পান্তাই মনোহরের শতক-রহস্য, অন্যদের ভিন্ন তত্ত্ব |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
তাঁর শতক পেরোনো জীবনের ‘রহস্য’টা ভাঙলেন মনোহর আইচ। পান্তা ভাত! শুক্রবার ব্যারাকপুরে পুলিশের অনুষ্ঠানে বিশ্বশ্রী তাঁর হাঁটুর বয়সি ‘আইনরক্ষক’দের পান্তা ভাতের মাহাত্ম্য বুঝিয়ে এলেন!
এমনিতে অবশ্য দীর্ঘজীবনের সঙ্গে পান্তার সম্পর্কের সমর্থনে জোরালো অভিমত কখনওই শোনা যায়নি। দীর্ঘজীবনপ্রাপ্ত বিশিষ্ট বাঙালির তালিকাতেও মনোহরবাবু ছাড়া পান্তা-প্রীতির নমুনা তেমন নেই। পোড়খাওয়া ডাক্তার থেকে পুষ্টিবিশেষজ্ঞদেরও এই ‘পান্তা-তত্ত্বে’ ঘোর সংশয়।
তা হলে দীর্ঘজীবনের রহস্যটা কোথায়?
বিশেষজ্ঞরা মোটামুটি একটা বিষয়ে একমত। তা হল, দীর্ঘ জীবনের ‘স্ট্র্যাটেজি’র কোনও বাঁধাধরা তত্ত্ব নেই। চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায় যেমন দীর্ঘজীবনের নেপথ্যে মানুষের জিনগত বৈশিষ্ট্যেই প্রধান বলে দাবি করছেন। তাঁর কথায়, “সব দীর্ঘজীবী মানুষের মধ্যেই টেলোমেরাজ জিন (telomerase)-এর হদিস মিলেছে। আর কোনও বাঁধাধরা নিয়ম নেই।” মনস্তত্ত্ববিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অনেকে আবার বলছেন, “বেশি দিন বাঁচতে মনটাও খুশি রাখতে হবে। এই খুশি থাকার স্ট্র্যাটেজিরও নানা ধরন।” |
ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটে রক্তদান শিবিরে শতায়ু মনোহর আইচ। সেখানে পুলিশ
কর্মীদের পান্তা খাওয়া ও ব্যায়াম করার পরামর্শ দেন তিনি। ছবি: বিতান ভট্টাচার্য |
যেমন এই বঙ্গের সাম্প্রতিক শতায়ুদের মধ্যে কয়েক বছর আগে ১০৩ পার করে গত হয়েছিলেন কলকাতার একটি নামী মিষ্টি-প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হরিদাস পাল। তাঁর ছেলে রবীন্দ্রনাথবাবুর বক্তব্য, “বাবা সত্যিই অদ্ভুত ছিলেন। কোনও কিছু খারাপ লাগলেও অহেতুক রাগারাগি নেই। একটাও খারাপ শব্দ মুখ দিয়ে বেরোত না।” সদ্য শতক পেরোনো অভিনেত্রী জোহরা সেহগলের মেয়ে কিরণ বলছেন, মায়ের শিশুর মতো মনটার কথা। আর ১০০-র কাছাকাছি পৌঁছনো বাঙালিদের মধ্যে এখন যাঁরা রয়েছেন? সত্যজিৎ রায়ের স্ত্রী বিজয়াদেবী এ বার ৯৫ পার করেছেন। তাঁর পুত্র সন্দীপ রায়ের কথায়, “শরীর ঠিক থাকলে মা এখনও কাজের মধ্যে থাকেন। বই পড়া বা আপনমনে ওয়ার্ডগেম খেলা। এটাও সুস্থ থাকার কৌশল!”
তা হলে খাবারের জোরটা কোথায়? সেখানেও তো ‘অনিয়ম’টাই নিয়ম! প্রবাসে একদা বাঙালির প্রিয় আস্তানা পুরীর বিএনআর হোটেলের বোর্ডে লেখা একটি সরস উক্তি নির্ঘাত অনেকেরই মনে পড়বে। তাতে হাতি, বাঘ, কুকুর, বাঁদর প্রমুখ বিবিধ প্রাণীর আয়ুষ্কালের উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বেচারারা কেউ এক ফোঁটাও সুরাপান করে না। আর সুরাপায়ী হয়েও মানুষ তাদের থেকে লম্বা গড় আয়ুর অধিকারী! জ্যোতি বসু যেমন অভিজাত খাদ্য-মদ্যের অনুরাগী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। মাঝ-নব্বইয়ে প্রয়াণের আগে শেষ জন্মদিনেও চেটেপুটে স্বল্প পরিমাণে পাঁঠার মাংস-মিষ্টির মতো সুখাদ্য চেখে দেখেছেন। জোহরা অকপটে তাঁর প্রিয় ব্লাডি মেরি ককটেল প্রীতির কথা কবুল করেছেন।
কিন্তু জোহরা কস্মিনকালেও পান্তা চেখেছেন কি? এমন তথ্য জানা যায়নি। বিজয়াদেবীর বৌমা ললিতার কথায় যেমন, “মায়ের খাওয়া-দাওয়া খানিকটা মেমসাহেবগোছের। পান্তা কেন ভাতটাই তো মা মাসের পর মাস এড়িয়ে চলেন।” শতক পেরনো হরিদাসবাবু মনোহরবাবুর মতোই কাঠ-বাঙাল হলেও ডায়েটে পান্তাকে তেমন গুরুত্ব দিতেন না বলে জানাচ্ছেন তাঁর পুত্র রবীন্দ্রনাথ।
পান্তা-মাহাত্ম্য নিয়ে যে যা-ই বলুক, পুলিশের অনুষ্ঠানের মঞ্চে ‘পকেট হারকিউলিস’ মনোহরবাবু কিন্তু এ দিন প্রত্যয়ের সঙ্গেই বলে এসেছেন, “পান্তা ভাতের জল, তিন জোয়ানের বল!” |