বাম-বিদায়ের বর্ষপূর্তির দিনেই বর্তমান ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর তরজা বাধল! চাপানউতোরের কেন্দ্রে এক বছরে সরকারের কাজ।
নিজের দেওয়া প্রতিশ্রুতির ১০০%-এরও বেশি কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে বলে রবিবার ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সরকারের এই ঘোষণার ‘যৌক্তিকতা’ নিয়ে একই দিনে প্রশ্ন তুলেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। |
ঠিক এক বছর আগে ১৩ মে বিধানসভা ভোটের রায়ে রাজ্যে ‘পরিবর্তন’ এসেছিল। রাজভবনে পদত্যাগপত্র জমা দিতে গিয়েছিলেন বুদ্ধবাবু। কালীঘাটে জনতার অভিনন্দনে ভেসেছিলেন মমতা। এক বছর পরে একই দিনে দু’জনে ছিলেন শহরের দুই প্রান্তে। ‘মা-মাটি-মানুষ’কে ‘ধন্যবাদ’ জানাতে এ দিন হাজরা মোড় থেকে রাজাবাজার পর্যন্ত দীর্ঘ মিছিলে হেঁটেছেন মমতা। রাস্তার দু’ধারে অজস্র মানুষকে নমস্কার জানাতে জানাতে দু’ঘণ্টার মিছিল শেষে তাঁর ঘোষণা, “ভোটের আগে যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, তার ১০০ ভাগেরও বেশি কাজ করে দিয়েছি। যে দু’একটা কাজ বাকি রয়েছে, তা-ও এক মাসের মধ্যে করে দেব।”
শুধু ‘মৌখিক’ প্রতিশ্রুতি-পালনই নয়, এক বছরে তাঁর সরকারের কাজের খতিয়ানও আগামী ২০ মে (গত বছর যে দিন মমতার মন্ত্রিসভা শপথ নিয়েছিল) সরকারি ভাবে তুলে ধরা হবে বলে মুখ্যমন্ত্রী জানান। তাঁর বক্তব্য, “এক বছরে উন্নয়ন-প্রগতিতে এগিয়েছে রাজ্য।” তবে ‘১০০%’-এর পরেও তাঁর মন্তব্য, “কাজ করতে না-পারলে পাঁচ বছর বাদে অবশ্যই মানুষ বলবেন। কিন্তু তা বলার সুযোগ দেব না! বলার মতো একটা কাজও বাকি রাখব না!”
রাজ্য সরকারের কাণ্ডারীর এমন ঘোষণাতেই ‘বিস্মিত’ তাঁর পূর্বসূরি! দমদমে সিপিএমের এক জনসভায় গিয়ে বুদ্ধবাবু বলেছেন, “কথার মানেই বোঝা যায় না! কখনও বলছে ৯০ ভাগ, ১০০ ভাগ কাজ করে দিয়েছি। কখনও বলছে, ১০ মাসে ১০ বছরের কাজ করে দিয়েছি! সব কাজ যদি হয়েই গিয়েছে, তা হলে আর টাকা চাইছ কেন? দিল্লির কাছে ভিক্ষা চাইছ কেন?” বুদ্ধবাবু আরও বলেন, “বাজে খরচ তো কম হচ্ছে না! রাস্তায় তিন-বাতি লাগানো হচ্ছে আর সাদা-নীল রং হচ্ছে! মাথায় ঢুকেছে কলকাতাকে লন্ডন করতে হবে! কলকাতার যন্ত্রণা দুঃখ লন্ডনও বুঝল না, কলকাতাও বুঝল না!” বুদ্ধবাবুর দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাটও এ দিন শ্যামনগর এবং পানিহাটির জোড়া সভায় প্রশ্ন তুলেছেন, “মমতার কাছে জানতে চাই, কোন জাদুতে এক বছরে সব সমস্যা মিটিয়ে ফেললেন?” আবার গৌতম দেব বলেছেন, “এক বছর তো আবোল-তাবোল করে কাটিয়ে দিলেন! পরের চার বছর কী করবেন? শেষ দু’টো বছর আমাদের কাজ করতে দেননি। আরও পাঁচ বছর কোনও কাজ না-হলে তো পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা খুব খারাপ হবে!”
সিপিএমের এই ‘আক্রমণ’ সম্পর্কে তৃণমূলের একাংশের ব্যাখ্যা, সরকার গড়ার এক বছরের মাথায় রাজধর্ম পালনের ইঙ্গিত দিচ্ছেন মমতা। আরাবুল ইসলামের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া থেকে শুরু করে ইনফোসিসকে ধরে রাখার চেষ্টা এবং মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টনের সঙ্গে বৈঠক করে রাজ্যে শিল্প আনার ব্যাপারে সক্রিয় হওয়া যার উদাহরণ। আর মমতার প্রশাসক হয়ে ওঠা মানেই সিপিএমের চিন্তা বাড়া। তারা চায় মমতা এখনও বিরোধী নেত্রীর মতো আচরণ করুন। তাতে সিপিএমের রাজনৈতিক ফায়দা। |
বর্ষীয়ান তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “মমতা যে হেতু শিল্পায়নের লক্ষ্যে একের পর এক পদক্ষেপ করছেন, বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচি নিচ্ছেন, সে হেতু সিপিএম জনসমর্থন আরও খোয়ানোর ভয় পাচ্ছে। সেই কারণেই দিশাহীন সমালোচনায় মুখর হয়েছে ওরা।”
এ দিনের মিছিলে মুখ্যমন্ত্রীর হাঁটার কথা ছিল না। মিছিল শুরুর কিছু আগেই তিনি নিজে পথে নামার সিদ্ধান্ত নেন। মমতার কথায়, “৩৪ বছরের সন্ত্রাসের পরে মানুষের স্বাধীনতার এই ঐতিহাসিক দিনটায় মানুষকে ধন্যবাদ-কৃতজ্ঞতা জানাতে পথে নেমেছি।” হাজরা থেকে মিছিল রওনা দেয় আশুতোষ মুখার্জি রোড হয়ে এক্সাইড মোড়ের দিকে। বেকবাগান, মল্লিকবাজার পেরিয়ে মিছিল ছুঁয়ে যায় আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। সেখানেও উৎসুক ভিড়। তাঁদের নমস্কার জানাতে জানাতে ‘বাম-দুর্গ’ পিছনে ফেলে রাজাবাজারের দিকে এগোলেন মমতা। রাজাবাজার মোড়ে পৌঁছেই বুদ্ধবাবুদের আক্রমণের ‘জবাব’ দিয়েছেন তিনিও। বলেছেন, “আমাদের কাজ দেখে সিপিএমের বন্ধুদের হিংসা হচ্ছে! তাই এখন তারা মাওবাদীদের সঙ্গে মিলে মিউমিউ করছে!”
|