হাতের কাজের মধ্যেই ওঁরা খুঁজছেন জীবনের ভাষা
নের ভাষা ফুটে উঠছে হাতের কাজে। কোথাও ছবির রঙে, তো কোথাও মোমবাতির গায়ে সূক্ষ্ম নকশায়। কেউ তৈরি করছেন জাঙ্ক জুয়েলারি, কেউ কাগজের সুদৃশ্য গিফ্ট বক্স। কেউ ব্যস্ত সিল্ক প্রিন্ট করতে, কেউ বা সেই প্রিন্টের উপর তুলির টানে ছবি ফুটিয়ে তুলতে।
আর পাঁচ জনের চেয়ে ওঁরা আলাদা। অনেকটাই আলাদা। কারও কাছে শব্দ পৌঁছয় না, কথা বলার আপ্রাণ চেষ্টা করেন, কিন্তু সেখানেও বাধা। তাই তাঁদের কাজ দেখতে চাইলে, হাত-পা নেড়ে নানা অঙ্গ-ভঙ্গিমায় বোঝাতে চান নিজেদের শিল্প। কারও আবার দুর্ঘটনায় কনুই থেকে কাটা গিয়েছে হাত। কেউ হাঁটতে পারেন না। কারও আবার মূক-বধির হওয়ার পাশাপাশি ক্ষীণ হয়ে গিয়েছে দৃষ্টিশক্তিও। কিন্তু জীবনের কোনও বাধাই দমাতে পারেনি ওঁদের। তাই আর পাঁচ জন স্বাভাবিক মানুষের মতো ওঁরাও প্রতিদিন সকালে ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে পড়েন অফিসের উদ্দেশ্যে। প্রতি মাসে নিজেদের রোজগারের টাকায় মাথা উঁচু করে পরিবারে, সমাজে বাঁচার চেষ্টা করেন।
একাগ্র মনে চলছে শিল্পসৃষ্টি। নিজস্ব চিত্র
শর্মিষ্ঠা বন্দ্যোপাধ্যায়, মানি দাস, পরীক্ষিত বর্ধন, স্বপন সরকার, সুরজিৎ সেনরা তাই ইএম বাইপাস সংলগ্ন কসবা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটের ফেজ থ্রি-র কারখানায় বসে শিল্পসৃষ্টি করে চলেন অপার মনোযোগে। তরল মোমকে ছাঁচে ফেলে মোমবাতি তৈরি কিংবা ছাঁচের ভিতর নানা রঙের টুকরো মোম আঠা দিয়ে বসিয়ে তার উপরে তরল মোম ঢালা। সেই মোম বসে গেলে ছাঁচ থেকে খুলে তাকে মসৃণ করা। শব্দ শুনতে পান না, কথা বলতে পারেন না। কিন্তু প্রশিক্ষকের ইশারার ভাষাতেই বুঝে নেন ঠিক কী ভাবে কাজটা করতে হবে। ইন্দ্রিয় কাজ করে না। তবুও ওঁদের হাতের কাজই বুঝিয়ে দেয় মনের সমস্ত অনুভূতিকে কাজে ফুটিয়ে তুলতে কতটা দক্ষ ওঁরা। বাড়িটির আর এক তলায় তখন চলে সিল্ক প্রিন্টিংয়ের কাজ। শুকিয়ে গেলে তার উপর বসে কেউ কেউ তুলির টানে ফুটিয়ে তুলছেন নানা রঙের ছবি। তা থেকে তৈরি হবে গ্রিটিংস-কার্ড।
প্রায় ১১৭ জন বিভিন্ন ভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধী। ওঁরা তবু সমাজ বা পরিবারের বোঝা হতে চাননি। গ্রিটিংস কার্ড থেকে মোমবাতি, গিফ্ট বক্স থেকে জাঙ্ক জুয়েলারি ওঁদের তৈরি এই সব জিনিসই আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। জিনিসগুলি বিক্রির টাকায় উঠে আসছে এই মানুষগুলির প্রতি মাসের মাইনে। পরিবারের লোকজনও প্রথম প্রথম ওঁদের বোঝা ভাবলেও এখন ছবিটা পাল্টে গিয়েছে। ওঁদের অনেকেই এখন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী সদস্য। বর্তমানে ওঁদের সকলেই প্রায় সাড়ে চার হাজার থেকে ছ-সাত হাজার টাকা মাইনেতে কাজ করেন। শুধু তাই নয়, এঁদের মধ্যে ৮৯ জনের জন্য প্রফিডেন্ট ফান্ড, ইএসআই-এরও ব্যবস্থা রয়েছে।
কিন্তু কারা কাজ শেখায় ওঁদের? প্রায় ৩৪ বছর আগে একটি সংস্থা তৈরি করেন সমীর রায় নামে এক ব্যক্তি। নাম দেন ‘সাইলেন্স’। নিজের মূক ও বধির ভাইপোর ছবি আঁকা ও তা বিক্রি করে কিছু করে দেখানোর লড়াই-ই সমীরবাবুকে এই সংস্থা তৈরি করার উৎসাহ জুগিয়েছিল, এই ধরনের মানুষদের জন্য। তার পর থেকেই এই সংস্থা একে একে এই কর্মযজ্ঞে যুক্ত করেছে এত জন শারীরিক প্রতিবন্ধীকে। কোনও সরকারি বা বেসরকারি অনুদানে নয়, সম্পূর্ণ নিজেদের শ্রম দিয়ে এঁদের কাজ শিখিয়ে, কাজে যুক্ত করে, তাঁদের কাজ বিদেশের বাজারে বিক্রি করে মাসের শেষে সকলের হাতে টাকা তুলে দেওয়া হয়।
দক্ষিণ কলকাতার ওই বেসরকারি সংস্থার তরফে সম্পাদক সুব্রত মজুমদার বলেন, “মূক ও বধির কিংবা শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় ছোট থেকেই ওঁদের অন্য চোখে দেখা হয়। ওঁদের কথা না বলা আর শুনতে না পাওয়ার জগতটা আমদের মতো সুস্থ মানুষরা বুঝতে পারি না। কিন্তু অন্য ইন্দ্রিয়গুলো কাজ না করলেও ওঁদের একাগ্রতা অনেক বেশি। তাই ওঁদের হাতের কাজ এতটাই ভাল হয় যে, বুঝতেই পারা যায় না ওঁরা শারীরিক প্রতিবন্ধী। অধিকাংশই তৃতীয় কিংবা চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। এক-দু’জনই রয়েছেন, যাঁরা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। এ ধরনের মানুষ আমাদের কাছে এলে আমরা ভোকেশনাল ট্রেনিং দিয়ে কাজে যুক্ত করি।”
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.