বৈশাখের নাম মধুসূদন। জ্যৈষ্ঠের নাম ত্রিবিক্রম। এই দুই মাস ধরে বৈষ্ণব মঠ-মন্দিরে নিত্যসেবার ধারাটাই যায় বদলে। রাধা-কৃষ্ণকে ঘিরে যে উৎসব পরিক্রমা চলে সারা বছর ধরে, তারই নতুন রূপ মেলে এই দুই মাসে।
দেবতাকে আপনজন, ঘরের লোক হিসেবে দেখাটাই ভক্তিরসের একটি লক্ষণ বলে মনে করেন গবেষকেরা। কৃষ্ণভক্তি রসের জোয়ারে যে কারণে তাঁর জন্মদিন পর্যন্ত পালিত হয়। পালিত হয় রাস বা দোলের মতো এমন উৎসব, যা মহাকাব্যের নায়ক কৃষ্ণের ব্যক্তিগত জীবনের কোনও না কোনও ঘটনার উদ্যাপন। তাঁর রথযাত্রা, নৌকাবিলাস ও চন্দনযাত্রাও তাঁকে বড় আদরের আপনজন বলে ভেবে নেওয়ার নানা দিক। তাই তাঁকে ঘিরে যে পুণ্যচর্চা করা হয়, তাতে প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিগ্রহকে এমন ভাবে রাখার আগ্রহও তৈরি হয়, যা এই ভূপ্রকৃতির মধ্যে যাঁদের বাস, তাঁদের পক্ষে প্রয়োজনীয় বা স্বাভাবিক। তাই প্রথমেই যা নজরে পড়ে, তা হল ভোগের পরিবর্তন। গুরুপাক পঞ্চব্যাঞ্জনের বদলে সাধারণত ক্ষীর, মালপোয়া, পরমান্নের জায়গা নেয় শুক্তো, মরসুমী ফল, নানা রকমের শরবত, ঘোল, দই। তারপরে, যত বড় মন্দির তার বিগ্রহের পোশাকের জৌলুসও তত বেশি। ভেলভেট, মখমল, জরি-চুমকির পোশাক কিন্তু এখন রীতি নয়। তার বদলে বিগ্রহকে পরানো হয় আদ্দির পোশাক। তাঁর শোওয়ার জায়গায় পাতা হয় শীতলপাটি। বিগ্রহের গায়ে পুরু করে দেওয়া হয় চন্দনের প্রলেপ। গ্রীষ্মের দ্বিপ্রহরে একটি বড় পাত্রে সুগন্ধী মেশানো জলের মধ্যে রাখা হয় বিগ্রহকে। ব্যতিক্রমী এই সেবার পোশাকী নাম ‘জলকেলি’। নবদ্বীপ হরিসভা মন্দিরের প্রধান বিবেকবন্ধু ব্রহ্মচারী বলেন, “বৈষ্ণব মন্দিরের সেবা সাধারণত আত্মবৎ সেবা। তাই গরমকালে আমরা নিজেরা যেমন জীবনযাপন করলে স্বস্তি পাই তেমনই করা হয় দেবতার জন্যও। সেই কারণেই আমরা দুপুরের ভোগের পরে সুগন্ধী জলের মধ্যে রাখি বিগ্রহকে। তাঁর খাবার ও পোশাকেও আনা হয় পরিবর্তন।” বিগ্রহকে হিকেলে ভোগ দেওয়া হয় চিনি নুন কাসুন্দি দিয়ে মাখা কাঁচা আমের টুকরো। থাকে সরবৎ।” |
মহাপ্রভু মন্দিরের বিষ্ণুপ্রিয়া সমিতির সম্পাদক রূপ গোস্বামী বলেন, “সারা বৈশাখ ধরেই চলে নানা রকমের উৎসব। বিষ্ণুপ্রিয়া ও মহাপ্রভুর বিবাহের তিথিতে গোটা মন্দির ফুলে ফুলে সাজানো হয়। সেই দিন মহাপ্রভুকে পরানো হয় গরদের জোড়। আমরা বলি ফুলদোল, বৃন্দাবনে বলা হয় ফুলবাংলা।”
বলদেব মন্দিরের কিশোর গোস্বামী বলেন, “ফুলদোলে আমরা বিগ্রহকে ফুল দিয়েই সাজাই। গরম ঠেকাতে জুঁই, বেল, গন্ধরাজ কুন্দ ফুলের সাজ পরানো হয়। সারা মাস ধরেই বিকেলে বিগ্রহকে দেওয়া হয় পাঁচ রকম শরবত। চেষ্টা করা হয় তাতেও বৈচিত্র আনতে।” তিনি বলেন, “মহাপ্রভু মন্দির, গোবিন্দ মন্দির, বলদেব মন্দির, মদনমোহন মন্দির, জন্মস্থান আশ্রমের মতো প্রাচীন মন্দিরগুলোতে প্রথা রয়েছে, দেবতার জন্য অন্য মন্দিরে ফল পাঠানোর। দেবতাকে সামনে রেখে প্রীতি সৌহার্দ্যের পরিবেশ তৈরি হয় তাতে।” রাতে দেবতাকে দেওয়া হয় ‘পখাল’। সাদা ধবধবে চালের অন্ন পাক করে সারা দিন সুগন্ধী জলে ভিজিয়ে রাখা হয়। সন্ধ্যায় তার সঙ্গে মেশানো হয় সাদা দই, আদা-কাঁচা লঙ্কা, জিরে গুঁড়ো, গোলমরিচ। সঙ্গে থাকে গন্ধরাজ লেবু। |