আবার কার্টুন বিতর্ক। এ বার এন সি ই আর টি প্রণীত একাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকে মুদ্রিত নেহরু ও অম্বেডকরের ব্যঙ্গচিত্র লইয়া, যাহাতে সংবিধান রচনায় বিলম্বের জন্য নেহরুর অসন্তোষ ব্যক্ত হইয়াছিল। শঙ্করের ব্যঙ্গচিত্রটি অঙ্কিত হয় ছয় দশক আগে। প্রকাশিতও হয় তখনই, অর্থাৎ সেই ১৯৪৯ সনেই, যখন সংবিধান প্রণয়নের গুরুতর কৃত্যটি সম্পাদিত হইতেছিল। জওহরলাল নেহরু কিংবা বাবাসাহেব অম্বেডকর, কেহই ওই কার্টুন দেখিয়া রুষ্ট হন নাই। কেননা ভারতীয় গণতন্ত্রের সেই উদ্বোধনের কালপর্বটিতে অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন রাজনীতিকরা গণতন্ত্রের মর্ম আত্মস্থ করিয়াছিলেন। সমালোচনার প্রতি অসহিষ্ণুতা নয়, ভিন্ন মতের প্রতি খড়্গহস্ত বা রক্তচক্ষু হওয়া নয়, বরং শান্ত ভাবে সমালোচনাকে গ্রহণ করা, তাহা হইতে প্রয়োজনীয় শিক্ষা অর্জন করাই ছিল তাঁহাদের সংস্কৃতি। আজ অর্ধশতাব্দীরও পরে সহসা সেই ব্যঙ্গচিত্রটি ‘অসহ্য’ মনে হইতেছে। কেন? কেন সংসদে প্রসঙ্গটির অবতারণা মাত্র কার্টুনটি ছাপার বিরুদ্ধে সমস্বর ধিক্কার এবং তাহার চাপে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর তরফে কার্টুন-সংবলিত পাঠ্যবই প্রত্যাহারের ঘোষণা?
গণতান্ত্রিক রাজনীতির অনুশীলন কি তবে ভারতে রুদ্ধ হইতেছে? অংশত তাহা সত্য। তবে তাহার একটি বড় কারণ আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে ভোটের স্বার্থে তোষণ করার অনৈতিক আগ্রহ। তাই রাজ্যসভায় দাঁড়াইয়া মায়াবতী অম্বেডকরের ‘অমর্যাদা’র প্রতিকার না হইলে সভা অচল করিয়া দিবার হুমকি দিতে পারেন। দলিতের ক্ষমতায়ন নিঃসন্দেহে অম্বেডকরের রাজনৈতিক কর্মসূচির অন্যতম স্তম্ভ ছিল, যদিও মায়াবতীর বহুজনসমাজের রাষ্ট্রীয় প্রকল্পটি সেই কর্মসূচির কতটা অনুসারী, সে বিষয়ে গুরুতর সংশয় আছে। তথাপি দলিত নেতানেত্রীদের কাহারও মনে হইতেই পারে যে, আলোচ্য ব্যঙ্গচিত্রটিতে বাবাসাহেব যথাযথ ভাবে চিত্রিত হন নাই। এই মনে-হওয়া এবং তাহা ব্যক্ত করার অধিকার গণতন্ত্রের সুষ্ঠু বিকাশের পূর্বশর্ত। একই ভাবে ইহার বিপরীত ধারণা পোষণ বা ব্যক্ত করার অধিকারও গণতন্ত্রেই মঞ্জুর করিতে হয়। ব্যঙ্গচিত্রটির উপর কালি বুলাইয়া দিবার কিংবা বইটির প্রকাশনা বন্ধ করিয়া দিবার যে-রীতি, তাহাকেই সাংস্কৃতিক স্বৈরাচার বলে। কিছু কাল আগে সলমন রুশদির সাহিত্য-উৎসবে যোগদানে বাধা সৃষ্টির মধ্যেও সেই সংকীর্ণ অসহিষ্ণুতা প্রকট হইয়াছে। সে ক্ষেত্রেও ভোট-রাজনীতির সুস্পষ্ট ক্রিয়া ছিল উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনে সংখ্যালঘু ভোটকে বিরূপ করিয়া না- তোলার তাগিদ ছিল। এ ক্ষেত্রেও দলিত ভোট পুরোপুরি মায়াবতীর দিকে ঠেলিয়া না-দিবার তাড়না সক্রিয়। উপরন্তু আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নিজ প্রার্থীকে জিতাইতে হইলে ইউ পি এ সরকারের আবশ্যক হইবে মায়াবতীর সাংসদদের সমর্থন। তাই সংসদে কোলাহল শুরু হইতে-না-হইতেই মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী কপিল সিব্বল সরকারের নতজানু হওয়ার সিদ্ধান্ত জানাইয়া দেন। এই আত্মসমর্পণ শুভবুদ্ধির কাছে নয়, সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থের কাছে, যে-স্বার্থ কখনও বৃহৎ ও মহৎ-এর কল্পনা করে না, আত্মসমীক্ষা, আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধির পরীক্ষিত কর্মপথ হইতে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও জনসমুদয়কে আত্মপর হইতে প্ররোচিত করে। নেহরু, ইন্দিরা-সহ শাসক দলের নেতাদের অসংখ্য বিদ্রুপে বিদ্ধ করিয়াও ব্যঙ্গচিত্রী কেশব ‘শঙ্কর’ পিল্লাই উপর্যুপরি পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ ও পদ্মবিভূষণ উপাধিতে অলঙ্কৃত হইয়াছিলেন। সেটা ছিল ভারতীয় গণতন্ত্রের সুবর্ণ যুগ। যুক্তিবাদী, কুসংস্কারবিরোধী অম্বেডকরকে তখনও ‘মসিহা’ বানানো হয় নাই। তাঁহার পৌত্র প্রকাশ অম্বেডকর অবধি বলিয়াছেন, এই ব্যঙ্গচিত্রে তিনি আদৌ রুষ্ট হন নাই। কিন্তু তাঁহাকে ব্যবহার করিয়া যাঁহারা রাজনীতির আখের গুছাইতে ব্যগ্র, সেই নেতা-মন্ত্রী-সরকার এমন সুযোগ হাতছাড়া করিবেন কেন! |