ডিএম পাশ না ফেল, শেষ কথা বলবেন মুখ্যমন্ত্রীই |
দেবজিৎ ভট্টাচার্য • কলকাতা |
জেলাশাসকদের বার্ষিক কাজের চূড়ান্ত মূল্যায়নের ক্ষমতাও এ বার মুখ্যমন্ত্রী নিজের হাতে নিলেন। এত দিন দায়িত্বটা ছিল মুখ্যসচিবের। কিন্তু গত ২৭ মার্চ রাজ্যের কর্মীবর্গ ও প্রশাসনিক সংস্কার দফতর এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, বছরশেষে জেলাশাসকদের কাজের মূল্যায়ন (পারফরম্যান্স অ্যাপ্রাইজাল) সংক্রান্ত সুপারিশ সম্পর্কে চূড়ান্ত রায় দেবেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী।
সচিবস্তরের অফিসারদের বার্ষিক কাজের চূড়ান্ত মূল্যায়ন অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীই বরাবর করে থাকেন। জেলাস্তরে রাজ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ প্রতিনিধি যে হেতু জেলাশাসক, তাই তাঁদেরও একই নিয়মের আওতায় আনা হচ্ছে বলে প্রশাসনিক-সূত্রে জানানো হয়েছে। মহাকরণের এক মুখপাত্রের কথায়, “সাধারণ প্রশাসনে ডিএমের মতো অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ ওই নিয়মের বাইরে ছিল। এখন তাঁদেরও এর আওতায় আনা হল।”
তা হলে কি সমস্ত জেলাশাসকের কাজের মান কী রকম, সেটা মুখ্যমন্ত্রীই বলে দেবেন?
সরকারি সূত্রের ব্যাখ্যা: সেই ক্ষমতাটা মুখ্যমন্ত্রীর হাতে থাকছে। ঠিক সচিবদের বেলায় যেমন রয়েছে। সচিবেরা নিজেদের কাজের মূল্যায়ন করে মুখ্যসচিবকে রিপোর্ট দেন। সেখান থেকে বিভাগীয় মন্ত্রীর হাত ঘুরে তা যায় মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। কোনও সচিবের ‘পারফরম্যান্স’ সম্পর্কে মন্ত্রীর মতামত মুখ্যমন্ত্রী গ্রহণ করতে পারেন। না-ও পারেন। বস্তুত মুখ্যমন্ত্রী ভিন্নমত পোষণ করলে কারণটা যাতে তিনি জানাতে পারেন, সে জন্য অ্যাপ্রাইজাল ফর্মে জায়গাও থাকে বলে জানিয়েছেন এক আইএএস অফিসার। তাঁর মন্তব্য, “সচিবদের ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী সাধারণত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর সুপারিশ গ্রহণ করে থাকেন। তবে না-করার ক্ষমতাও তাঁর বিলক্ষণ রয়েছে।”
জেলাশাসকদের বেলায় এমনই হতে চলেছে। পুরনো নিয়মে জেলাশাসকদের কাজের বছরওয়াড়ি মূল্যায়ন করতেন প্রথমে ডিভিশনাল কমিশনার। তাঁর মন্তব্য-সহ রিপোর্ট যেত ভূমি-কমিশনারের কাছে। পরবর্তী ও চূড়ান্ত ধাপ ছিল মুখ্যসচিব। ২৭ মার্চের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এখন ডিভিশনাল কমিশনার থেকে মূল্যায়ন-নথি সরাসরি যাবে মুখ্যসচিবের কাছে। মুখ্যসচিবের ‘পর্যালোচনা’-সহ রিপোর্ট পৌঁছাবে মুখ্যমন্ত্রীর টেবিলে। মুখ্যমন্ত্রী রিপোর্টের সুপারিশ গ্রহণ করতে পারেন। আবার ভিন্ন মূল্যায়নও দিতে পারেন। যা-ই করুন, তাঁর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে। ২০১১-র ১ এপ্রিলের পরে যাঁদের অ্যাপ্রাইজাল রিপোর্ট জমা পড়েছে, তাঁরাও নতুন নিয়মের আওতায় পড়বেন।
অর্থাৎ, রাজ্যে নতুন সরকারের সূচনালগ্ন থেকেই ডিএম-দের যোগ্যতামান যাচাইয়ের ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আমলারা কী বলছেন?
সচিবস্তরের অফিসারদের একাংশের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী জেলা প্রশাসনের নিচুতলার সঙ্গেও ‘নিবিড় সম্পর্ক’ গড়তে আগ্রহী। তারই প্রতিফলন নয়া বিজ্ঞপ্তিতে। সচিবস্তরের এক অফিসার বলেন, “ডিএম’দের কাজের পরিসর অনেক বেড়েছে। গ্রামোন্নয়ন, আবগারি, দমকল, এমনকী চাষিদের থেকে সরাসরি চাল সংগ্রহেরও দায়িত্ব তাঁদের দেওয়া হচ্ছে। এতে রাজ্য প্রশাসনের প্রধানের সঙ্গে ডিএমের সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ তৈরি হচ্ছে।”
এবং এই পরিস্থিতিতে তাঁদের কাজের মূল্যায়নে মুখ্যমন্ত্রীর মতই চূড়ান্ত হওয়া উচিত বলে মনে করছেন আমলামহলের একাংশ। অন্য অংশ অবশ্য অশনি সঙ্কেত দেখছেন। এঁদের বক্তব্য: লোকাভাব, পরিকাঠামোয় খামতি, সর্বোপরি আর্থিক সঙ্কটে বহু প্রকল্প থমকে রয়েছে। ভুল-ত্রুটি হলে মুখ্যসচিবের কাছে কারণ ব্যাখ্যা করার যে সুযোগ জেলাশাসকদের থাকত, এখন তা থাকবে না। এই মহলের কারও কারও অভিযোগ, জেলাশাসকদের রাজনৈতিক ভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। চাকরির উন্নতিতে যে হেতু পারফরম্যান্স অ্যাপ্রাইজাল রিপোর্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তাই বহু ক্ষেত্রে জেলাশাসকদের এ বার ‘রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা’র মুখোমুখি হতে হবে বলে আশঙ্কা করছেন এঁরা। পাশাপাশি জেলাশাসকদের একাংশের প্রশ্ন, তাঁদের কাজের মূল্যায়নে মুখ্যমন্ত্রী যদি ‘শেষ কথা’ বলেন, তা হলে পুলিশ সুপারদের ক্ষেত্রে নয় কেন? স্বরাষ্ট্র দফতর তো মুখ্যমন্ত্রীর হাতেই!
রাজ্য পুলিশের এক কর্তা জানিয়েছেন, এখানেও নতুন নিয়ম চালু হয়েছে। এত দিন এসপি’র পারফরম্যান্স অ্যাপ্রাইজাল রিপোর্টে প্রথম মন্তব্য করতেন সংশ্লিষ্ট রেঞ্জের ডিআইজি। তার পরে জোনের আইজি এবং ডিজি-র মতামত সমেত নথি যেত স্বরাষ্ট্র-সচিবের কাছে। মাস তিনেক আগে এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, রিপোর্টে এডিজি (আইবি)-র মন্তব্যও থাকতে হবে। কেন?
একাধিক পুলিশকর্তার বক্তব্য, এসপি যে হেতু জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিআইবি)-রও দায়িত্বে, তাই তাঁর কাজের মূল্যায়নে এডিজি (আইবি)-রও মন্তব্য থাকা আবশ্যিক। যদিও পুলিশকর্তাদের একাংশের মতে, এই ব্যবস্থার মাধ্যমে এসপি’দের ‘রাজনৈতিক আনুগত্যের’ খবরই পেতে চাইছে মহাকরণ। এবং পদোন্নতির ক্ষেত্রে এটা বিশেষ ভূমিকা নেবে বলে এঁদের আশঙ্কা। |