প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নানা বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন। কিন্তু বাঙালির ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির পরিচয় দিবার প্রয়োজন হইলে তাঁহারা উভয়েই রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হইয়া থাকেন। যেন তাঁহার রচনা, তাঁহার গানই বিশ্বের প্রতি বাঙালির শ্রেষ্ঠতম উপহার। মার্কিন বিদেশ সচিব হিলারি ক্লিন্টনকে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর উপহার দেখিয়া সেই কথাই স্পষ্ট হইল। এই ধারণা লইয়া পুনরায় চিন্তা করিবার প্রয়োজন আছে। রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য-শিল্প-সমাজচিন্তায় অতি মহৎ অবদান রাখিয়াছেন, তাঁহার জীবনে ও সৃষ্টিতে মুগ্ধ হইবার মতো বস্তুর অভাব নাই। কিন্তু বিশ্ববাসীর নিকট তাহাই সর্বাধিক আগ্রহের বিষয় হইবে, তাহা ধরিয়া লইতে হইবে কেন? এ ব্রহ্মাণ্ডের উপাদান যত কণা রহিয়াছে, কার্যত তাহার অর্ধেকই এক বাঙালির নামাঙ্কিত। তাঁহার নাম সত্যেন্দ্রনাথ বসু। ‘বোসন’ বলিয়া পরিচিত অণু হইতেও ক্ষুদ্রতর কণাগুলি যে নিয়ম মানিয়া চলে, তাহা সত্যেন্দ্রনাথেরই আবিষ্কার, এবং এ রাজ্যে থাকিয়াই তিনি পদার্থবিদ্যায় তাঁহার সেই মহৎ অবদান রাখিয়াছিলেন। অথচ এই অসামান্য বিজ্ঞানীর পরিচয়ে বাঙালি নিজের জাতির পরিচয় দিতে আগ্রহী নহে, বিদেশিদের নিকট বাঙালির প্রতিনিধি বলিয়া তাঁহার উপস্থাপনা কখনও করা হইয়াছে বলিয়া কাহারও মনে পড়িবে না। তেমনই বিস্মৃত জগদীশচন্দ্র বসু। এমন কোনও রাষ্ট্রনায়ক নাই, যিনি মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না। ‘টেলিকমিউনিকেশন’ বা বেতার সংযোগের একেবারে মূলে রহিয়াছে জগদীশচন্দ্রেরই গবেষণা, কলিকাতা শহরের প্রেসিডেন্সি কলেজের ঘরে বসিয়া যাহা তিনি করিয়াছিলেন। গোটা বিশ্বের নিকট তাহা প্রযুক্তির যে বিবর্তনের সূচনা করিয়াছিল, সেই পথ বাহিয়াই আজ তথ্য বিপ্লব ঘটিয়াছে। বহু রাষ্ট্রে যা সমাজ বিপ্লবেরও সূচনা করিয়াছে। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং জগদীশচন্দ্রের গুণগ্রাহী ছিলেন, দুঃসময়ে বন্ধুর গবেষণায় অর্থ জুগাইয়া, উৎসাহ দিয়া সহায়তা করিয়াছেন। জগদীশচন্দ্র যে আজ বাংলার জননায়কদের মন হইতে এক প্রকার বিস্মৃত হইয়াছেন, তাঁহার কীর্তি যে বিশ্বের নিকট বাংলার ঐতিহ্যের স্বাক্ষর হইয়া ওঠে নাই, ইহা রবীন্দ্রনাথের বিচার-বিবেচনার প্রতিও এক প্রকার অনাস্থা বলিলে ভুল হয় না। যে কোনও উন্নত জাতিরই সাহিত্য-সংগীতপ্রীতি রহিয়াছে, কিন্তু তাহাদের নান্দনিক বোধ তাহাদের বিজ্ঞান চেতনা কিংবা সমাজ ভাবনার পথ রুদ্ধ করিয়া দাঁড়ায় নাই। বাঙালির দুর্ভাগ্য, বঙ্গদেশে ইহাই ঘটিয়াছে। পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিত, প্রাণিবিজ্ঞান প্রভৃতির চর্চা করিয়া বিদেশে যাঁহারা বহু সম্মান লাভ করিয়াছেন, এমনকী জাতীয় পুরস্কারও পাইয়াছেন, নিজের রাজ্যে তাঁহাদের স্বীকৃতি মিলিয়াছে অতি সামান্য। সমাজ জীবনে তাঁহারা কখনওই গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করিতে পারেন নাই। অথচ তাঁহাদের জীবনচরিত সমাজে চর্চিত হইলে বহু প্রজন্ম উপকৃত হইত। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জন্মোৎসব দেড়শত বৎসরেও স্কুল-কলেজে হইয়াছে অতি সামান্য, অথচ বিজ্ঞান-গবেষণার মাধ্যমে দেশের উন্নয়নের যে চিন্তা তিনি করিয়াছিলেন, তাহা আজ জাতীয় নীতি বলিয়া অনুসৃত হইতেছে। মেঘনাদ সাহা কেবল মৌলিক গবেষণা করেন নাই, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রশাসনিক নীতি প্রণয়নের মূলে রাখিয়াছিলেন। আজ অর্থনীতিবিদরা তাহার প্রয়োজনের কথাই বলিতেছেন। আজও বাঙালির সম্মুখে রহিয়াছেন দিলীপ মহলানবিশের মতো চিকিৎসক-বিজ্ঞানী, ডায়ারিয়ার চিকিৎসায় যাঁহার প্রদর্শিত পদ্ধতি (ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপি) অনুসরণ করিয়া বিশ্বের লক্ষ লক্ষ শিশুর প্রাণরক্ষা হইয়াছে। ইঁহারা বাংলারই পরিচয়। ইঁহারাই বাংলার পরিচয়। |