জওহরলাল নেহরু থেকে ইন্দিরা। সনিয়া গাঁধী থেকে রাহুল। দীর্ঘ ছয় দশকের পালাবদলের সাক্ষী তিনি।
প্রথম যখন সংসদে পা রাখেন, তখন তাঁর বয়স ৩২। ১৯৫২ সালের প্রথম লোকসভায় জিতে এসেছিলেন। আর আজ ৯২ বছরেও তিনি রাজ্যসভার অক্লান্ত সাংসদ। সব অধিবেশনে থাকেন, অংশ নেন বিতর্কে। হাজিরার হিসেবে অনেকের থেকেই এগিয়ে তিনি, রিশাং কেইশিং। সংসদের প্রথম অধিবেশনের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে রবিবার লোকসভা ও রাজ্যসভার বিশেষ অধিবেশন বসছে। সেখানেই সম্মান জানানো হবে মণিপুরের এই প্রবীণ রাজনীতিককে।
সংসদের গ্রন্থাগারে স্মৃতির পাতা ওল্টাচ্ছিলেন রিশাং। একাধিক বারের সাংসদ তো বটেই, এই ছ’দশকে মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রীও হয়েছেন তিন বার। আশির দশকে মুখ্যমন্ত্রী রিশাং রাজ্যের যোজনা বরাদ্দ নিয়ে বৈঠক করতে এসেছিলেন যোজনা কমিশনের তৎকালীন উপাধ্যক্ষ মনমোহন সিংহের সঙ্গে। রাজ্যের জন্য ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ শুনে জানিয়ে দেন, আরও ৫০ কোটি চাই। নইলে ‘ওয়াক-আউট’ করবেন। সহাস্য রিশাং বলেন, “মনমোহনজি আমার জামা টেনে বসিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, এটা কী করছেন?” সে বার ৫০ না হলেও বাড়তি ৩০ কোটি নিয়ে ফেরেন তিনি।
মণিপুরের তাংখুল নাগা সম্প্রদায়ের মানুষ হলেও কলকাতার সঙ্গে তাঁর আত্মিক যোগ। আমহার্স্ট স্ট্রিটের হস্টেলে থেকে সেন্ট পল্স কলেজে পড়ার সময়েই রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া। প্রথমে সোশ্যালিস্ট পার্টি, পরে কংগ্রেস। সে
|
রিশাং কেইশিং |
সময় চলছে ফিজোর নেতৃত্বে নাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। নেহরু তাঁকে মধ্যস্থতার দায়িত্ব দিলেন। রিশাং বলছিলেন, “এক দিন লোকসভা থেকে বেরোনোর সময়ে পণ্ডিতজির পথ আটকে বললাম, আপনাকে ফিজোর সঙ্গে দেখা করতে হবে। প্রচণ্ড চটে তিনি বললেন, ওরা ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে কী করবে! আমিও বলে দিলাম, আমার উপরে রাগ দেখাচ্ছেন কেন! বলে ফিরে আসছি, নেহরুই হাত টেনে ধরলেন। বললেন, আগে ফিজোকে নিয়ে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করো। তার পর প্রয়োজন হলে আমি কথা বলব।” প্রসঙ্গত, নাগা জঙ্গি গোষ্ঠী এনএসসিএন-এর নেতা থুইঙ্গালেং মুইভা এবং রিশাং একই এলাকার লোক। একাধিক বার জঙ্গি হামলা থেকে বেঁচেছেন তিনি নিজেও।
স্মৃতির পথ বেয়ে নেহরু থেকে ইন্দিরা। রিশাং জানান, জনসঙ্ঘের আমলে ইন্দিরার বিরুদ্ধে একটা ‘মিথ্যে’ মামলা হওয়ায় তাঁকে ইম্ফলে আসতে হয়েছিল। তিন দিন সেখানেই তাঁকে আটকে রাখার পরিকল্পনা করেছিল প্রশাসন। রিশাংয়ের কথায়, “ইন্দিরাজি আমাকে টিকিট জোগাড় করতে বললেন। পরের দিন হেঁটেই চলে গেলেন বিমানবন্দরে। ঠিক যখন বিমানের দরজা বন্ধ হচ্ছে, এক দৌড়ে উঠে গেলেন।”
পরিবারের ঘনিষ্ঠ এই নেতাকে শ্রদ্ধা করেন সনিয়াও। ২০০২-এ প্রথম রাজ্যসভায় আসেন রিশাং। ২০০৮-এ মেয়াদ শেষ হওয়ার পর সনিয়া তাঁকে সস্ত্রীক নৈশভোজে ডেকেছিলেন। “খাওয়ার পরে ধন্যবাদ দিতে গিয়েছি, সনিয়াজি বললেন, আমাকে ফের রাজ্যসভায় মনোনীত করা হয়েছে। বোঝাতে চাইলাম, শরীর অশক্ত। সনিয়া মজা করে বললেন, মনেপ্রাণে আপনি এখনও তরুণ”, বললেন রিশাং।
সংসদের ছবিটা যে অনেক পাল্টেছে, মানছেন তিনি। এক সময়ে নিজে সংসদে আসতেন সাইকেলে। এক বার ওয়ান-ওয়েতে ঢোকায় পুলিশেও ধরেছিল। সাংসদ পরিচয় দিয়ে ছাড়া পান। রিশাংয়ের মনে পড়ে, “স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম সারির নেতারা তখন সকলেই সংসদে নেহরু, বাবু জগজীবন রাম, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, হীরেন মুখোপাধ্যায়, নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বক্তৃতা শুনে গায়ে কাঁটা দিত। সংসদটা ছিল মন্দিরের মতো। গাঁধী-টুপি পরিহিত স্পিকার জি ভি মভলঙ্করকে মনে হত সেই মন্দিরের পুরোহিত। এত হট্টগোল হত না তখন। লোকসভায় স্পিকার বা রাজ্যসভার চেয়ারম্যানের রুলিংই ছিল শেষ কথা। এখনকার মতো অকারণ সংসদের সময়ও নষ্ট হত না।”
রিশাং আবার স্মৃতিতে ডুব দেন। |