তোমার জীবনটা কিন্তু তোমার নিজের
আমার জীবনের প্রধান সমস্যা হচ্ছে আমার মা-বাবার মধ্যে খুব অশান্তি হয়। সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি মা-বাবা নিজেদের মধ্যে খুব ঝগড়া, ঝামেলা করে। এতে আমার পড়াশোনার খুব ক্ষতি হচ্ছে। মা-বাবাকে অনেকবার অনেক ভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোনও কিছুতে কোনও লাভ হয়নি। কিছু দিন হয়তো ঠিক থাকে, তার আবার যে-কে-সেই। পরীক্ষায় খারাপ ফল হওয়ার জন্য ওদের কাছে বকা খেতে হচ্ছে কিন্তু ওদের কিছুতেই বোঝাতে পারছি না যে আমার খারাপ ফলের জন্য ওরাও কিছুটা দায়ী। আমি যখন আমার আর সব বন্ধুবান্ধবদের দেখি যে ওরা কত সুখে শান্তিতে আছে, আমার তখন খুব কষ্ট হয়। কী করলে যে মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া অশান্তি কমবে বুঝতে পারছি না। দু’জনের কেউই আমার কষ্টটা বুঝতে পারে না। আমি অনেক বার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছি কিন্তু সেটাতেও সফল হতে পারিনি। আমি কী করব?
ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
তোমাকে বলছি
এ সব ক্ষেত্রে কোনও সহজ সমাধান থাকে না, অনেক সময়েই সমস্যাটা নিয়েই অনেক দিন চলতে হয়। তাই প্রথমেই বলি, তোমায় নিজের মনকে অনেক বেশি শক্ত করতে হবে। তুমি লিখেছ, অনেক বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছ। এই একটা কথাই জানিয়ে দিচ্ছে, তুমি মা-বাবার অশান্তি নিয়ে কতখানি বিচলিত। সেটা একটুও অস্বাভাবিক নয়, তোমার বিচলিত হওয়ার নিশ্চয়ই যথেষ্ট কারণ আছে। কিন্তু সমস্যা জটিল এবং গভীর হলেই আমাদের দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়। তাই তোমাকে দু’একটা পরামর্শ দিই। নিতান্তই কাণ্ডজ্ঞান থেকে।
তোমার মা-বাবার মধ্যে কেন অশান্তি হয়, সেটা তুমি লেখোনি। ধরে নিতে পারি, কোনও এক বা একাধিক বিষয়ে তাঁদের মতানৈক্য আছে, ক্রমাগত মনোমালিন্য ঘটছে। সাধারণ ভাবে বড়দের ‘নিজেদের’ সমস্যার মধ্যে ছোটদের জড়িয়ে পড়াটা আমাদের সমাজে ‘ঠিক’ বলে মনে করা হয় না। কিন্তু প্রথমত, সমাজ পালটাচ্ছে, পরিবারের চেহারা এবং চরিত্র পালটাচ্ছে, সংসারের নানা বিষয়ে ছোটদের কথা বড়রা শুনছেন, সেই কথায় গুরুত্ব দিচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, তোমার ক্ষেত্রে ধরে নিতে পারি, তুমি ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক বড়দের তর্কাতর্কি বা মনোমালিন্যের মধ্যে ইতিমধ্যেই কিছুটা জড়িয়ে পড়েছ। তাই আমি বলব, তুমি নিজে থেকেই ওঁদের সঙ্গে কথা বলো। যখন ওঁদের মধ্যে খুব বেশি অশান্তি চলছে, সেই সময়ে নয়, যখন সম্পর্ক কিছুটা ঠিকঠাক থাকছে সেই সময়টাতে কথা বললে কাজ হবে।
প্রথমে হয়তো দুজনের সঙ্গে আলাদা আলাদা ভাবে কথা বলা ভাল, তবে দুজনকেই জানিয়ো যে তুমি অন্য জনের সঙ্গেও কথা বলছ। এবং একই সঙ্গে এটাও জানিয়ো যে, ওঁরা তোমাকে যা বলছেন, সেটা অন্য জনকে পুরোপুরি জানিয়ে দেওয়ার কোনও বাধ্যবাধকতা তোমার নেই। তবেই হয়তো ওঁরা তোমাকে খোলাখুলি কিছু কথা বলতে পারেন। এতে ওঁদের কিছুটা সুবিধে হতে পারে। তোমার নিজের অন্তত সুবিধে হবে। হতেই পারে, ওঁরা প্রথমে হয়তো কথা বলতে রাজি হবেন না। কিন্তু তোমাকে খুব ভাল করে, কিন্তু একটু দৃঢ় ভাবে ওঁদের জানাতে হবে যে, তোমার প্রতি ওঁদের একটা দায়িত্ব আছে, ওঁদের কথা জানার অধিকার তোমার আছে।
এ বার একটা অন্য দিকের কথা বলি। দেখ, তোমার মা-বাবার জীবন আর তোমার জীবন, এই দুটো বা তিনটে জীবনের মধ্যে নিশ্চয়ই একটা গভীর সংযোগ আছে, আমাদের পারিবারিক বা সামাজিক সম্পর্কগুলো তো এই কারণেই মূল্যবান। কিন্তু এটাও খুব বড় সত্য যে, আমাদের প্রত্যেকের জীবনগুলো নিজস্ব এবং স্বতন্ত্র। মা, বাবা, ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে প্রতিটি পরিচয়ই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার বাইরেও নিজের কাছে নিজের একটা দায়িত্ব থাকে। বাবা-মা নিজেদের জীবনটাকে নিজেদের মতো করে বেঁচে আসছেন। হয়তো সেই জীবনে নানা সমস্যা, নানা সঙ্কট। তোমার জীবনটা কিন্তু তোমারই। মা-বাবার অশান্তির প্রভাব তোমার জীবনে পড়বে, সেটা স্বাভাবিক, কিন্তু সেই প্রভাবটাকে সব কিছু গ্রাস করে ফেলতে দিয়ো না। বাস্তববাদী হওয়া খুব জরুরি। নিজের জন্য জরুরি, বাবা-মায়ের জন্যও জরুরি। ভেবে দেখো, তুমি যদি ওঁদের অশান্তির তাড়নায় নিজের জীবনটাকে নষ্ট করো, বিশেষ করে নিজের পড়াশোনার ক্ষতি করো, তার পরিণাম ওঁদের পক্ষেও শুভ হতে পারে না। বরং তুমি নিজের পায়ে দাঁড়ালে শেষ পর্যন্ত ওঁদেরও মঙ্গল।
অনেক সময়েই আমাদের প্রিয়জনের প্রতি কঠোর হতে হয়, তাঁদের ভালর জন্যই হতে হয়। এবং, একই ভাবে, নিজের প্রতিও কঠোর হতে হয়। অনেকটা অসুখ করলে মুখ বিকৃত করে তেতো ওষুধ খাওয়ার মতো কিংবা ব্যথা সহ্য করে ইঞ্জেকশন নেওয়ার মতো। মুখ বিকৃত করব, ব্যথায় একটু আর্তনাদও করতে পারি, কিন্তু ওষুধটা খাব, ইঞ্জেকশনটা নেব। কারণ জানি, ওতে ভাল হবে। সেই রকমই, দরকার হলে, মা-বাবার অশান্তিকে মন থেকে কিছুটা অগ্রাহ্য করে নিজের কাজ করতে হবে। আমরা অনেক সময়েই ‘শক্ত’ হতে বলি। শক্ত হওয়া মানে কিছুটা নির্মম হওয়াও বটে। সেটা সুখের নয়, কষ্টের। কিন্তু মাঝে মাঝে সেই কষ্টটা মেনে নিতে হয়। নিজের এবং অন্যদের ভালর জন্যই।
বাবা-মাকে বলছি
ধরে নিচ্ছি, আপনাদের অশান্তির বড় কারণ আছে। সেই অশান্তি দূর করার উপায় আপনাদেরই খুঁজে বার করতে হবে, তার কার্যকারণসূত্র কিছুই না জেনে সে বিষয়ে উপদেশ দেওয়ার কোনও মানে নেই। কিন্তু এইটুকু বলব যে, আপনাদের আচরণ যদি সন্তানকে মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে ঠেলে দেয়, তার জীবনের ক্ষতি করে, সেটা আপনাদের পক্ষে কেবল বেদনার নয়, অসম্মানেরও। ভেবে দেখলে, আমরা নিজেরাই নিজেদের সবচেয়ে বড় অসম্মান করতে পারি। সন্তানের কাছে ছোট হয়ে যাওয়া নিশ্চয়ই তেমন এক অসম্মান। ঠিক উপদেশ নয়, বরং নেহাতই একটা পরামর্শ হিসেবে বলি, আপনাদের সন্তান কেন ভাল করে পড়াশোনা করতে পারছে না, সেটা বোঝার চেষ্টা করুন, শুধু বকাবকি করলে ওর বিড়ম্বনা আরও বাড়বে, আপনাদেরও। ওকে ‘বড়’ হিসেবে দেখার চেষ্টা করুন। মানসিক যন্ত্রণা ওর মনের বয়স এমনিতেই অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে, হয়তো কিছুটা বুড়িয়ে দিয়েছে। আপনারা দুজনেই বরং সন্তানের সঙ্গে একটু খোলাখুলি কথা বলুন, আপনাদের সমস্যাগুলো নিয়ে ওর সঙ্গে আলোচনা করুন। তা হলে ও একটা ভাল অর্থে বড় হয়ে উঠতে পারবে।
ছেলেমেয়েকে নিয়ে মা-বাবার সমস্যা? নাকি মা-বাবাকে নিয়ে ছেলেমেয়ের সমস্যা? পড়ার খরচ
নিয়ে অভিভাবকের দুশ্চিন্তা? দূরের শহরে পড়তে যাওয়ার নামে মেয়ের গায়ে জ্বর আসা? যে
মুশকিলই হোক না কেন, পরিবারের সবাই মিলেই সমাধানে পৌঁছতে হবে। এ বার থেকে
‘প্রস্তুতি’-ও কথা বলবে গোটা পরিবারের সঙ্গেই। অভিভাবকদের বা সন্তানের যে কোনও দুশ্চিন্তার
কথা আমাদের জানান (এবং জানাও) নিজেদের সমস্যা। সুচিন্তিত উত্তর দেবেন বিশেষজ্ঞরা।

ইমেল: prastuti@abp.in বিষয়: Haate Haat।

অথবা, চিঠি পাঠান (এবং পাঠাও) এই ঠিকানায়:
হাতে হাত, প্রস্তুতি,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
এ বি পি প্রাঃ লিঃ,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০ ০০১


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.