উন্নয়নের পরিভাষায় যাহাকে ‘অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন’ অর্থাৎ ইতিবাচক পক্ষপাতিত্ব বলা হইয়া থাকে, তাহার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কোনও একটি বিশেষ ধর্ম বা সম্প্রদায়ের মানুষ যদি পিছাইয়া থাকেন, সরকারকে আলাদা করিয়া তাহাদের পার্শ্বে থাকিতে হইবে বইকী। আর পাঁচ জন যে সুবিধা পায়, অনগ্রসর মানুষকে তাহার অতিরিক্ত সুবিধা দিতে হইবে, তাহাদের উন্নয়নের জন্য বিশেষ ভাবে যত্ন করিতে হইবে। ভারতীয় রাজনীতি এই ইতিবাচক পক্ষপাতিত্বের ধারণাটিকে নিজেদের সুবিধার্থে এত রকম ভাবে দুমড়াইয়া মুচড়াইয়া লইয়াছে যে তাহার প্রকৃত রূপটি চেনা কার্যত অসম্ভব হইয়াছে। রাজনীতির ঘোলা জলে ইতিবাচক পক্ষপাতিত্বের একটিই অর্থ ক্ষুদ্র নির্বাচনী স্বার্থের কথা ভাবিয়া কিছু পাওয়াইয়া দেওয়া। তাহার বহু রূপ। হজ যাত্রীদের জন্য ভর্তুকির ব্যবস্থা করা সেই বহু রূপের একটি। ২০১১ সালে মোট এক লক্ষ পঁচিশ হাজার মুসলমান হজ করিতে গিয়াছিলেন। যাত্রী-পিছু সরকার বিমানভাড়ায় প্রায় ১৪,০০০ টাকা ভর্তুকি দেয়। গত বৎসর মোট ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ৬৮৫ কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ অর্থ, এবং সম্পূর্ণ অহেতুক ব্যয়। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের নিকট হজযাত্রার গুরুত্ব অসীম। কিন্তু, তাহার দায় সরকারের নহে। বস্তুত, সৎপথে স্বোপার্জিত অর্থ ব্যয় করিয়া হজে যাওয়াই নিয়ম। সুপ্রিম কোর্ট পবিত্র কোরান হইতে উদ্ধার করিয়া বলিয়াছে, হয়তো অধিকাংশ হজযাত্রীই জানেন না, সরকার তাঁহাদের যাত্রাবাবদ এই পরিমাণ টাকা ভর্তুকি দেয়, জানিলে হয়তো তাঁহারা বিব্রতই হইতেন। দেশের শীর্ষ আদালত সরকারকে আদেশ করিয়াছে, দশ বৎসরে ধাপে ধাপে ভর্তুকি বন্ধ করিতে হইবে। হজে সরকারি প্রতিনিধিদল পাঠানোও চলিবে না। বিভিন্ন রাজ্যের হজ কমিটির কাজের পর্যালোচনা করিতে হইবে। ভর্তুকি যদি দিতেই হয়, তবে যে ক্ষেত্রে ব্যয় করিলে অধিকতম মানুষের উন্নয়ন সম্ভব, তাহাই ভর্তুকির গন্তব্য হওয়া বিধেয়। হজযাত্রায় সেই উন্নয়নের সম্ভাবনা নাই। যেমন, ইমামদের জন্য মাসিক ভাতার ব্যবস্থা করিলে, অথবা তাঁহাদের জন্য বাড়ি বানাইয়া দিলেও মুসলমান সমাজের উন্নতি হইবে না। এই সকলই ক্ষুদ্র রাজনীতির খেলা। বস্তুত, রাজনীতিকরা এখনও মুসলমানদের ভোটব্যাঙ্ক ভাবিতেই অভ্যস্ত। এই অভ্যাসটি ত্যাগ করিবার সময় আসিয়াছে। বিগত বেশ কয়েকটি নির্বাচন প্রমাণ করিয়াছে, মুসলমানরা শুধুমাত্র মুসলমান হওয়ার কারণেই ঝাঁক বাঁধিয়া কোনও বিশেষ দলকে ভোট দেন না। আর পাঁচটি সম্প্রদায়ের মানুষ যে ভাবে ভোট দিবার সিদ্ধান্ত করেন, মুসলমানরা তাহার ব্যতিক্রম নহেন। কাজেই, তোষণের ভ্রান্ত নীতি আর রাজনৈতিক ভাবেও লাভজনক নহে। মুসলমান সমাজের জন্য কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন বন্ধ করিয়া প্রকৃত উন্নয়নের প্রয়াস করিবার সময় আসিয়াছে। সুপ্রিম কোর্ট বলিয়াছে, হজের ভর্তুকি বন্ধ করিয়া সরকার সেই টাকা মুসলমান সমাজের উন্নয়নের জন্য ব্যয় করুক। এই কথাটি আদালতকে বলিয়া দিতে হইতেছে, তাহা দুর্ভাগ্যের। রাজনীতিকরা যখন স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া কাজটি করিতে পারেন নাই, তখন সুপ্রিম কোর্টের কথাতেই না হয় করুন। মুসলমান সমাজ সত্যই শিক্ষায় পিছাইয়া আছে। মুসলমানদের শিক্ষাখাতে বিশেষ বিনিয়োগের ব্যবস্থা হউক। মুসলমান সম্প্রদায়ের ছাত্রদের জন্য জলপানি তৈরি হউক। মুসলমান-প্রধান অঞ্চলে স্বাস্থ্য প্রকল্পে, জনস্বাস্থ্যে, সচেতনতা বৃদ্ধিতে সরকার উদ্যোগ করুক। মুসলমান সমাজের সিংহভাগ এখনও উন্নয়নের মূলস্রোতে আসিতে পারে নাই। একবিংশ শতাব্দীর ‘ইন্ডিয়া’র পাসপোর্ট তাহাদের জুটে নাই। সরকার সেই ব্যবস্থা করুক। ভোটের রাজনীতি অনেক হইয়াছে। উন্নয়নের রাজনীতির অভিষেক ঘটুক। |