|
|
|
|
|
|
উজ্জ্বল এক ঝাঁক স্বপ্নের দিন কি শেষ? |
বছর দুয়েক হল, তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প মন্দার কালো মেঘ উড়িয়ে দিতে পেরেছে।
তবুও সাবধানের মার নেই।
জানালেন গার্গী গুহঠাকুরতা |
মন্দার ভূত অনেকটাই ঔজ্জ্বল্য কেড়ে নিয়েছিল। তিরিশের কোঠায় পৌঁছনোর আগেই বাড়ি, গাড়ি, সপরিবারে বাৎসরিক বিদেশ ভ্রমণে অভ্যস্ত ‘হিপ অ্যান্ড হ্যাপেনিং’ জনতার বাধাহীন দৌড়ে রাশ টেনে ধরেছিল সেই ভূত। তথ্যপ্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর শিল্প মন্দার ওই কালো মেঘ উড়িয়ে দিতে পেরেছে বছর দুয়েক আগেই। কিন্তু তবুও সাবধানের মার নেই। এই আপ্তবাক্যে ভরসা রেখেই ভারতে নতুন প্রজন্মের শিল্প এগোচ্ছে নয়া লক্ষ্যমাত্রার দিকে।
শুধুই বাইরের চাকচিক্য নয়। তথ্য পরিসংখ্যানও এই নয়া লক্ষ্যের কথা বলছে। ২০১১-১২ আর্থিক বছরে ১০,০০০ কোটি মার্কিন ডলারের মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলা তার প্রথম ধাপ। গত দশ বছরে এই শিল্প ২২ শতাংশ হারে বেড়েছে। প্রায় তিরিশ লক্ষ মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান। পরোক্ষ ৯০ লক্ষ। কিন্তু এই সংখ্যা মাথায় রেখেও ন্যাসকমের দেওয়া বৃদ্ধির হিসেব বেশ সাবধানী। তার কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে স্থিতিশীলতার অভাব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইয়োরোপের বাজারে চাহিদার পারদ ততটা চড়া নয়। ২০১১-১২তে ১৬ শতাংশের বেশি বৃদ্ধির হার ছিল। ন্যাসকম জানিয়েছে ২০১২-১৩ আর্থিক বছরে সেই বৃদ্ধির হার নেমে দাঁড়াবে ১১-১৪ শতাংশে। তবে টাকার হিসেবে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে আয় হবে ১৩-১৬ শতাংশ।
সাবধানী পা ফেলেই বাজি জিতে নিতে চায় ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর শিল্প। ২০২০ সালে ২২,৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের স্বপ্নটাও ছুঁয়ে ফেলার লক্ষ্যে অনড়।
তাই ছাত্রছাত্রীদের ‘আই টি প্রফেশনাল’ হয়ে ওঠার প্রতি অদম্য আকর্ষণ। কর্মসংস্থান ও বেতনের পরিমাণ, দুটি ক্ষেত্রেই পারদ চড়িয়ে দিয়েছিল এই তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প। |
|
আর এই আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নের ভিত শুধুই সফট্ওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রবেশিকা নয়। তার চেয়ে অনেকটা মাটির কাছাকাছি বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং বা ছোট করে বি পি ও।
মাথায় হেডফোন। মুখের কাছে মাউথপিস। সঙ্গে ঝকঝকে হাসি। নিয়ন আলোর ঝলকানিতে হোর্ডিং-এ সাফল্যের চাবিকাঠির বিজ্ঞাপন।
শহরের বড় রাস্তায়। বা বড় শহরের লাগোয়া মফস্সল এলাকায় এমন সব ঢাউস হোর্ডিং আকচার আকাশের মুখ ঢেকে দিচ্ছে। আম জনতার কাছে অবশ্য তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের এটাই মুখ। কল সেন্টার। বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বি পি ও)। অনর্গল ইংরেজি। রাতভোর কাজ। মাস গেলে ভালো বেতন। গাড়ি করে অফিস থেকে বাড়ি যাওয়া-আসা। সাধারণ ছাত্রের তকমা-আঁটা সদ্য চাকরি পাওয়ার নিরিখে যে বেতন অনেক ক্ষেত্রেই আরও বেশি ডিগ্রিধারীদের সমান সমান।
বলা যেতে পারে ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের রমরমা অনেকটাই এঁদের হাত ধরে শুরু। দিব্যি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল মাইনের বহর। সঙ্গে বিবিধ ‘পার্কস’ বা বাড়তি আয়। চাকরির সুযোগও অনেক। আমেরিকা, ব্রিটেন-সহ বিশ্বের তাবড়
উন্নত দেশগুলির সব সংস্থা প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কারণ তুলনামূলক কম দামে দক্ষ কর্মীর যোগান। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে কর্মসংস্থানের নিরিখে এখনও বি পি ও শীর্ষে। মন্দার বাজারে তাই সবচেয়ে বেশি সমস্যার মুখে পড়েছিল বি পি ও সংস্থাগুলি।
‘পিঙ্ক স্লিপ’ বা চাকরি থেকে ছাঁটাই-এর সমস্যা তাড়া করছিল এতদিন। মন্দার ঝড় থেমে যাওয়ার পরে এখন অবশ্য আবার নতুন ছবি। যদিও ভারতকে কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে ফেলে দিচ্ছে ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়ার মতো দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি। ন্যাসকমের অবশ্য দাবি, বি পি ও-র গন্তব্য হিসেবে এখনও ভারত তালিকার
শীর্ষে রয়েছে।
বি পি ও-র পাশাপাশি অ্যানিমেশন বা লিগাল প্রসেস আউটসোর্সিং-এর মতো কাজের সুযোগও তৈরি হচ্ছে। মুম্বই, হায়দরাবাদ ও বেঙ্গালুরু এখনও অ্যানিমেশন শিল্পে বেশ কয়েক পা এগিয়ে
রয়েছে। বিশ্ব জুড়ে অ্যানিমেশন শিল্পের পরিমাণ ১২,২০০ কোটি ডলার। ভারতে এখনও এই ব্যবসা শৈশবে। এখানে এই ব্যবসার অঙ্ক ১০০
কোটি টাকা। এ ছাড়াও রয়েছে ‘লিগাল প্রসেস আউটসোর্সিং’ (এল পি ও)। ফরেস্ট রিসার্চ-এর সমীক্ষা বলছে, ২০১৫ সালের মধ্যে ভারতে ‘লিগাল প্রসেস আউটসোর্সিং’ ব্যবসার পরিমাণ দাঁড়াবে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি ডলার। প্রয়োজন হবে প্রায় ৮০ হাজার আইনজীবী। আপাতত এই ব্যবসার অঙ্ক ৪০ কোটি ডলার। বিশেষজ্ঞদের মতে, মোট বাজারের মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশ ব্যবসা হচ্ছে এখন। মূলত আর্থিক সাশ্রয়ের কথা মাথায় রেখেই বিদেশি সংস্থারা নিজেদের আইনি কাজ এল পি ও-র মাধ্যমে করছে। যে কাজ করতে বিদেশি আইনজীবীরা ঘন্টায় ২০০ ডলার নেবেন, একই কাজ এখানে করতে লাগবে ৪০ ডলার। |
|
কর্মসংস্থানের নিরিখে এই শিল্প কিন্তু বেশ এগিয়ে রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে ২০১২ সালে তথ্যপ্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর শিল্পে প্রায় ৩ লক্ষ নতুন কর্মসংস্থান হবে। বেতন বৃদ্ধি হবে ১২ শতাংশ হারে। ২০১১ সালে গড় বেতন বৃদ্ধির হার ছিল ১১ শতাংশ। আর তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের ভিতরের ছবি? কর্মসংস্থানের নিরিখে বি পি ও এখনও শীর্ষে। আন্তর্জাতিক সংস্থা গার্টনারের হিসেব বলছে ২০১৩ সালে বিপিও ব্যবসার অঙ্ক দাঁড়াবে ২০০ কোটি মার্কিন ডলার।
তথ্যপ্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর শিল্পের বাড়বাড়ন্তের কারণ হিসেবে কয়েকটি বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা:
১। গ্রামাঞ্চলে এই শিল্পের বিকাশ - বর্তমানে ‘রুরাল বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং’ থেকে এক কোটি মার্কিন ডলারের বেশি আয় হয়। কম খরচে সম্ভাবনাময় কর্মী পাওয়ার টানে গ্রামাঞ্চলে বি পি ও খোলার দিকে নজর দিচ্ছে বড় সংস্থাগুলি। উইপ্রো, ইনফোসিস-এর মতো সংস্থা দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় রুরাল বিপিও খুলেছে। শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে বি পি ও খোলার খরচ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কম। ন্যাসকমের তথ্য অনুযায়ী এখন রুরাল বি পি ও-তে ৫০০০ মানুষ কাজ করেন। ২০১৩-১৪ সালে তা দশ গুণ
বেড়ে দাঁড়াবে।
২। তথ্যপ্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর শিল্পে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এপ্রিল ২০০০ থেকে
নভেম্বর ২০১১ পর্যন্ত সফট্ওয়্যার ও হার্ডওয়্যার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১,১০০ কোটি মার্কিন ডলার।
৩। ‘অনলাইন’ বিক্রি - ই-কমার্সের রমরমায় বাড়ছে বিক্রিবাটার জগতে কাজের সুযোগ। এক কোটি ৭০ লক্ষ ক্রেতা অনলাইনে বাজার করেন।
৪। ক্লাউড কমপিউটিং -প্রযুক্তির এই
নবতম সংযোজনে এ সংক্রান্ত ব্যবসার পরিমাণ এখন ৪০ কোটি মার্কিন ডলার। ২০১৫ সালে তা দাঁড়াবে প্রায় ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার। ছোট ও মাঝারি শিল্পের জন্য এই প্রযুক্তি অত্যন্ত লাভজনক।
৫। সরকারি প্রচেষ্টা - ই-গভর্নেন্স প্রকল্পের মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তি ও তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর শিল্পের ব্যবসার নতুন রাস্তা তৈরি হয়েছে।
আর এই বিশাল সম্ভাবনার শরিক হতে ক্লাসের ফার্স্ট বয় বা গার্ল হতে হবে না। মোটামুটি পড়াশোনার পাশাপাশি চাই কাজের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে নিজের লক্ষ্য ঠিক করা। ইতিবাচক মনোভাব, আত্মবিশ্বাস ও নিজেকে প্রকাশ করার সঠিক ভাষা - মূলত এ ধরনের গুণই যে কোন সাধারণ মানের শিক্ষিত ছেলেমেয়েকে চাকরির উপযুক্ত বলে মনে করেন মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞরা। ‘স্পেশালাইজেশন’ বা বিশেষ কোনও দক্ষতার প্রশ্ন আসবে অনেক পরে। চাকরির প্রথম বেড়া টপকাতে এই ‘সফট স্কিল’ থাকাটাই জরুরি। বিজ্ঞান, কলা বা বাণিজ্যের স্নাতক থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইঞ্জিনিয়ার, সকলের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। |
|
|
|
|
|