেনে নিয়ে যাওয়ার মানসিকতাসম্পন্ন গম্ভীর। রিংয়ের উল্টো দিকে বরফশীতল স্নায়ু আর একরোখা সাহসে তেজিয়ান ক্যাপ্টেন কুল ধোনি। যাঁর টিম কিনা পিছিয়ে পড়েছে পয়েন্টের দৌড়ে। ইডেন মা্যচের বৈতরণী পার করে প্লে অফের নিরাপদ কিনারায় টিমকে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব যাঁর কাঁধে। হলই বা টি টোয়েন্টির ধুন্ধুমার ক্রিকেটের বিনোদন-যজ্ঞ, রেসের ট্র্যাকে নামলে দুই নেতার মধ্যে স্ট্র্যাটেজিতে ঠোকাঠুকি হবে না, হয়? হলও। প্রথম রাউন্ডটা যদি গম্ভীরের হয়, তীক্ষ্ন ক্রিকেটীয় আইকিউ-এর প্রয়োগে চেন্নাইকে মা্যচে ফেরালেন ধোনি। ২১ বলে ২৮ করে ম্যাচও নিয়ে গেলেন।
গম্ভীর আউট হতেই নাইটদের নড়বড়ে মিডল অর্ডারকে আক্রমণের রাস্তায় গিয়েছিলেন চেন্নাই অধিনায়ক। সম্বল স্পিন। কিন্তু অশ্বিন বা জাকাতি নন, ধোনিকে যথাসাধ্য ‘সাহায্য’ করলেন মনোজ-ইউসুফরা! কালিস রোজ রোজ রান পাবেন, এটা হয় না। মনোজ যখন ক্রিজে, নাইটরা ১০০-২। হাতে আট ওভার। এই তো সেই মঞ্চ, যেখানে ঘরের ছেলের কাছ থেকে একটা ৩০ বলে ৪৫ বা ১৮ বলে ৩৩ গোছের ইনিংস প্রত্যাশিত। প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিরাট কোহলি, রোহিত শর্মা বা সুরেশ রায়নাদের সঙ্গে টক্কর দিতে হলে, টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে জাতীয় দলের জন্য নিজের নামটা ভাসিয়ে রাখতে হলে অন্য কিছু নয়, ম্যাচ জেতানো ইনিংস দরকার ছিল। মুম্বই ম্যাচে পারেননি, ধোনির সামনেও মনোজের অবদান ১৪ বলে ১২। স্ট্রাইক রেট (৮৫.৭১) একেবারেই পাতে দেওয়ার মতো নয়। |
সৌজন্য |
|
মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে জুহি চাওলা। সোমবার।— নিজস্ব চিত্র |
কেকেআর নেহাত ব্যাক্তিগত মালিকানার দল বলে রক্ষে, নয়তো পাঠানকে এতদিন খেলিয়ে যাওয়া নিয়ে আদালতে জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয়ে যাওয়ার কথা। অবদান বলতে মুম্বই ম্যাচে ঘষটে ঘষটে করা ৪০ নট আউট। যত বল খেলবেন, তার দ্বিগুণ রান করবেন, এই আশা থেকেই পাঠান জাতীয় ক্রিকেটারের পিছনে কোটি কোটি টাকা ঢালা। কোথায় কী, পাঠান এ বার এমন ‘পর্বত’ হয়ে দেখা দিয়েছেন যে মুষিক প্রসবেও অক্ষম। সারা বিশ্বের ক্রিকেটমহল জেনে গিয়েছে, পাটা পিচে স্পিনারের বল জায়গামতো পড়লে তবে দু’একটা ওড়াতে পারেন। নয়তো অষ্টরম্ভা। মনোজ আউট হওয়ার সময় হাঁসফাঁস করা নাইটদের দেড়শোয় পৌঁছনো নিয়েই সংশয় ছিল। শেষ বাজারে গম্ভীরের প্রিয় ‘দাসি’ এবং লক্ষ্মীর দাপটে স্কোর ভদ্রস্থ ১৫৮-এ পৌঁছয়।
এই হারে টেনশনের নিম্নচাপ ঢুকে পড়ল নাইট শিবিরে। বাকি দুটো ম্যাচ, পরের ম্যাচ সচিনের ডেরায়, মুম্বইয়ে। যেটা মোটেই হাসতে হাসতে জেতার ম্যাচ নয়। প্লে অফের লড়াই যে হাড্ডাহাড্ডি জায়গায় পৌঁছেছে, বুধবারে ম্যাচটা হারলেই ‘দাদা বনাম খান’ ফিরতি দ্বৈরথ ‘এস্পার-ওস্পার’ চেহারায় হাজির হতে পারে গম্ভীর বাহিনির কাছে। কিছুই যাদের হারানোর নেই, শেষ ম্যাচে সম্মানরক্ষার তাগিদে সর্বস্ব দিয়ে পুণে তো ঝাঁপাবেই। আর কে না জানে, ক্রিকেট এমনই খেলা যে ‘কখন যে কী ঘটে যায়, কিস্স্যু বলা যায় না!’
|
নাইটদের যা চাই |
ডোয়েন ব্র্যাভোর শেষ বলের ছক্কা কলকাতা নাইট রাইডার্সের আইপিএল অভিযানকে পুরো লাইনচ্যূত না করলেও বড় ধাক্কা দিয়ে গেল। সোমবার চেন্নাইয়ের সঙ্গে হারার পর প্রশ্ন উঠছে, প্লে অফে যাওয়ার জন্য নাইটদের এ বার কী করতে হবে?
• প্লে অফের প্রথম দুটো দলের মধ্যে থাকতে গেলে নাইট রাইডার্সকে শেষ দুটো ম্যাচ জিততেই হবে। যার মধ্যে ১৬ তারিখ মুম্বইয়ে মুম্বইকে আর ১৯ পুণেতে পুণে ওয়ারিয়র্সকে খেলতে হবে। সোমবার নাটকীয় জয় পাওয়ার পর সচিন তেন্ডুলকরের মুম্বই এখন দুরন্ত ছন্দে।
• নাইটরা যদি শেষ দুটো ম্যাচের মধ্যে একটায় জেতে, তা হলে প্লে অফের চারটে দলের মধ্যে চলে যাবে ঠিকই, কিন্তু খুব সম্ভবত তিন বা চার নম্বর হয়ে। সে ক্ষেত্রে প্লে অফের প্রথম ম্যাচে হারলেই বিদায়। ফাইনালে ওঠার দ্বিতীয় সুযোগ পাওয়া যাবে না।
• শেষ দুটো ম্যাচ হেরে গেলে কিন্তু নাইটদের প্লে অফে ওঠাই কঠিন হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে নাইটরা শেষ করবে ১৭ পয়েন্টে। অন্যান্য বার এই পয়েন্টে হয়তো শেষ চারে চলে যাওয়া যেত, কিন্তু এ বার এত কঠিন লড়াই হচ্ছে যে ১৭ পয়েন্ট হয়তো যথেষ্ট হবে না।
সব মিলিয়ে ব্র্যাভোর একটা ছক্কা শাহরুখ খানের দুশ্চিন্তা অনেক বাড়িয়ে দিয়ে গেল।
|
|
|
ছবি: শঙ্কর নাগ দাস |
|
|
|
|
|