পাঠ্যবইয়ে রাজনৈতিক কার্টুনের কোনও প্রয়োজন নেই বলে আজ রায় দিল সংসদ। সেই রায় মেনে কার্টুন-সহ বিতর্কিত বইটি বাতিল করার পাশাপাশি এনসিইআরটি-র সমস্ত পাঠ্যবই খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিল কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক। ওই কাজের জন্য শিক্ষাবিদ সুখদেও থোরাটের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করার কথা আজ সংসদে ঘোষণা করেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী কপিল সিব্বল। এক মাসের মধ্যে কমিটি তাদের রিপোর্ট জমা দেবে।
ক’দিন আগে কার্টুন-বিতর্কে উত্তাল হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ। এ বার কার্টুন-ঝড় আছড়ে পড়েছে সংসদে। এনসিইআরটি প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তকে ভীমারাও রামজি অম্বেডকর ও জওহরলাল নেহরুকে নিয়ে আঁকা একটি কার্টুন ছাপাকে কেন্দ্র করে। সংবিধান রটনায় দেরির দিকে ইঙ্গিত করে ওই কার্টুনে দেখানো হয়েছে সংবিধান লেখা শামুকের পিঠে আসীন অম্বেডকর, আর নেহরু চাবুক হাতে তাঁকে তাড়া দিচ্ছেন। এই কার্টুন নিয়ে গত শুক্রবার উত্তাল হয় সংসদ। দফায় দফায় অধিবেশন বানচাল করে দেন মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি-সহ বিরোধীরা। কংগ্রেস এবং ইউপিএ-র শরিক দলেক একাধিক সাংসদও পাঠ্যপুস্তকে ওই কার্টুন ছাপা নিয়ে আপত্তি জানান। এই চাপের মুখে সে দিনই বইটি বাতিল করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল সরকার। কিন্তু আজ ফের বিষয়টি নিয়ে লোকসভায় পূর্ণাঙ্গ আলোচনার দাবি করেন সাংসদরা। তাঁদের বক্তব্য, পাঠ্যপুস্তকে এই কার্টুন রাখার ফলে ছাত্রদের মনে রাজনৈতিক নেতাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ ভাবে রাজনৈতিক নেতাদের অপমান করা হচ্ছে বলেও অনেকে অভিযোগ করেন।
মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী কপিল সিব্বল আজ সংসদে বলেন, তিনি কার্টুনের বিরোধী নন। কার্টুনের জন্য অন্য স্থান রয়েছে। পাঠ্যবইতে কার্টুন না থাকলেও চলে। এই পরিস্থিতিতে এনসিইআরটি-র অন্যান্য বইয়ে কী ধরনের কার্টুন রয়েছে তা খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রক। সূত্রের বক্তব্য, এনসিইআরটি-র বইয়ে প্রায় দু’শো কার্টুন রয়েছে। যার কয়েকটি ইন্দিরা গাঁধীর সমালোচনা করে। যা গাঁধী পরিবারের পক্ষে অস্বস্তির। সিব্বল আজ বলেন, “প্রাথমিক ভাবে দেখেছি একাধিক বইতে আপত্তিজনক কার্টুন রয়েছে। এ ধরনের কার্টুন পাঠ্যবইয়ে থাকা উচিত নয়।”
স্বাভাবিক ভাবেই পাঠ্যপুস্তকে রাজনীতিকদের সম্পর্কে কার্টুন রাখা না-রাখা নিয়ে বৃহত্তর বিতর্কের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। শিক্ষাবিদদের একাংশ এ ব্যাপারে সরকারের পদক্ষেপের সমালোচনা করছেন। কিন্তু সিব্বল তথা কেন্দ্রের বক্তব্য, পাঠ্যবইয়ে রাজনৈতিক কার্টুন থাকবে কেন? সংবাদপত্র রাজনৈতিক কার্টুন ছাপলে তা নিয়ে কেউই আপত্তি করছে না। কিন্তু সেই কার্টুন পাঠ্যবইতে ছাপলে ছাত্রদের প্রভাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সরকারের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “ভারতের গণতন্ত্র এখন পরিণত। সেখানে দেশের সংবিধান প্রণেতাকে কটাক্ষ করে পাঠ্যবইয়ে কার্টুন ছাপা কোনও দিক থেকেই যুক্তিসঙ্গত নয়।”
একই কথা আজ সংসদে বলেছেন লোকসভার নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায়ও। যদিও ব্যক্তিগত ভাবে রাজনৈতিক কার্টুন পছন্দ করেন তিনি। এমনকী তাঁর সমালোচনা করে প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট আর কে লক্ষ্মণের আঁকা একটি কার্টুন তিনি যত্ন করে ব্যক্তিগত সংগ্রহেও রেখেছেন। এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে প্রণববাবু বলেন, “বিষয়টি গুলিয়ে ফেললে চলবে না। ওই সব কার্টুন হল পরিণতমনস্কদের জন্য। স্কুলের ছাত্রদের জন্য নয়।”
তবে বিতর্কিত বইটি কেন্দ্র তড়িঘড়ি বাতিল করলেও সরকারের মধ্যে এ ব্যাপারে যে ভিন্ন মত নেই তা নয়। কংগ্রেসেরই এক মন্ত্রী আজ বলেন, আসলে সংসদে বেশ কিছু বিল পাশ করানোর তাড়া রয়েছে সিব্বলের। সরকারও সংসদ সুষ্ঠু ভাবে চালাতে চাইছে। সেই কারণেই মায়াবতীর দাবির কাছে নতি স্বীকার করে নেওয়া হল। তাঁর কথায়, “এক দিকে বারাক ওবামা বলছেন ভারতীয় ছাত্ররা মেধাবী, ওরা আমেরিকার ছাত্রদের পিছনে ফেলে দিতে পারে। আর আমরা বলছি, আমাদের ছাত্ররা পরিণত বুদ্ধির নয়। ওরা কিছুই বোঝে না। ওদের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে!”
তবে সংসদে পাল্টা যুক্তি দেওয়ার মতো রাজনীতিকের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। এবং তাঁরাও প্রকাশ্যে মুখ খোলেননি। বরং বিতর্কিত কার্টুন পাঠ্যবই থেকে বাদ দেওয়ার পক্ষেই সংখ্যাগুরু সাংসদ আজ সওয়াল করেন। এমনকী সিব্বলের ইস্তফার দাবি করেন বিরোধীরা। যেমন, অকালি দলের সাংসদ হরসিমরৎ সিংহ কৌর বলেন, “সম্প্রতি নবম ও দ্বাদশ শ্রেণির প্রায় একশো জন ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে সরাসরি আলাপাচারিতা থেকে বুঝেছি তারা কেউই রাজনীতিক হতে চায় না। তারা মুখের উপর বলে দিয়েছে তারা খুনি, অপরাধী বা চোর হতে চায় না। এই ঘটনা যথেষ্ট উদ্বেগের।”
বস্তুত এই উদ্বেগই আজ ফুটে উঠেছে প্রায় সমস্ত সাংসদের বক্তব্যে। তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায় বলেন, “সিনেমা থেকে সিরিয়াল কিংবা দৈনন্দিন জীবন সব ক্ষেত্রেই রাজনীতিকদের ছোট করে দেখানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।” রাজনৈতিক দর্শন ভিন্নমতের হলেও কার্যত একই সুরে সিপিআই নেতা গুরুদাস দাশগুপ্ত বলেন, “রাজনৈতিক নেতাদের হেয় করে দেখানোর একটি প্রণবতা তৈরি হয়েছে। গোটা সমাজেই একটা সামগ্রিক পচন ও নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে। যার জন্য আমরা দেখছি কখনও নেহরু বা আবার কখনও রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর ভ্রাতৃবধুর সম্পর্ককে বিপণনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।” আর লালু প্রসাদ বলেন, “রাজনীতিকদের অপমান করার জন্য ষড়যন্ত্র চলছে। যাঁদের সংসদে পৌঁছনোর ক্ষমতা নেই তাঁরা এই ভাবে রাজনীতিকদের হেয় করছেন। এঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হওয়া উচিত।” |