বস্তি উন্নয়নে গৃহনির্মাণ প্রকল্পে নির্দিষ্ট মেয়াদের আগে ‘লক্ষ্যমাত্রা’ পূরণ করায় রাজ্য সরকারের কাছে পুরস্কৃত হয়েছে নলহাটি পুরসভা। হয়েছে পরিস্রুত পানীয় জল প্রকল্পের উদ্বোধন ও রেল ওভারব্রিজের শিলান্যাস। পুরভোটের প্রচারে এসবই তুলে ধরছে তৃণমূল। তাদের দাবি, নলহাটির উন্নয়ন হয়েছে পুরপ্রধান বিপ্লব ওঝার নেতৃত্বেই। যিনি বছর তিনেক আগে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন।
এ তো গেল দাবির দিক। খাতায়-কলমে নলহাটি পুরসভা এলাকায় ভাল কাজ হলেও উন্নয়ন নিয়ে বিস্তর অভাব-অভিযোগ রয়েই গিয়েছে। জল, নিকাশি, বিদ্যুৎ-সহ আরও নানা বিষয় নিয়ে অভাব-অভিযোগের কথা শোনা যাচ্ছে খোদ পুরপ্রধানের ওয়ার্ড ৪ নম্বরেও। তবে তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের কথায়, “নলহাটির উন্নয়নের জন্য বিপ্লব ওঝা কী করেননি, রাস্তাঘাট, বস্তিবাসীদের উন্নয়ন, পানীয় জলের ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ-সব ক্ষেত্রেই উন্নতি হয়েছে।”
কিন্তু দলীয় সভাপতির স্তুতির সঙ্গে বাস্তবে মিল নেই বলে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে তা নিজের ওয়ার্ডেই। এই ওয়ার্ডের পাথরকলপাড়ার শেষ প্রান্তে বেশ কিছু দিন আগে নতুন জলাধারের উদ্বোধন করেছেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। পরে পরিস্রুত পানীয় জল প্রকল্পের উদ্বোধন করে পুরমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন, উদ্বোধনের পরের দিন থেকে পুরবাসী জল পাবেন। জল পাওয়া তো দূরের কথা, পাইপলাইন বসানোর কাজই শেষ হয়নি। শুধু তাই নয়, এই ওয়ার্ডে পরিস্রুত পানীয় জল প্রকল্পের এখনও পর্যন্ত একটিও ট্যাপ কলের স্ট্যান্ড পয়েন্ট নেই। এ ব্যাপারে পুরপ্রধান বলেন, “জনস্বাস্থ্য কারিগরী দফতর থেকে পানীয় জল প্রকল্পে এই ওয়ার্ডে কোনও পাইপ লাইন নেই। ফলে পিএইচ-র পরিস্রুত পানীয় জল ওয়ার্ডবাসী পাননি।” তাঁর আশ্বাস, “তবে নতুন প্রকল্পের জলের পাইপ লাইন বসানো হয়েছে। নির্বাচনের পরেই বাড়িতে বাড়িতে জল পৌঁছে যাবে।” তাঁর দাবি, “ওয়ার্ডে পর্যাপ্ত নলকূপ বসানো হয়েছে। ফলে ওয়ার্ডে জলের সমস্যা মিটেছে।” |
বেহাল নিকাশি। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম। |
পাথরকলপাড়ার এক বধূর ক্ষোভ, “ওয়ার্ডে পুকুর নেই। কাপড় কাচা থেকে বাড়ির কাজ, পানীয় জল সবটাই নলকূপের ভরসায় থাকতে হয়। আর সেই নলকূপের জল আনতে ২০০ মিটার হাঁটতে হয়।” ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম প্রার্থী রবীন্দ্রনাথ (খোকন) শর্মা বলেন, “ওয়ার্ডে চাকুরিজীবি ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মানুষের বাস বেশি। এর ফলে ওই সব পরিবার নিজেরদের বাড়িতে নলকূপ বা পাম্প বসিয়েছেন। কিন্তু ঠাকুরপাড়া, হরিজনপল্লি, বাউরিপাড়া, পাথরকলপাড়ার কিছু অংশ, ট্রলিলাইন পাড়ায় সাধারণ ও গরিব মানুষদের জলের সমস্যা মেটাতে ব্যর্থ পুরপ্রধান।” তাঁর অভিযোগ, “বস্তিু উন্নয়ন প্রকল্পে সেরার পুরস্কার মিলেছে, অথচ প্রকৃত গরিব বস্তিবাসীরা এখনও ত্রিপলের তলায় কোনও রকম ভাবে বাস করছেন।”
খোকনবাবুর অভিযোগের সত্যতা মিলল পাথরকলপাড়ায় গিয়ে। সেখানে ইয়ারউদ্দিন শেখের স্ত্রী শুকতারা বিবির নামে বস্তি উন্নয়ন প্রকল্পে ঘর হয়েছে। ঘরের দেওয়ালে আরও দু’টি ঘর বানিয়ে ভাড়ায় দিয়েছেন ইয়ারউদ্দিন। তিনি বলেন, “আমি লাগোয়া শ্বশুরবাড়িতে থাকি।” আর এক উপভোক্তা শঙ্করী মণ্ডল বিয়ের পরে মুর্শিদাবাদে শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। কিন্তু এখানে তাঁর এক লাখের বাড়িতে ৪টি বড় বড় পাকা ঘর রয়েছে। থাকেন শঙ্করী মণ্ডলের ভাইয়ের বৌ। অন্য দিকে, সিআরপিএফের কর্মী মহম্মদ কামারুজ্জামানের স্ত্রী সিরাজা মনিরা’র একলাখি বাড়ির প্রান্তে একই চৌহদ্দিতে দোতলা ঘর হয়েছে। সিরাজা মনিরা বলেন, “আমি একা থাকার সময়ে পুরসভা ঘর বানিয়ে দিয়েছিল। পরে স্বামী একই জায়গায় বড় বাড়ি করেছেন।”
ওয়ার্ড ঘুরতে ঘুরতে রামপিয়ারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাছে দেখা মিলল কিছু দুঃস্থ মানুষদের। যাঁরা ত্রিপলের নীচে বসবাস করছেন। দাসু তুড়ি নামে একজন আক্ষেপের সুরে বললেন, “ঘরের জন্য পুরসভায় আবেদন করেছিলাম। হয়নি! দুই ছেলে, বৌ, নাতি নিয়ে এ ভাবেই বাস করছি।”
বিপ্লববাবুর দাবি, “প্রথম দিকে মানুষদের বোঝাতে পারা যায়নি। প্রকল্পের টাকা ফেরত যাওয়ার মতো অবস্থায় ছিল। এই অবস্থায় গৃহনির্মাণ প্রকল্প চালু করতে গিয়ে কিছু বিত্তবানদের নাম ঢুকে গিয়েছে। তবে দুঃস্থ পরিবারগুলিকে পাট্টা বিলি করার জন্য আইনি জটিলতা আছে।” তিনি বলেন, “তা ছাড়া, গৃহনির্মাণ প্রকল্পে মহিলাদের নামে জায়গা না থাকলে বাড়ি তৈরি করা যায় না। পুরমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন আগামী দিনে পুর-এলাকায় বস্তি উন্নয়নে গৃহহীনদের জন্য বাড়ি নির্মাণে বরাদ্দ বাড়াবেন।” প্রসঙ্গত, সংরক্ষণের ধাক্কায় এ বার নিজের ওয়ার্ডে না দাঁড়ালেও বিপ্লববাবু ৮ ও ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে লড়ছেন। ৪ নম্বর ওয়ার্ডে দাঁড়িয়েছেন রবীন্দ্রনাথ শর্মা (রবি)। রবিবাবুর দাবি, “আমার এলাকায় ভাল উন্নয়ন হয়েছে। আরও উন্নতি করার চেষ্টা করব। জেতার ব্যাপারে আমি আশাবাদী।”
যদিও ওয়ার্ডবাসীর ক্ষোভ, “যে কোনও নির্বাচনের আগে ঝুড়ি ঝুড়ি আশ্বাস মেলে। বাস্তবে তার প্রতিফলন চোখে পড়ে না।”
|
নজরে নলহাটি |
ওয়ার্ড ৪ |
• এখনও প্রকল্পের জল মেলেনি। নিকাশি ব্যবস্থায় ত্রুটি আছে।
• নিয়মিত জঞ্জাল সাফাই হয় না।
• বস্তি উন্নয়নে সকলের গৃহ নির্মাণ হয়নি। |
রাস্তা নিম্নমানের হয়েছে। জলের সমস্যা মেটেনি।
গৃহনির্মাণ প্রকল্পে প্রকৃত গরিব মানুষেরা বঞ্চিত। বিধবা,
বার্ধক্য ভাতা যে পর্যায়ে হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি।
রবীন্দ্রনাথ শর্মা, বিরোধী প্রার্থী, সিপিএম |
২০০৯ সালে ওয়ার্ডের সব জায়গায় রাস্তা নির্মাণ
করে দেওয়া হয়েছে। সর্বত্র বিদ্যুৎ পৌঁছেছে তবে
নতুন বসতি এলাকায় রাস্তা চাহিদা আছে।
বিপ্লব ওঝা, তৃণমূল কাউন্সিলর |
|