‘ওয়েলকাম টু দ্য ল্যান্ড অফ লিলিপুট্স।’ দেশের প্রথম বামনদের গ্রামে স্বাগত।
গালিভার বৃত্তান্তের সঙ্গে মিল খুঁজে লাভ নেই। আর পাঁচটা গ্রামের মতোই চারপাশ। গাছপালা, কাঁচা-পাকা ঘড়বাড়ির মধ্য দিয়ে ইট-মাটির রাস্তাটা নেমে গিয়েছে। ভুটান সীমান্তের অদূরে, উদালওড়ির টংলা বাজার ছাড়িয়ে কিলোমিটার দেড়েক। গ্রামের মধ্যেই লুকিয়ে আর একটা গ্রাম। চাটাই ঘেরা বসতের ভিতরে ঢুকে, এঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর অনুভব করা গেল, দিনের পর দিন ‘উখো’ (লম্বা) মানুষদের তাচ্ছিল্য, ব্যঙ্গবিদ্রূপের সঙ্গে লড়াই করে কী এক এক অসামান্য উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছেন ‘বাওনা’রা (বামন)।
এক সময় নাটককেই নিজেদের প্রমাণ করার হাতিয়ার করে লড়াইটা শুরু হয়েছিল আড়াই থেকে বড় জোর তিন ফুট উচ্চতার মানুষগুলির। প্রেরণা জুগিয়েছিলেন অবশ্য উদারহৃদয় নাটকপাগল এক ‘উখো’ই। তাঁর নাম পবিত্র রাভা। ২০০৩ সালে দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা থেকে পাঠ নিয়ে টংলায় নিজের প্রত্যন্ত গ্রামে ফেরা যুবকটি বামনদের প্রতি সমাজের অবহেলা দেখে মর্মাহত হয়েছিলেন। তাই তাঁর নিজের হাতে গড়া নাটা দল দাপোন-এ (দর্পণ) পবিত্র টেনে আনলেন বামনদের। ২০০৮ সালে খর্বকায় মানুষগুলিকে নিয়ে করলেন কর্মশালা। দেড় মাসের কর্মশালার শেষে ২৩ জন বামন ও বিশালবপু সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে মঞ্চস্থ করলেন নাটক ‘কিনো কঁও’। গুয়াহাটি, কোকরাঝাড়, ডিব্রুগড় হয়ে সে নাটক পাড়ি দেয় দিল্লি। ‘স্বাভাবিক’ দর্শককুলের চেতনায় চাবুক মেরে যায় পবিত্রর বামন বাহিনী। ‘দিল্লি জয়’ করে বিমানে চেপে ঘরে ফেরার পর বামনদের নিয়ে বিদ্রূপ করাটা কমে। আর এখান থেকেই শুরু হয় আর এক স্বপ্নের। বাওনাদের নিজস্ব এক নয়া বসতের।
বামনদের সেই গড়তে চলা আপন রাজত্বে পা দিয়েই বোঝা গেল, প্রতিজ্ঞায় এঁরা অটল। গাঁওবুড়া অক্ষয়কুমার দাস। উচ্চতা মেরেকেটে আড়াই ফুট। মুখে সদাই হাসি। বললেন, “শিরদাঁড়াটা শক্ত হয়েছে খানিকটা। এমন একটা পৃথিবী গড়তে চলেছি, যেখানে কেবল উচ্চতার জন্য আপনাদের মতো ‘স্বাভাবিক’ মানুষদের কাছে খেলার জিনিস হয়ে থাকতে হবে না।” |
১৮ বছর ধরে মুনলাইট সার্কাসে জোকারের চাকরি করা জেমস দইমারি বলে উঠলেন, “আমরা ‘বাওনা’রা কাজ কিছু কম পারি না। হতে পারে, আমাদের দুঃখ-কষ্ট বাইরের সমাজ বোঝেনি। তবে, আমরা বুঝি শরীর কখন কী চায়। গল্প করুন। চা আসছে।”
অক্ষয় ও জেমস, দু’জনই বিবাহিত। স্ত্রীরা লম্বা। ছেলেপুলে নিয়ে ভরা সংসার। নিজ গ্রামে, যাতায়াত রয়েছে নিয়মিত। তবে, বামনদের যৌথ পরিবার, হাতে হাতে নিজেদের নতুন গ্রামকে গড়ে তোলার স্বপ্নে মশগুল। গ্রাম গড়া শেষ হলেই সপরিবারে চলে আসবেন সেখানে।
অক্ষয় বললেন, “আমি এত্তটুকু। তবু কেন জানি না বাড়ির লোকের আপত্তি সত্ত্বেও আমায় বিয়ে করে ফেলেছিল নুমোলি। এখন আমাদের ছেলে ম্যাট্রিক দেবে। মেয়ে ১২ বছরের। দু’জনেরই লম্বা গড়ন।” জেম্সও হাসতে হাসতে বললেন “আমার যে বউ হয় সে আমার সার্কাসেই কাজ করত। খালি ছুটি চাইত। ম্যানেজার একদিন শর্ত দিলেন, ‘বাওনা জোকারকে বিয়ে করতে হবে।’ জন্মভূমি যাওয়ার লোভে সেই শর্তেই রাজি হয় বেচারি। এখন আমাদের পাঁচ মেয়ে। দু’জন বামন হলেও তিনজন স্বাভাবিক।”
কিন্তু নাটকের অঙ্গন পেরিয়ে এ বারের স্বপ্নটা আরও বড়। টংলা বাজার থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে বামনদের আপাতত থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সেখান থেকে আরও তিন কিলোমিটার ভিতরে গড়ে উঠছে দেশের মধ্যে প্রথম, বামনদের নিজস্ব গ্রাম। মডেল সামনে রেখে পবিত্র বলেন, “চার বিঘা এলাকায় পুকুর, অসমিয়া ও বড়ো মাধ্যমের স্কুল। ৮ X ১০ ফুটের খান পনেরো ঘর। একটি নামঘর, পাঠাগার, কর্মশালা, বৃত্তিমূলক শিক্ষার ঘর, প্রেক্ষাগৃহও গড়া হবে। এক প্রান্তে, উন্মুক্ত মঞ্চও গড়ব ভাবছি। থাকবে প্রবীণ মানুষদের বসতি। ফুটবল ও বাস্কেটবল কোর্ট। দলে ২৩ জন থাকলেও আশপাশের সব এলাকা মিলিয়ে ৭০ জন বামন রয়েছেন। সকলকেই এই গ্রামে নিয়ে আসতে চাই।”
মৃগেন বরুয়া, রঞ্জিত দাস, জ্যোতি রাংজবংশী, দিলীপ কাকতিরা হাতে হাতে গড়ে তুলছেন নিজেদের গ্রাম। বলছেন, “কারও দয়া নয়, নিজেদের পেট এতদিন নিজেরাই চালিয়েছি। পরিবারও। এ বার সেই লড়াই ছড়িয়ে দিতে হবে।” পবিত্রবাবুর স্ত্রী প্রীতি জানালেন, সব মিলিয়ে প্রায় ১৫ কোটি টাকার ধাক্কা। অসমিয়া ও হিন্দি ছবিতে অভিনয় করে অর্জিত অর্থ সবটাই বেরিয়ে যায়। এত টাকা কোথা থেকে জোগাড় হবে জানেন না রাভা দম্পতি। গ্রাম গড়ার জন্য, বড়োল্যান্ডের প্রধান হাগ্রামা মহিলারির দ্বারস্থ হয়েছেন পবিত্র। এক ঢাল সবুজের মধ্যে স্বপ্ন ফুটছে। যার সঙ্গে বাস্তবের টক্কর প্রতি পদে। |