রেওয়াজ বদলায়নি কর্মীদের |
সরকারি অফিস খালি সেই সাড়ে চারটেতেই |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
বুধবার বিকাল সাড়ে চারটে। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে মহাকরণের চার্চ গেট দিয়ে বেরোতে শুরু করেছেন সরকারি কর্মীরা। কেউ পা চালিয়ে, কেউ ধীরে। কোথায় চললেন? পাশ থেকে আচমকা প্রশ্নবাণে ঘড়িতে এক ঝলক চোখ বুলিয়ে উত্তর, ‘‘হয়েই তো এল (সময়)। দেখি আবার মিনিবাসের লাইনে কতক্ষণ দাঁড়াতে হয়!’’
আর এক জন ৪টে ৫০-এর কোনও ট্রেন ধরবেন শিয়ালদহ থেকে। খুব তাড়া। তাই দ্রুত এগোনোর জন্য জায়গা করে নিতে দু’এক জনকে কনুইয়ের গুঁতোও খেতে হল।
স্থান, বিধাননগরের ময়ূখভবন।
দিন কয়েক আগেই বিকাশ ভবনে একই ছবি নজরে এসেছিল খোদ শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর। বিকেল সাড়ে চারটের সময় সাত তলায় শিক্ষা অধিকরণ দফতরে গিয়ে দেখেছিলেন, ঘর অর্ধেক ফাঁকা। যাঁরা তখনও যাননি, তাঁরাও যাওয়ার প্রস্তুতিতেই ব্যস্ত! ব্রাত্যর নির্দেশেই ‘ফাঁকিবাজ’ কর্মীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় দফতর। নিয়ম ভাঙার দায়ে ৫১ জন কর্মীর অর্ধদিবস ছুটি কাটা গিয়েছে।
কিন্তু ‘ট্র্যাডিশন’ তাতে বদলেছে কি? বুধবার বিকেল সাড়ে চারটেয় খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, উদ্যান প্রতিপালন দফতরের ঘরগুলোয় উঁকি দিয়ে দেখা গেল, সাকুল্যে ১৫-২০ জন বসে। পাশে সুন্দরবন উন্নয়ন দফতরের ঘরে উঁকি মেরেও তার বেশি কর্মীর দেখা পাওয়া গেল না! এখানে যদিও বা কয়েক জন রয়েছেন, সল্টলেকের অন্য প্রান্তে নগরায়ণ ভবনের দোতলায় ‘ইস্যু অ্যান্ড ডেসপ্যাচ’ সেল একেবারে খাঁ খাঁ করছে। |
৩৪ বছরের বাম জমানায় সরকারি কর্মীদের ‘কাজ’ করার যে বহর দেখেছেন রাজ্যের মানুষ, ক্ষমতা বদলের পরে তার পরিবর্তন হবে বলে ভেবেছিলেন অনেকে। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সরকারের কাজে গতি আনতে কর্মীদের সহযোগিতা চেয়েছিলেন। কিন্তু কোথায় কী!
সোম থেকে শুক্র পর্যন্ত রাজ্য সরকারের কাজের দিন শুরু হয় সকাল সোয়া দশটায়। নিয়ম হল, ১০.১৫ থেকে ১০.৪৫-এর মধ্যে কোনও কর্মী কাজে যোগ দিলে তাঁকে রেজিস্ট্রি খাতায় দফতরের কর্তার দেওয়া লাল কালির ক্রস চিহ্নের উপর সই করতে হবে। মাসে এমন তিন দিন হলে তাঁর এক দিনের ছুটি কাটা যাবে। সোয়া এগারোটার পর কেউ এলে তিনি সই করতেই পারবেন না। ছুটির নির্দিষ্ট সময় হল বিকাল সোয়া পাঁচটা।
নিয়মের এই বেড়াজাল ভাঙছে রোজ। এবং কমবেশি প্রায় প্রতিটি দফতরে। যেমন এ দিনই, কৃষি দফতরের একটি বিভাগে সাড়ে ১১টায় অফিস পৌঁছে খাতায় সই করেছেন কোনও কোনও কর্মী। মহাকরণের কর্মী মহলেরই খবর, অনেক দফতরে মোটামুটি ১২টার মধ্যে অফিসে পৌঁছতে পারলেই আর ‘অনুপস্থিত’ হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। গত সোমবার মার্কিন বিদেশসচিব হিলারি ক্লিন্টন মহাকরণে গিয়েছিলেন। দুপুর ১২টায় তিনি যখন মহাকরণ ছেড়ে চলে যান, তার পরেও কর্মীদের অনেকে অফিসে পৌঁছেছেন। এক বার পৌঁছে গেলে ফেরাটা কার্যত নিজের প্রয়োজনের উপর নির্ভর করছে। রসিক এক কর্মীর কথায়, “এখন বাইরে চড়া রোদ বলে একটু দেরিতে (৪.৩০ মিনিটের আশপাশে) বেরোচ্ছি। শীতকালে সময়টা আর একটু এগিয়ে আসে।”
তবে কি অফিসে যাতায়াতের মধ্যেকার সময়ে কাজের পরিবেশ পাল্টাল?
সেখানেও ‘ট্র্যাডিশন’ অব্যাহতই। এ দিন প্রায় প্রতিটি দফতরের কর্মীদের একাংশের মধ্যে প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল গত কালের রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের নানা অভিজ্ঞতা। কখনও আইপিএল, কখনও সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর, কখনও আবার ঘরোয়া আলোচনাতেই সময় কেটে যাচ্ছে দেদার। অনেকের মতে, বিভিন্ন দফতরে ই-পরিষেবা চালু হওয়ায় ‘কাজের চাপ’ কমে গিয়েছে। তাই...। কারও মতে, নতুন সরকারের আমলে সরকারের কাজকর্মের ফাইল এখনও নিচুতলায় নামছে কম। তাই কাজও ‘কম’।
পূর্ত ভবনের এক তলায় বারাসত হাইওয়ে ডিভিশনের অফিসে দু’জন মাত্র লোক বসে। ন্যশনাল হাইওয়ের অথরিটি-র এগ্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারের অফিস ফাঁকা। পেনশন বিভাগ খালি। চার তলায় নারী ও শিশু কল্যাণ বিভাগে চার জন উঠি-উঠি করছেন। পাশেই পথশিশু ও ভবঘুরে নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের অফিস ফাঁকা। বিকাশ ভবনের ১০ তলায় জনশিক্ষা প্রসার অধিকার উইং-এর বিভিন্ন বিভাগে ৫০ শতাংশ আসনই ফাঁকা। ন’তলায় শিক্ষা দফতর ও শিক্ষা অধিকর্তার অফিসের অধীন বিভিন্ন বিভাগে কার্যত অর্ধেক চেয়ার ফাঁকা। ব্যতিক্রম সর্বশিক্ষা মিশনের অফিস। সেখানে তখনও প্রচুর কর্মী। এই বাড়িতেই কারিগরি শিক্ষার অধিকর্তার অফিসে দুপুর আড়াইটেতে চলছিল রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠান।
সরকারের কাজে গতি ফেরাতে মুখ্যমন্ত্রী ব্যতিক্রম ঘটিয়ে বিডিও-দের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের ঘটনাও নিয়মিত। অথচ কর্মীদের একটি বড় অংশের মধ্যে কর্মসংস্কৃতি ফেরানোর কোনও তাগিদ নেই। তাই এখনও অনায়াসেই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত জ্যোতি বসুকে উদ্ধৃত করে বলাই যায়, ‘কাকে বলব, চেয়ারকে’? |