|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
ভিখারিকে ভিকিরি করে অনুবাদরঙ্গ |
আশিস পাঠক |
দি এসেনশিয়াল টেগোর। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সম্পাদনা: ফকরুল আলম ও রাধা চক্রবর্তী। বিশ্ব-ভারতী, ১৫০০.০০ |
একটি পুরাতন কথা দিয়েই শুরু করি। ওই নামের প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘অনেকেই বলেন, বাঙ্গালীরা ভাবের লোক, কাজের লোক নহে। এই জন্য তাঁহারা বাঙ্গালীদিগকে পরামর্শ দেন Practical হও। ইংরাজি শব্দটাই ব্যবহার করিলাম। কারণ, ওই কথাটাই চলিত। শব্দটা শুনিলেই সকলে বলিবেন, হাঁ হাঁ, বটে, এই কথাটাই বলা হইয়া থাকে বটে। আমি তাহার বাঙ্গালা অনুবাদ করিতে গিয়া অনর্থক দায়িক হইতে যাইব কেন?’
রবীন্দ্ররচনার অনুবাদ প্রসঙ্গে কোনও প্রতর্কে একটু হাল্কা ভাবে হলেও জড়িয়ে থাকে এই কথাটা। ইংরেজি শব্দকে অবিকল ইংরেজি, (এমনকী রোমান হরফেও) রেখে দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ, কেবল এই দৃষ্টান্তটুকু দেখানোর জন্যই এই উদ্ধৃতি ব্যবহার করিনি, বাঙালির অনুবাদ-প্রবণতার আরও একটা ভিতরের কথা ওতে আছে। সেটা হল, বাঙালিরা ভাবের লোক, কাজের লোক নয়।
কথাটা আরও বেশি করে বিচার্য হয়ে ওঠে তখনই, কোনও বাঙালি যখন রবীন্দ্রনাথের বাংলা লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। বাংলার মাটি, বাংলার জলে যে রবীন্দ্রনাথের কলম লালিত, যে রবীন্দ্রনাথের কলম প্রায় অর্ধ শতকের বাঙালিয়ানার গঠন তৈরি করে দেয় সেই কলমের রচনাকে ইংরেজি ভাষার প্রেক্ষিতে স্বাভাবিকতায় অনুবাদ করাটা নিছক ভাবের বিষয় নয়, রীতিমতো কাজের চ্যালেঞ্জ।
চ্যালেঞ্জটা শক্ত হয়ে ওঠে একবিংশ শতকের এই দ্বিতীয় দশকে। ই-বুক, ফেসবুক, আর ‘টেক্সট’-এর এই যুগে ইংরেজি ভাষাটা অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বদলে চলেছে, বহু ভাষার বহু শব্দ অবিকল থেকেই ঢুকে যাচ্ছে চলমান ইংরেজি অভিধানে। অন্তত ভাষার ক্ষেত্রে যত্র বিশ্বং ভবত্যেকনীড়ম্-এর এই যুগে রবীন্দ্ররচনার একটি আনকোরা অনুবাদ-সংকলনের দরকার ছিল ভীষণ ভাবে। কারণ রবীন্দ্রনাথের সম্ভাব্য পাঠক নবীন প্রজন্ম এই নতুন পরিবর্তনশীল ইংরেজিতেই অভ্যস্ত। দি এসেনশিয়াল টেগোর এই অর্থে আক্ষরিক জরুরি।
এই সংকলনের দশটি ভাগ Autobiography, Letters, Prose, Poems, Songs, Plays, Stories, Novels, Humour, Travel Writing। প্রতিটি বিভাগে নির্বাচিত রবীন্দ্ররচনার অনুবাদ। মোট ত্রিশ জন অনুবাদক রবীন্দ্রনাথের বহু ধারার রচনার অনুবাদ করেছেন। পরিশিষ্টে রবীন্দ্রজীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাক্রমপঞ্জি এবং বিশিষ্ট বঙ্গীয় ধারণার একটি Glossary আছে। এই সংকলনের নির্বাচিত রচনাগুলিই রবীন্দ্রপরিচয়ের ক্ষেত্রে যথেষ্ট বা আদৌ প্রয়োজনীয় কি না তা নিয়ে সূক্ষ্ম তর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু মোটের ওপর নির্বাচন নিয়ে বলার কিছু নেই। ছোটগল্পে ক্ষুধিত পাষাণ, খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন, নাটকে রক্তকরবী, উপন্যাসে গোরা, শেষের কবিতা এবং চিরচেনা কয়েকটি গান... রবীন্দ্রচয়নের প্রচলিত ছকের বাইরে যায়নি এ সংকলনও।
কিন্তু কয়েকটি অনুবাদ নিছক ভাবের দিক থেকেই, কতটা কাজের প্রশ্ন ওঠে। এমনকী, বিশ্ব-ভারতী প্রকাশিত এই সংকলন কোথাও কোথাও রবীন্দ্রনাথের প্রতিই কতটা বিশ্বস্ত ওঠে সে প্রশ্নও। দৃষ্টান্ত দিই:
এক, ‘To the world’s festival of delight’ শিরোনামে ‘জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’ গানটির অনুবাদ করেছেন অন্যতম সম্পাদক ফকরুল আলম। অনুবাদের শেষে বন্ধনীমধ্যে ইংরেজি অক্ষরে লেখা মূল গানটির প্রথম তিনটি শব্দ, ঠিক এই ভাবে: Jagater anander jogye। এই রকম এলানো বাংলায় যে রবীন্দ্রনাথ গান লিখবেন না, রবীন্দ্রগান অনুবাদের আগে সেই ধারণাটিকে করতলগত আমলকী করে তোলা জরুরি ছিল।
দুই, ‘I’ll overcome you not with my beauty but with my love
I’ll open doors not with my hands but with my love’.
‘আমি রূপে তোমায় ভোলাব না ভালবাসায় ভোলাব
আমি হাত দিয়ে দ্বার খুলব না গো গান দিয়ে দ্বার খোলাব।’
স্পষ্টত, একই গানে একই বক্তব্য-শব্দ ব্যবহার করেন না রবীন্দ্রনাথ, করেন না বলেই তিনি রবীন্দ্রনাথ, জরুরি এই চৈতন্যটি এই অনুবাদে অনুপস্থিত। আর ‘ভোলানো’ ও ‘overcome’ একই ধারণাকে প্রকাশ করে কি না সে তর্কে যদি না-ও যাই, এ অনুবাদে দ্বিতীয় চরণের মেজাজটাই ক্ষুণ্ণ হয়েছে। ও চরণে প্রথম দরজা খোলার কর্তা ‘আমি’, আমার হাত সেখানে যন্ত্রমাত্র। দ্বিতীয় দরজা খোলার কর্তা কিন্তু ‘তুমি’, আমার গান সেখানে চালিকাশক্তি। এই কারণেই প্রথমটি ‘খুলব’, দ্বিতীয়টি ‘খোলাব’। এ গানের সুন্দর (রূপ নয়) লুকিয়ে আছে সূক্ষ্মতম এই অনুভবের প্রকাশে, অনুবাদ যেখানে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
তিন, মূল গানের প্রথম চরণ উদ্ধৃত করতে গিয়ে বারে বারেই ডুবিয়েছে এই সংকলন। সম্পাদনার অতুলনীয় ব্যর্থতাই দায়ী সে জন্য। Jibon o maraner simana chhariye নয়, হবে ‘জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে’; Shudhu tomar bani noi he নয়, ‘শুধু তোমার বাণী নয় গো’; Lekhon tomar dhulai নয়, ‘লিখন তোমার ধুলায়’; Vishwaveena rabe নয় ‘বিশ্ববীণারবে’; Asadh, kotha hotey tumi নয়, ‘আষাঢ় কোথা হতে আজ’। এমন বহু দৃষ্টান্তই দেখানো যায়। কিন্তু সবচেয়ে গুরুতর প্রমাদটি বোধহয় ‘এরে ভিখারি সাজায়ে কী রঙ্গ তুমি করিলে’কে Ere bhikiri shajaye ki rongo tumi koriley করা। ‘ভিখারি’কে ‘ভিকিরি’ সাজিয়ে এই অনুবাদরঙ্গ আদৌ ‘জরুরি’ ছিল কি? রবীন্দ্রনাথের ভাবনার ভুবনে ও দুইয়ে যে আকাশপাতাল তফাত (ঠিক যেমন ‘পাগল’ আর ‘পাগলা’য়) সেই বোধটুকু ছাড়াই প্রকাশ পেল এমন মহাগ্রন্থ, তা-ও আবার বিশ্ব-ভারতী থেকে! সার্ধশতবর্ষে বিস্ময় জাগে।
এবং সে কারণেই, মনে হয়, কিছুই তো হল না...। কী আশ্চর্য, এ গানের প্রথম চরণের অনুবাদ Nothing has worked out আর মূলের উদ্ধৃত প্রথম লাইন, Kichhu to holo na...। ওই ‘ই’-টার মধ্যেই যে সব, এ গানটার সমস্ত অনুচ্চারিত হাহারব, অনুবাদ তাকে ধরতে পারল কি?
গানে তো পদে পদে চোরাবালি, অনুবাদকে তলিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু ভাবের কথা থাক, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’-এর নিতান্ত কেজো প্রথম লাইনটার হাস্যকর অনুবাদটি উদ্ধৃত করি: When Raicharan first came to work at the home of his master, the Babu, he was only twelve years of age. কলিকালে ‘বাবু’ শব্দ নানার্থ, জানি, কিন্তু রাইচরণ যে নিছক ‘বাবুদের’ বাড়ি কাজ করতে গিয়েছিল, বাবু নামে কোনও ব্যক্তির বাড়িতে নয় এটুকু বুঝতে বোধহয় খুব বেশি বুদ্ধি খরচ করতে হয় না। অবশ্য, ফেলুদা শিরোধার্য, একটু বুদ্ধি খরচ করতেই হয় ‘সোনার বাংলা’ যে সোনা দিয়ে তৈরি নয় সেটা বুঝতে। সোনার তরী যেমন The Golden Boat, ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির অনুবাদে ‘সোনার বাংলা’ও হওয়া উচিত ছিল Golden Bengal, Bengal of Gold নয়। কারণ ‘সোনার’ শব্দটিতে এখানে জড়িয়ে আছে নানা অনুষঙ্গ, of Gold তার আভাস দিতে পারে না।
অমিয়চন্দ্র চক্রবর্তীর আ টেগোর রিডার থেকেই যথার্থ সূচনা হয়েছিল রবীন্দ্ররচনার এমন পরিচায়ক সংকলনের। পরে বহু অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তবু এই ‘এসেনশিয়াল’ টেগোরের প্রত্যাশা ছিল। মনে হয়েছিল, এই প্রজন্মকে স্পর্শ করার কোনও চেষ্টা থাকবে এর ভাষায়, উপস্থাপনে। কিন্তু ভাবের কথা এবং কাজের কথা, দুদিকেই এমন সব অভিধানাবদ্ধ অবাস্তবতার মণি-মুক্তো ছড়িয়ে রাখল এ সংকলন তাতে শেষে এই প্রশ্নই করতে ইচ্ছে করে, ঠাকুরকে চেনানোর জন্য এই টেগোর খুব ‘এসেনশিয়াল’ ছিল কি? |
|
|
|
|
|