ঘোর অমাবস্যার এক রাতেই দুলদুলের গলায় হাত বুলিয়ে চুপিসাড়ে তাকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন নাসের শেখ। অন্ধকার রাতে বাড়ি ফেরার পথটা যাতে খুঁজে না পায় তাঁর সাধের দুলদুল। মাইল তিনেক উজিয়ে সীমান্তরক্ষীদের পরিত্যক্ত রাস্তা ধরতেই দুলদুল আর সামনের দিকে এগোতে চায়নি। কচি ঘাসের জঙ্গলে মুখ ডোবাতেই একছুটে পালিয়ে এসেছিলেন নাসের। বাড়ি ফিরে সে রাতে আর ঘুমোতে পারেননি। উপুড় হয়ে সারা রাত কেঁদেছিলেন।
নাসের একা নয় সীমান্তবর্তী ডোমকল এলাকার অনেকেই এ ভাবেই নিশ্চুপে বাতিল করে দিয়ে এসেছেন তাঁদের বুড়ো দুলদুলদের। একে ঘোর অভাব। তায় গ্রামের রাস্তায় লছিমন জাঁকিয়ে বসায় ‘বুড়ো’ ঘোড়ার দিন বুঝি সত্যিই ফুরিয়েছে ডোমকলে।
অথচ এই দুলদুলদের নিজের সন্তানের মতই দেখতেন নাসেররা। নিজে না খেয়েও ঘোড়ার খাবার কিনেছেন তাঁরা। দিন ভর হাড়ভাঙা খাটনির পরেও গভীর রাতে উঠে দেখে আসতেন দুলদুল কেমন আছে। দুলদুলের উপরে ভর করেই এক সময়ে গড়গড়িয়ে চলত তার সাত জনের সংসার-গাড়ি। |
কিন্তু বছর চারেক ধরে বদলাতে শুরু করল মান্ধাতা আমলের পরিবহণ ব্যবস্থা। ঘোড়ার গাড়ি থামিয়ে বাজার দখলে এগিয়ে এল লছিমন কিংবা ছোট গাড়ি। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে লাগাম ছেড়ে ঘোড়ার মালিকরাও আঁকড়ে ধরলেন লছিমনের হ্যান্ডেল। স্মৃতি হিসেবে লছিমনের গায়ে চকচকে রং দিয়ে লেখা থাকল বাসন্তি, দুলদুল কিংবা দিলরুবার নাম।
এক সময় রানিনগর থানার শেখপাড়া বাজার থেকে প্রায় তিনশো ঘোড়ার গাড়ি ছড়িয়ে পড়েছিল এলাকার বিভিন্ন গঞ্জগুলোতে। রীতিমতো মালিকদের নিয়ে সে সময়ে একটি মজবুত সংগঠনও তৈরি হয়েছিল এলাকায়। সংগঠনের তৎকালীন সম্পাদক এনামুল হক এখন নিজেই এখন লছিমনের মালিক। বলছেন, ‘‘বছর তিনেক আগেও বাজারের মধ্যে লছিমনওয়ালাদের আমরা ঢুকতে দিতাম না। কিন্তু দেখলাম মানুষ নিজে থেকেই বেছে নিল লছিমন। কারণ ঘোড়ার গাড়ির থেকে কম সময়ে, কম ভাড়ায়, আয়েশ করে বসে তাঁরা যাতায়াত করতে পারছেন। মার খেতে লাগল এত দিনের পরিচিত ঘোড়ার গাড়ি। যাত্রীদের উদ্দেশ্যে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেও তাঁরা আমাদের দিকে ঘুরেও তাকাতেন না। এগিয়ে যেতেন লছিমনের দিকেই। বাধ্য হয়ে পেটের দায়ে লছিমনের দিকেই ঝুঁকে পড়লাম।’’ পড়ে থাকল ঘোড়াগুলো। কিন্তু অনটনের বাজারে তাদের খাবার জোগানো কি চাট্টিখানি কথা? তাই মায়া কাটিয়ে তাদের ছেড়ে দিতে থাকলেন এনামুলেরা।
দুলদুলের জন্য এখনও মন কেমন করে নাসেরের। রাতে শুয়ে মাঝমাঝেই ঘুম ভেঙে যায় ভুল করে মাঝরাতেই ছুটে যান চালাঘরের দিকে। খাঁ খাঁ ঘরটায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে সেই অমাবস্যার রাতটা মনে পড়ে যায় তাঁর। |
নাসের বলেন,‘‘ এ ছাড়া আর কীই বা করার ছিল! সাত জনের সংসারে এমনিতেই নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তার উপরে লছিমন আর ছোট গাড়ির রমরমায় শিকেয় উঠে গিয়েছিল ঘোড়ার গাড়ির ব্যবসা তাই বাধ্য হয়েই আর পাঁচ জনের মত বিবির গয়না বিক্রি করে, সুদে কিছু টাকা ধার নিয়ে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড লছিমন কিনে ফেললাম!’’ আর এই সব বাতিল হয়ে যাওয়া ঘোড়াগুলোর ঠাঁই হয় হাট, বাজার কিংবা খেলার মাঠ। সেখানে তারা চরে বেড়ায়। দল বেঁধে কখনও বা বাজারের দোকানের সামনেই ভিড় করে ‘ভিখিরি-গোড়ারা’। যাঃ হট, তাদের তাড়াতে না পেরে অনেক সময়ে গরম জলও ঢেলে দিয়েছেন বুনো দুলদুলদের উপরে, এমন নজিরও রয়েছে। কখনও বা গাড়ির ধাক্কায় পা ভেঙে পড়া থাকতেও দেখা যায় তাদের। এ ভাবেই এক সময় মরে যায় বছর কয়েক আগের ‘অপরিহার্য’ ঘোড়াগুলো।
ইসলামপুরেও স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান কংগ্রেসের আবেদ আলি বলেন, ‘‘আমাদের বাজারেও দেখেছি বেশ কিছু বেওয়ারিশ ঘোড়া। তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা সত্যিই খুব খারাপ। কিন্তু তাদের দেখভাল করা বা কোথাও রেখে দেওয়ার মত পরিকাঠামোও তো পঞ্চায়েতের নেই।” এ ব্যাপারে প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরে সঙ্গে যোগাযোগের আশ্বস মিলিছে তাঁর কাছে। কিন্তু কবে? স্থানীয় বিধায়ক কংগ্রেসের ফিরোজা বেগম অবশ্য এ সব জানেন না। তিনি বলেন,‘‘বিষয়টি আমার জানাই নেই। তবে এটা খুব কষ্টের। পরিত্যক্ত ওই ঘোড়াগুলোর বিষয়টি বিধানসভাতে তুলতে হবে।’’
কিন্তু সরকারের সে কথা শোনার সময় আছে তো? |