সতীশকুমার মাথুর শিরোনাম হইয়াছেন। অ-পদস্থও। তিনি উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুর রেঞ্জ-এর ‘ডি আই জি’ পদে কর্মরত ছিলেন। সুনির্দিষ্ট কিছু লোক ছাড়া বিশেষ কেহ তাঁহাকে চিনিত না। একটি বেফাঁস মন্তব্য তাঁহাকে পাদপ্রদীপের আলোকে আনিল। বস্তুত, অন্ধকারে আনিল। মাথুর মহাশয় দেখাইলেন, প্রদীপের নিম্নে অন্ধকার ঠিক কী পরিমাণ গভীর। তিনি পদস্থ পুলিশ-কর্তা। শিক্ষাদীক্ষা তো বটেই, তাঁহার কাণ্ডজ্ঞানটিও যথাযথ মাত্রায় থাকিবার কথা। অথচ, তিনিই ‘সম্মান’-রক্ষার্থে সন্তান-হত্যার পক্ষে সওয়াল করিলেন। জনৈক ব্যক্তির নাবালিকা কন্যা অপহৃতা হইয়াছিলেন। পুলিশি তৎপরতা প্রার্থনা করিয়া তিনি মাথুর মহাশয়ের নিকট উপনীত হন। তখনই পুলিশ-কর্তার উক্তি: তাঁহার সন্তান এমন করিলে তিনি তাহাকে হত্যা করিতেন, অথবা আত্মহত্যা। গণমাধ্যমে বিষয়টি উঠিয়া আসিবার পরে বিভিন্ন পুলিশ আধিকারিক ঘুরাইয়া ফিরাইয়া তাঁহার বক্তব্যকেই সমর্থন করেন।
সতীশকুমার মাথুর এক প্রকার শাস্তি পাইয়াছেন। সতীশকুমার মাথুরদের কী হইবে? এই মুহূর্তে বিশেষ একটি মন্তব্যের সৌজন্যে সতীশকুমার মাথুর একটি বিশেষ মানসিকতার মুখচ্ছবি। কিন্তু, এই মানসিকতার শরিক আরও বহুজন। আরও বহু মানুষ বিশ্বাস করেন, কন্যাসন্তান যদি তথাকথিত নিম্নতর শ্রেণির কাহারও সহিত বিবাহসম্পর্ক স্থাপন করিবার কথা ভাবে, এবং গৃহ হইতে পলাইয়া যায়, তাহা হইলে পারিবারিক ‘সম্মান’-রক্ষার্থে তাহাকে মারিয়া ফেলাই বিধেয়। এই মানসিকতার বক্তব্যটি সরল। এক, কন্যার নিজস্ব কোনও পছন্দ-অপছন্দ দূরস্থান, তাহার নিজস্ব কোনও অস্তিত্বই থাকিতে পারে না। সে একান্ত ভাবেই পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের সম্পত্তি। দুই, সেই কন্যার বিবাহ (সুতরাং, যৌনসম্পর্ক) যদি তুল্য রূপে সম্মাননীয় কোনও পরিবারে না হয়, তাহা কন্যার পরিবারের ঘোরতর লজ্জা এবং অপমান। তিন, এই অপমানের প্রতিকার করিবার সহজতম উপায় মেয়েটিকে হত্যা করা। ইহাতে সেই নিম্ন-বর্গের স্পর্ধার একটি সমুচিত জবাব দেওয়া যাইবে। কন্যাটিও মরিয়া প্রমাণ করিবে, এমন ‘অপরাধ’ করিলে মৃত্যুদণ্ডই একমাত্র প্রাপ্য।
এমন একটি ত্রি-নীতির বশে সতীশকুমার মাথুর মুখ খুলিয়াছিলেন। তিনি শাস্তি পাইয়াছেন। কিন্তু, সেই শাস্তি কতখানি ‘দৃষ্টান্তমূলক’ হইবে, গণ-মনে তাহা কত দূর ছাপ ফেলিবে, তেমন একটি চিন্তা থাকিয়াই যায়। কারণ, সমস্যার শিকড় অনেক গভীরে। এই জাতীয় বিবাহ একটি কলঙ্ক, দুরপনেয় কলঙ্ক, সুতরাং সেই কলঙ্কিত প্রাণের বিনিময়ে ‘শুদ্ধ’ হইতে হইবে, এই জাতীয় মনোভঙ্গিই সেই সংকটের মূল। পাশাপাশি, আরও অনেকে আছেন যাঁহারা সরাসরি কন্যাসন্তানের হত্যা হয়তো সমর্থন করেন না, কিন্তু মনে মনে মানিয়া লন, এই বিষয়টির ভিতর এক ধরনের ‘কলঙ্ক’ আছে। ইহাতে পরিবারের অসম্মান, ফলে পরিবারের ‘কলঙ্ক’ও বটে। ইহাতে সেই কলঙ্ক-মোচনের বিষয়টিও এক ধরনের বৈধতা পাইয়া যায়। তাহার জন্য সর্বদা যে মেয়েটিকে প্রাণে মারিতে হইবে, এমন নহে। ‘শাস্তি’ দিবার বিষয়টি যদি বৈধ বলিয়া পরিগণিত হয়, তাহা হইলে অন্য নানাবিধ উপায়ে ‘শাস্তি’র বন্দোবস্ত করা সম্ভব। অর্থাৎ, সতীশকুমার মাথুর-গণ মনোভঙ্গির আকারে নানা রূপে সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিদ্যমান। সেই মানসিকতাটির মোকাবিলা করা জরুরি। |