নিকাশি খাল নেই। চাষের কাজে জলের জোগান বলতে ভরসা শ্যালো মেশিন। এই অবস্থায় ক্রমাগত ভূগর্ভের জল তুলে ফেলায় নেমে যাচ্ছে জলস্তর। ফলে একদিকে যেমন অকেজো হয়ে পড়ছে এলাকার নলকূপগুলি। তেমনই অন্য দিকে দিনের পর দিন এ ভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে পানীয় জলের চরম সঙ্কট দেখা দেবে বলে মনে করছেন জল সম্পদ দফতরের আধিকারিকরা।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুর-১ ব্লকের অধীনে উত্তর ও দক্ষিণ লক্ষ্মীনারায়ণপুর-এই দুই গ্রাম পঞ্চায়েতে নিকাশিখাল নেই বললেই চলে। যে দু’একটি খাল আছে তাতে নোনাজল থাকায় চাষের কাজে ব্যবহারের অনুপযুক্ত। অথচ ওই এলাকা জুড়ে রয়েছে কয়েক হাজার বিঘা কৃষিজমি। এলাকার অধিকাংশ মানুষ কৃষিজীবী। সেচের অভাবে বর্ষার চাষ ছাড়া অন্য চাষ-আবাদ করতে পারতেন না। জলের অভাবে গরমের বোরো ধান থেকে সবজি চাষ বন্ধ রাখতে হত। সমস্যার সমাধানে কয়েক বছর আগে এলাকায় মাঠে শ্যালো পাম্প বসিয়ে ভূগর্ভস্থ জল তোলার ব্যবস্থা হয়। সেই জলেই বর্তমানে কয়েকশো বিঘা জমিতে ধান চাষ ছাড়াও উচ্ছে, বেগুন, লঙ্কা, ঢেঁড়স-সহ বিভিন্ন শাক-সবজি চাষ শুরু হয়েছে। বর্তমানে এলাকায় প্রায় ৮-৯টি শ্যালো চলে। |
কিন্তু জলের জোগানের বিকল্প ব্যবস্থা করা না হলে এ ভাবে ক্রমাগত মাটির নীচের জল তুলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে যে জলের চরম সঙ্কট দেখা দেবে তা নিয়ে বাসিন্দাদের পাশাপাশি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জল সম্পদ দফতরের আধিকারিকরাও। স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, এলাকার নিকাশি খালের প্রয়োজন থাকলেও তা তৈরি হয়নি। নিকাশি খাল থাকলে তা থেকে জলসেচ করা যেত। এ ছাড়া সুন্দরবনের সুতারবাগ নদী থেকে যে জল ঢোকে তা একেবারেই নোনা। ফলে চাষের কাজে অনুপযুক্ত। অন্য দিকে ডায়মন্ড হারবার নদী থেকে মন্দিরবাজার খাল দিয়ে মথুরাপুরের খালে জল ঢোকার মুখ যথেষ্ট বাধার সৃষ্টি হয়েছে। ডায়মন্ড হারবার থেকে মথুরাপুর এই দীর্ঘ পথে খালের উপর যত্রতত্র বড় বড় দোকান, বাড়ি, রাজনৈতিক দলের অফিস তৈরি হয়েছে। ফলে জল নিকাশি ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গিয়ে কোথাও কোথাও খাল একেবারে শুকনো হয়ে গিয়েছে। খালের উপর ঘরবাড়ি তৈরি হওয়ায় তা সংস্কার করা যায়নি দীর্ঘদিন। প্রয়োজন হলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হস্তক্ষেপে ওই সব দখলদারিদের হটাতে পারছে না পঞ্চায়েত থেকে জেলা প্রশাসন।
যত্রতত্র বেআইনি ভাবে শ্যালো পাম্পে ভূগর্ভের জল তুলে এ ভাবে দিনের পর দিন চাষ যে এক সময় জলের সঙ্কট ডেকে আনবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত মথুরাপুর-১ পঞ্চায়েত সমিতি এবং জল সম্পদ দফতর সূত্রে সূত্রে জানানো হয়েছে, সজলধারা প্রকল্পের মাধ্যমে পুকুর কেটে জল সঞ্চয় করে কৃষি কাজে ব্যবহারের ব্যাপারে ভাবনা-চিন্তা করা হচ্ছে।
এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে শ্যালো পাম্পের মাধ্যমে জল সরবরাহ করে আসছেন প্রহ্লাদ হালদার। তাঁর সাফ জবাব, “আমি বে-আইনি ভাবে জল তুলছি না। প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ করে পাম্পের জল কৃষকদের সরবরাহ করি। মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত তিন মাস চাষিদের কাছ থেকে বিঘা প্রতি ১৫ হাজার টাকা নিয়ে জল সরবরাহ করি।”
মথুরাপুর-১ ব্লক তৃণমূলের সম্পাদক লোকেশ প্রামাণিকের অভিযোগ, খালপাড়ে অবৈধ ভাবে নির্মাণের ক্ষেত্রে বাধা দিতে গেলে হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে। ফলে মন্দিরবাজার থেকে মথুরাপুর পর্যন্ত খালের দীর্ঘ ১৫ বছর কোনও সংস্কার হয়নি। যত্রতত্র গজিয়ে উঠেছে বাড়ি, দোকানঘর। শ্যালো পাম্পের বিষয়ে তাঁর বক্তব্য, “সিপিএমের সময় কয়েকটি এবং আমাদের সময় আরও কয়েকটি শ্যালো পাম্প বসেছে। এখন সব বন্ধ করতে গেলে চাষিদের ক্ষতি হবে।” শ্যালো পাম্প বসানোয় ভূগর্ভের জলস্তর যে হু হু করে নামছে তা মেনে নিয়েছেন মথুরাপুর-১ ব্লকের গ্রামীণ জল সরবরাহের সহকারী বাস্তুকার মেহেবুব আলম। তিনি বলেন, “এই এলাকার গ্রামগুলিতে ৮০০ ফুট পাইপ বসালে এক সময় ভাল জলস্তর পাওয়া যেত। এখন হাজার ফুট গভীরে পাইপ বসালেও উপযুক্ত জলস্তর মিলছে না। তা ছাড়া গরম বাড়ায় পানীয় জলের নলকূপ অকেজো হয়ে যাচ্ছে। সমস্যার সমাধানে সজলধারা প্রকল্পের মাধ্যমে ১৫টি প্রকল্প পাঠানো হয়েছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে।”
ওই ব্লকের জল সম্পদ দফতরের সহকারী বাস্তুকার অয়ন দত্তও জলের সমস্যার কথা স্বীকার করেছেন। তাঁর কথায়, “বহু জায়গাতেই দেখছি শ্যালো বসানো হয়েছে। কিন্তু আমাদের এখানে শ্যালো পাম্প বসানোর অনুমতি নিতে আসেনি কেউ। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আনা হয়েছে। নির্দেশ পেলে পাম্প মালিকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” |