মস্কোর মিউজিয়াম ভ্রুবেল হল-এ ‘রাজা’ বিশ্বনাথন আনন্দ সিংহাসন সামলাবে। আর ওই সিংহাসনের পায়াগুলো ধরে ঝাঁকুনি দিতে চাইবে এখনকার দাবার ‘এক নম্বর’ ম্যাগনাস কার্লসন।
বিশ্ব দাবার চূড়ান্ত নাটুকেপনার জন্য লালায়িত মানুষেরা হয়তো সেটাই দেখতে চেয়েছিলেন। এই দলের আমিও একজন। কিন্তু তেমনটা না হয়ে উল্টে বিয়াল্লিশ বছরের ভিশির সামনে বসল কিনা ক্যান্ডিডেটসের কাঁটাতার লাফিয়ে আসা তেতাল্লিশের বরিস গেলফাঁ। যাঁর কাছে চৌষট্টি খোপের খেলাটায় চেকমেট হওয়া বা করার এই শেষ সুযোগ।
স্বভাবতই এত দিন বলাবলি হয়েছে, তবে কি হাড় হিম করা কিছু দেখতে পাব না এ বার? এই যে যুযুধানেরা হাসিমুখে হাত মেলাল। যুদ্ধের আগে কেউ কাউকে গালমন্দ করল না। আয়োজকদের প্রতি অভিযোগ নেই। বড্ড ম্যাড়ম্যাড়ে মুখবন্ধ এটা! যেন প্রত্যাশিত ভবিতব্য একটাই— ইজরাইলি প্রতিদ্বন্দ্বীকে ‘কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার’ করবে আমাদের নয়নের মণি! |
শুক্রবারের সন্ধ্যাটা পার্ক স্ট্রিটে বড় পর্দায় খেতাবি লড়াই (প্রথম ভারতে এমন সম্প্রচার) দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল আমাদের অনুমানে কিছু ভুল ছিল। শেষ সুযোগের জন্য গেলফাঁ যে মরণকামড় দিতে তৈরি হয়েছে সেটা বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছিলাম! এই যে সাদা নিয়ে আগের ছ’টা ম্যাচের পাঁচটাতেই জেতা আনন্দ ‘কিক-অফ’ করল মন্ত্রীর দিকের বোড়েটা এক ঘর এগিয়ে, তাতে গেলফাঁ যে স্লাভ ডিফেন্সে যাবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শুরুতেই আমাদের চোখ কপালে তুলে আনন্দকে সামলাতে কালো যোদ্ধারা চলে গেল গ্রুনফিল্ড ডিফেন্সে। বিশ্বাসই হচ্ছিল না। পরে মনে হল সেই কথাটাই। শেষ সুযোগ হাতছাড়া না করতে চমকের রাস্তাতেই যাবে গেলফা।ঁ আর সেখান থেকেই অস্ত্রের ঝনঝনানি কানে বাজবে।
হয়তো আনন্দ ভাবল, আমি কি চমক জানি না? অথবা ওর সেকেন্ডরা (এই দলে আমাদের সূর্যশেখরও আছে) গ্রুনফিল্ডের ক্ষীণ প্রত্যাশার কথা বলে দিয়েছিল। তাই ৮ নম্বর চালে দেখলাম সাদার গজ একেবারে অভিনব পথে। যার মানে দাঁড়াল একটাই। গোদা বাংলায় এই ম্যাচটা আক্রমণ আর প্রতিআক্রমণের হতে যাচ্ছে। টানা তিন বার খেতাব ধরে রাখার সুযোগ ছাড়বে না আনন্দ। গেলফাঁও চমক দিয়ে প্রথম বার ট্রফি তুলতে চাইবে। তাই একটা সময় পর্যন্ত দেখলাম সেয়ানে-সেয়ানে। মেশিন যা বলে দিচ্ছে চালগুলোও সব সে রকমই আসছে। এবং বোর্ডের মেজাজ বেশ গরম। এমনকী অ্যাডভান্টেজের আশায় বোড়েও খাইয়ে দিল আনন্দ। কিন্তু ১৮ নম্বর চালে দেখলাম ও নিজের মন্ত্রী এক্সচেঞ্জ করে নিল। এটা নিয়েই খটকায় ছিলাম। তখন অন্তত মনে হচ্ছিল মন্ত্রীটা থাকলেই ভাল হত। তাতে গোটা কুড়ি চালের পরে গেলফাঁকে এতটা নিশ্চিন্ত দেখাত না। যেন ড্র কেউ আটকাতে পারবে না। কালো নিয়ে প্রথম খেতাবি লড়াইয়ে সেটা তো চাট্টিখানি কথা নয়! হলও ঠিক তাই। টাইম প্রেসারের একটু সমস্যার মুখে মাত্র ২৪ নম্বর চালে গেলফাঁ ড্রয়ের প্রস্তাব দিতেই লুফে নিল আনন্দ।
প্রথম সাক্ষাত মধুরেণ সমাপয়েত। যথেষ্ট ইঙ্গিতবাহীও। প্রথম এবং প্রধান ইঙ্গিত, এ বারের লড়াইটা হবে যুদ্ধের মেজাজে। সে না-ই থাকুক কার্লসন। চ্যাম্পিয়ন বা চ্যালেঞ্জার চল্লিশোর্ধ্ব হলেও সমস্যা নেই। দু’জনে এই কিছু দিন আগে বাবা হলেই বা কী এসে যায়? খেতাবি যুদ্ধের মেজাজের ট্র্যাডিশন এ বারও থাকছে। আর সাদা বা কালো যা নিয়েই খেলা হোক, এই স্তরের কারও নামের পাশে অ্যাডভান্টেজ শব্দটা বসানো যাচ্ছে না। অন্তত আমি সেই ভুল আর করব না। |