পুস্তক পরিচয় ২...
‘লর্ড কিচেনার আমায় হুকুম দিয়েছেন যে!’
ঠাকুরবাড়িতে নিত্য যাতায়াত ছিল বিদ্যাসাগরের জীবনীকার চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছেলে জ্যোতিপ্রকাশের। তাঁর হাতে থাকত একটা খেলনা মেশিনগান। এসেই তিনি মেশিনগানটা তাক করতেন রবীন্দ্রনাথের ঘরের দিকে। বলতেন, ‘এই মেশিনগানের গুলিতে রবি ঠাকুরকে ঠান্ডা করে দেব’। সোমেন্দ্রনাথ ভয় পেয়ে জিগ্যেস করতেন, ‘কেন কেন, রবিকে গুলি করবে কেন?’ জ্যোতিপ্রকাশ চোখ পাকিয়ে জবাব দিতেন, ‘কী আশ্চর্য, জানেন না? লর্ড কিচেনার আমায় এই হুকুম দিয়েছেন যে!’ দারুণ বৈশাখে নিদারুণ রবি-জয়ন্তীর কালে অমিতাভ চৌধুরীর জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার (সপ্তর্ষি, ১০০.০০)-এ গল্পটি ফিরে পড়তে পেয়ে মন ভাল হয়ে গেল। আরও অনেক গল্প এ বইয়ে, মজার, আরও মজার করে লেখা। নামপ্রবন্ধটি ছাড়া আরও তিনটি প্রবন্ধ এ বইয়ে, বৌঠাকুরানিদের হাট, রবীন্দ্রনাথের পাগল দাদারা, গাজিপুরে রবীন্দ্রনাথ। তাঁরই আর একটি নবরূপে ফিরে এল সার্ধশতকে, রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চা (সপ্তর্ষি, ১৫০.০০)। দুটি বইয়েরই প্রচ্ছদ সুন্দর, কিন্তু ব্লার্বে লেখকের ছবিটি মুদ্রণের গুণে ছবি নয়, ছায়া, যে ছায়ারে পণ করেও ধরা যায় না।
‘সাধারণ সাহিত্যকে টানে বিরাট পাঠককেন্দ্র, চালায় দূরদেশ দূরকালের পথে ব্যক্তিগত জীবনের সীমানা ছাড়িয়ে। আর চিঠির সাহিত্য ধরা দেয় লেখকের কাছ-ঘেঁষা জগতের দৈনিক ছায়া প্রতিচ্ছায়া, ধ্বনি প্রতিধ্বনি, তার ক্ষণিক হাওয়ার মর্জি, আর তার সঙ্গে প্রধানত মিলিয়ে থাকে সদাপ্রত্যক্ষ সংসারপথের চলতি ঘটনা নিয়ে আলাপ প্রতিলাপ।’ পথে ও পথের প্রান্তে-র ভূমিকায় লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই কাছ-ঘেঁষা জগতেরই নিপুণ ছায়া-প্রতিচ্ছায়াকে ধরে রাখতে চেয়ে তৈরি হয়েছে রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র: নির্দেশিকা-র দুটি খণ্ড (বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষৎ, দু’খণ্ড একত্রে ৫০০.০০)। সতী চট্টোপাধ্যায় ও দেবী রাণী ঘোষ সংকলিত এই নির্দেশিকায় রবীন্দ্রনাথের ৩৫টি পত্রসংকলনের প্রসঙ্গনির্দেশ। বিষয় নির্দেশ ও নাম নির্দেশ এই দুই ভাগে ভাগ করা খণ্ডদুটিতে রবীন্দ্রনাথের কোন চিঠিতে কোন বিষয় এবং কোন পত্রপত্রিকা বা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা গ্রন্থনাম পাওয়া যাবে সেই হদিশ বহু যত্ন আর পরিশ্রমে সংকলিত এ বইয়ে। ব্যবহার্যতার জন্য সংকেতসূচিটি প্রতি পৃষ্ঠারই নীচে ছাপা হয়েছে। প্রথম খণ্ডে বিশ্বভারতী প্রকাশিত চিঠিপত্র ১৯ খণ্ডের নির্দেশিকা ছিল। দ্বিতীয় খণ্ডে আছে বিশ্বভারতী, দুই বাংলার অন্য প্রকাশনা, সাহিত্য অকাদেমি এবং কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত ১৬টি পত্র সংকলনের চিঠিগুলির তথ্য ও সূত্রনির্দেশ।
জাতি ও জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা বুঝতে গেলে তাঁর রচনাগুলির বাইরে গিয়েও দেখতে হয় তাঁর বিপুল, বিচিত্র কাজকে— নানা সভায় তাঁর বক্তৃতা, মহাত্মা গাঁধী প্রমুখের সঙ্গে তাঁর বিতর্ক, তাঁর বিদেশ ভ্রমণের বৃত্তান্ত, পল্লীসংস্কারে তাঁর প্রচেষ্টা। ২০১০-এ বিশ্বভারতীতে অনুষ্ঠিত একটি আলোচনা সভার গবেষণাপত্রগুলির এই সংকলন, রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যান্ড দ্য নেশন/এসেজ ইন পলিটিকস, সোসাইটি অ্যান্ড কালচার (পুনশ্চ ও বিশ্বভারতী, ৭৯৫.০০), রবীন্দ্রনাথের চিন্তার পরিধিকে ধরতে চেয়েছে কয়েকটি বিন্দুর উপর চোখ রেখে। জাতি সম্পর্কে তাঁর চিন্তার কেন্দ্রে গ্রামের উপস্থিতি, গাঁধীর সঙ্গে স্বদেশি সমাজ, ঐতিহ্য ও আধুনিকতা বিষয়ে তাঁর দার্শনিক মতপার্থক্য, জাতি বিষয়ে আধুনিক তত্ত্ব-আলোচনার প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের জাতি-চিন্তা, রাজনৈতিক ভাবনার সঙ্গে ভাষা ও রচনাশৈলীর যোগ, রবীন্দ্র-উপন্যাসগুলিতে স্বদেশি আন্দোলনের প্রেক্ষিতে নারী-পুরুষ সম্পর্ক, এই বিষয়গুলির চারপাশে সাজানো হয়েছে মোট ১৯টি নিবন্ধ। সম্পাদনা করেছেন স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় এবং অভিজিৎ সেন।
‘‘উত্তরায়ণে দল বেঁধে চলে গিয়েছিলাম, অবন ঠাকুরের কাছে, গল্প শুনতে। তখন কি ছাই জানতাম তিনি ভারতসংস্কৃতির অহংকার! কী অনায়াসেই না তিনি আমাদের কাছে টেনে নিয়েছিলেন। গড়গড়ি টানতে-টানতে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঘন্টার পর ঘন্টা জুড়ে রাজস্থানী রূপকথার কথকতা করেছিলেন, আর তারপর আমাদের বুঝিয়ে ছেড়েছিলেন ‘ডাকঘর’ নাটকের মর্মবাণী।’’ অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ‘দু-তিনটি রবীন্দ্রমুহূর্ত’-এ ফিরে গিয়েছেন নিজের শান্তিনিকেতন-স্মৃতিতে। সম্প্রতি বেরিয়েছে তাঁর পাঁচ দশকের (১৯৬১-২০১১) রবীন্দ্রচর্যার সংকলন রবীন্দ্র-আলোকবর্ষে (পত্রলেখা, ২২০.০০)। বইটির দ্বিতীয় পর্ব রবীন্দ্রসার্ধশতবর্ষে ইয়োরোপের নানা শহরে লেখক প্রদত্ত কিছু কথিকা। আর বইটির প্রথম পর্বে বেশ কিছু পুরনো রচনা অলোকরঞ্জনের, অথচ সময়ের বেড়াজাল পেরিয়ে রচনাগুলি আজও সমান প্রাসঙ্গিক। যেমন প্রথম প্রবন্ধটিই, ‘রবীন্দ্রকাব্যের প্রথম পর্যায়: ব্রাহ্মমুহূর্তের সন্ধিক্ষণে’ ১৯৭০-এ লেখা, অথচ চল্লিশ বছর পেরিয়েও ভাবনা উসকে দেয় পাঠকের।
ছেচল্লিশ বছর ধরে অনুষ্টুপ-এর নানা সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বহু লেখা প্রকাশিত হয়েছে, সে সব থেকেই নির্বাচিত সংকলন অনুষ্টুপের রবীন্দ্রনাথ (প্রথম খণ্ড: সাম্প্রতিকের রবীন্দ্রনাথ। অতিথি সম্পাদক: সমীর সেনগুপ্ত। ৮৫০.০০)। এই প্রথম খণ্ডটির রবীন্দ্র-বিষয়ক প্রবন্ধগুলি সম্পর্কে প্রয়াত সম্পাদকের মত: ‘তাঁকে আমাদের মতো করে বুঝতে গেলে তাই আমাদের নতুন করে তাঁর দিকে তাকাতে হবে, আনাচেকানাচে খুঁজতে হবে, নতুনভাবে ডেটা-কালেকশন করতে হবে। সেই নতুনভাবে তাঁকে সন্ধান করবার কিছু কিছু পথের আভাস রইল এই সংকলনে।’ বিশিষ্ট লেখকদের রচনায় প্রশ্নে-পরিপ্রশ্নে আলোচিত হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, তবে একই লেখকের একাধিক লেখা না থাকলেই বোধহয় ভাল হত।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.