প্রবন্ধ ১...
নব্য অভিজাততন্ত্র থেকে রাজ্যবাসীকে বাঁচাবে কে
বিশেষজ্ঞ এবং অর্থনীতিবিদরা সমাজের সম্মান পান। গণতন্ত্রকে এঁরা সফল করে তোলেন বিশেষ জ্ঞানের জোগান দিয়ে, তাই সাধারণ রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক কর্মীরা এঁদের কুর্নিশ করেন, শ্রদ্ধা করেন, উপদেষ্টার আসনে বসান। এঁদের যাথার্থ্য বা সঙ্গত পরিচয় এই জন্য নয় যে, এঁরা প্রধানমন্ত্রী অথবা অন্য বড় বড় মন্ত্রী দ্বারা নিযুক্ত, বরং এঁদের বিশেষ জ্ঞান আছে, প্রজ্ঞা আছে, যা সাধারণ রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের নেই। আর সাধারণ মানুষের তো নেই-ই।
শাসনের জন্য উপদেষ্টা রাখা নতুন কোনও ব্যাপার নয়। কৌটিল্যের সময় থেকে উপদেষ্টাদের কথা আমরা শুনে আসছি। কিন্তু তাঁদের গুরুত্ব সে যুগে ছিল সীমাবদ্ধ। নীতিকথায় আবদ্ধ। কখনও রাজস্ব সংগ্রহের প্রণালী সম্পর্কে উপদেশ, কখনও মানবসম্পর্ক উপলব্ধি থেকে উপদেশ। এক কথায় সুশাসন কাকে বলে, তা নিয়ে বিশেষ জ্ঞান। এর বাইরে বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা ছিল না। রাজার মাথার উপর অমাত্য বিশেষজ্ঞদের চড়ে বসার কথা ভাবা যেত না। মন্ত্রী অমাত্যবর্গের গর্দানের দাম এমন কিছু ছিল না। বিশেষজ্ঞরা নিজেরাও মনে করতেন না, তাঁরা এক বিশেষ জীব। বিশেষ সম্মানের পাত্র বা প্রশ্নের অতীত।
ভারত মানে কেন্দ্র নয়। মুখ্যমন্ত্রীর সম্মেলন, দিল্লি, ৫ মে ২০১২। ছবি: পি টি আই।
আধুনিক কালে প্রশাসনের জটিলতায় সে যুগের রীতি আর চলে না। বিশেষত, বিশ্বায়নের যুগে কীসের সঙ্গে সম্পর্ক, কীসের অগ্রগতি বা পশ্চাদ্গতি, তা খালি এই বিশেষজ্ঞ এবং অর্থনীতিবিদরাই বোঝেন। তাঁদের ছাড়া প্রশাসন চলে না। এঁরা আধুনিক উন্নয়নকেন্দ্রিক প্রশাসন ব্যবস্থার আত্মা। এঁরা ভূয়োদর্শী। অনেক রহস্যের চাবিকাঠি এঁদের হাতে। এঁদের প্রজ্ঞায় ঠিক হয়, আমরা কেমন চলব, কী ভাবে জীবন কাটাব।

কিন্তু বিশেষ জ্ঞান তো নানা রকমের হতে পারে, সব জ্ঞানেরই কি একই কদর? মোটেই নয়, শরীর, স্বাস্থ্য, সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা, সাহিত্য, দর্শন এ সব নিয়ে বিশেষ জ্ঞান থাকতে পারে। সেই পারদর্শিতায় কিছু সম্মান পাওয়া যায়, কিন্তু ক্ষমতার স্বীকৃতি আসে না। গণতন্ত্রে এই সব বিশেষ জ্ঞানের তেমন কদর নেই। ভাল সংগীত জানেন, সরকার সাহায্য করবে যথাসাধ্য, যদি আপনি চান। কিন্তু সংগীতজ্ঞকে কেউ উপদেষ্টা করে না। অর্থনীতি শাস্ত্রের এবং তথ্যবিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির মর্যাদা আলাদা। বাজারের রহস্য যাঁরা জানেন, তাঁদের মর্যাদা সর্বোচ্চ।
যেমন ধরুন, বর্তমান ভারত সরকারের পাঁচ জন সম্মানিত বিশেষজ্ঞ এবং অর্থনীতিবিদের নাম: কৌশিক বসু, মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া, সি রঙ্গরাজন, নন্দন নিলেকানি এবং স্যাম পিত্রোদা। কেউ পরামর্শ দেন শিক্ষা সম্পর্কে। কেউ আমাদের অদ্বিতীয় পরিচয় লাভের পথ বাতলাচ্ছেন। কেউ পরিকল্পনা মাফিক কী ভাবে বাজারের প্রসার ঘটানো যায় তা নিয়ে চিন্তারত। কারও মাথাব্যথা কী ভাবে বাজারে টাকার জোগান বা চাহিদা কমানো যায়। কারও কাজ, দেশের অর্থনীতিতে সমৃদ্ধির বন্যা আনার জন্য ক্রমাগত বিদেশি পুঁজির দ্বার সুগম করা। কারও পরিচয় সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, কারও পরিচয় পরিকল্পনা কমিশনের উপপ্রধান, কেউ অদ্বিতীয় পরিচয় সৃষ্টি সংস্থার মুখ্য প্রশাসক, কারও পরিচয় আবার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মণ্ডলীর প্রধান রূপে।
এঁরা প্রত্যেকে খবরের শিরোনামে এসেছেন। কেউ বলছেন, গণতন্ত্র হল খারাপ, অপরিচ্ছন্ন রাজনীতি যা অর্থনীতির পথ রুদ্ধ করছে, সবাইকে নিয়ে চলতে গিয়ে সরকার বিদেশি পুঁজি আনার কাজে ঢিলেমি দেখাচ্ছে। কেউ বলছেন, আগে অদ্বিতীয় পরিচয় প্রতিটি লোকের আসুক, তবেই না জনকল্যাণ বাস্তবায়িত হবে। কেউ আবার বলছেন, দারিদ্র নিয়ে এত মাথাব্যথা কেন, দৈনিক পাঁচশো টাকায় পাঁচ জনের সংসার চলে, তাই দরিদ্র ভারতবাসীর সংখ্যা কমে গেছে। দেশের অর্থনীতি কেন বাড়ছে না, এই পাঁচ জন বিশেষজ্ঞের একই মত। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে না, শিক্ষা, খুচরো ব্যবসা, পেনশন ফান্ড সব কিছুতে বিনিয়োগ চাই। অথবা বিনিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়া চাই। এক দিকে এঁরা বা এঁদের কেউ কেউ বলছেন, ইউরোপে ব্যাঙ্কগুলো যে ঋণ দিয়েছে, সেই বিপুল পরিমাণ ঋণ তারা ফেরত পাবে না। বা দেশগুলো সেই ঋণের সুদ-আসল ফেরত দিতে গিয়ে নিজেদের অর্থনীতিকে যে পরিমাণ সঙ্কুচিত করবে, তাতে ব্যাঙ্ক এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান মার খাবে। আবার একই সঙ্গে তাঁরা এ কথাও বলছেন যে, আরও ঢালাও ভাবে এরা এ দেশে আসুক, অন্যদের আসতে সাহায্য করুক।
এঁদের কেউ বলছেন না যে, সরকার যে সব সুযোগসুবিধা এ দেশে বেসরকারি ব্যবসায় দিয়েছে গত পাঁচ বছর ধরে, যার পরিমাণ চার লাখ কোটি টাকার মতো, সেগুলো এ বার বন্ধ হোক। বা রাজস্বের এই বিপুল ক্ষতি সামলাবার পথ সরকার বার করুক। সকলেরই কথা, ডিজেলের উপর নিয়ন্ত্রণ শেষ হোক, খাদ্যশস্যের রফতানি শুরু হোক, কৃষকদের জন্য যে সব সাহায্য ব্যবস্থা আছে তা কমানো হোক, সরকারের ব্যয় কমুক, বিদেশি পুঁজি আসুক, ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের সুবিধে দেওয়া হোক, যাতে তাদের উৎপাদন ও ব্যবসা বাড়ে। এই হল অর্থনৈতিক উন্নয়নের রাস্তা। উৎপাদন বৃদ্ধির অন্য পথ নেই। এই হল সুঅর্থনীতি। এই ভাল অর্থনীতিকে নষ্ট করছে খারাপ রাজনীতি। বিশেষজ্ঞদের দীর্ঘশ্বাস এই জন্য।

এরই মধ্যে কিন্তু একটা ব্যাপার ঘটে গিয়েছে ভারতে। ভারতের নানা অঞ্চলে। গত কয়েক দশকে দেশের বিভিন্ন রাজ্য নিজস্ব পরিস্থিতি অনুযায়ী নানা ভাবে এগিয়ে গিয়েছে নানা দিকে। কেউ শিক্ষা বিস্তারে, কেউ রাস্তাঘাট নির্মাণে, কেউ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতিতে, কেউ সামাজিক কল্যাণ এবং সুরক্ষায়, কেউ কৃষিতে, কেউ পরিবেশ রক্ষা এবং উন্নয়নে, কেউ বা শিল্পে। এ সবের থেকে কী শিক্ষণীয়, তা নিয়ে এই বিশেষজ্ঞরা যথেষ্ট ভাবেন কি? কখনও কি আমরা ভেবেছি, দেশের নানা স্থানে যে সব ভাল কাজ হয়েছে, হচ্ছে, রাজ্যগুলোর প্রশাসনের যে সুবিপুল এবং বিচিত্র, বহুগামী অভিজ্ঞতা, তার পিছনে রহস্য কী? কোন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, তথ্যবিজ্ঞানী এবং বিদেশে কর্মরত অর্থনীতিবিদ এই সবের জন্য কাজে লেগেছে? কেন দেশজ জ্ঞান, বুদ্ধি, এ ক্ষেত্রে বেশি ফলপ্রসূ? কেন কেন্দ্রের রাজনীতির আয়নায় মনে হয়, গণতন্ত্র, বহুদল, মোর্চা রাজনীতির বাধ্যবাধকতা, সংসদের উপস্থিতি এই সব ব্যাপার ভাল অর্থনীতির পথে বাধা?
অথচ, এটা সত্য যে, দেশ আজ ইন্দিরা গাঁধীর সময় থেকে অনেক এগিয়েছে, যার ফলে সরকারকে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হয়। সংখ্যার জেরে সব কিছু করা যায় না। সংস্কারের সুফল সম্পর্কে জনগণকে না-বুঝিয়ে কিছু করা যায় না। এবং যাদের সঙ্গে মোর্চা তৈরি করে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করতে হয়, তাদের ভিত্তি হল এ দেশে, রাজ্যে রাজ্যে। তাদের সহমত অর্জন না-করে এগোনোর উপায় নেই। বরং প্রদেশগুলোর নানা সাফল্য থেকে শিখলে কেন্দ্রের সরকারেরই লাভ। এই উপলব্ধির ক্ষমতা বিশেষজ্ঞদের আয়ত্তের অতীত। তার কারণ, তাঁরা না জনআন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করেন, না নির্বাচন জিতে জনপ্রতিনিধিত্বে সক্ষম। তাঁরা পেশাদার। ফলে, জনতার প্রতি তাঁদের দায়িত্ব নেই।
কিন্তু এঁদের প্রদর্শিত পথের বা উপদেশের কুফলের বোঝা কে বইবে? বইতে হবে দেশের নানা প্রদেশের জনসাধারণকে। আমাদের দেশে দায়িত্বশীলতার পাকদণ্ডী এই রকমই। তাই আরও বোঝা দরকার যে, দেশে যদি এই প্রাদেশিক ব্যবস্থা বিন্যাস না-থাকত, নানা স্তরে স্বায়ত্তব্যবস্থা না-থাকত, স্বাধিকারের দাবিতে বিভিন্ন রূপে গণসংগ্রাম না-ঘটত, তা হলে এই অভিজাতদের বিশেষ জ্ঞান এবং মস্তিষ্কপ্রসূত কল্পচারী নীতির বোঝা আরও বেশি বইতে হত জনসাধারণকে।
বিভিন্ন প্রদেশে আজ অপেক্ষাকৃত নিচু স্তর থেকে শাসকরা উঠে আসছেন নির্বাচনের মাধ্যমে। যা, একার্থে বলা যায়, রাস্তার রাজনীতি বা জনপ্রিয় রাজনীতি এবং নির্বাচনী রাজনীতির যোগফল। যে সব স্তর এখনও শাসনের অংশীদার হয়নি, তারা আজ অংশীদার হচ্ছে। ফলে, শাসনরীতিও পাল্টাচ্ছে। কেন্দ্রে এখনও পুরনো অভিজাত শাসকবর্গ জাঁকিয়ে আছে, কিন্তু প্রদেশগুলোয় শাসক কাঠামোর অবয়বে পরিবর্তন আসছে। খুব সীমিত হলেও, জনসাধারণের জীবন-জীবিকা রক্ষার সংগ্রামের যে চাপ, তাতে রাজ্য স্তরে কিছু জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থা গৃহীত হচ্ছে। ফলে, অভ্যন্তরীণ চাহিদা অল্প হলেও বাড়ছে। এই সব নানা কারণে প্রদেশের নির্বাচনগুলো আজ কেন্দ্রে সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত নির্বাচন থেকে অধিক তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
তাই এই অর্বাচীন রাজ্যশাসকদের দুর্বিনীত আচরণ অভিজাত শাসককুলের উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। তাঁদের ক্রমবর্ধমান চিন্তার উদ্রেক করছেন রাজ্যে রাজ্যে এই শাসক সম্প্রদায়। এই নব্যশাসক সম্প্রদায়ের সদস্যরা যে যার নিজের রাজ্য নিয়ে ভাবেন, সারা ভারত নিয়ে এঁরা অযথা উদ্বেগ করেন না। ফলে, সর্বভারতীয় অর্থপতি এবং শাসকদের সঙ্গে এঁরা দর কষাকষি করেন অনেক বেশি। বিহারের সাম্প্রতিক ইতিহাস দেখলে বোঝা যায়, রাজ্যের শাসনব্যবস্থায় কী ভাবে অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তর থেকে এই নব্যশাসকরা উঠে এসেছেন। পশ্চিমবঙ্গেও এক ধরনের সামাজিক পরিবর্তন ঘটছে। আঞ্চলিক ব্যবসায়ী, অর্থবান, এবং অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তর থেকে নানা ব্যক্তি এই নব্য শাসককুলে যোগদান করছেন। এঁরা পুরনো বামপন্থী ভদ্রলোকদের মতো নন। গোটা পৃথিবী এবং গোটা দেশের মঙ্গল নিয়ে এঁদের চব্বিশ ঘণ্টা কাটে না। এঁদের মাথাব্যথা হল, আঞ্চলিক শান্তি সমৃদ্ধি আসবে কী করে?
এক অর্থে, আমরা যা দেখছি, তা হল কেন্দ্রে এক নতুন অভিজাত শাসককুল, এবং আঞ্চলিক স্তরে নিম্ন স্তরের উত্থান। রাইজ অব দ্য লো-ব্রাও। মধ্যবিত্তকুল এতে আশঙ্কিত। শিক্ষার পালিশ নেই, তাৎক্ষণিক বিচারে শাসন করার ঝোঁক, রণনীতির অভাব, বিশেষ জ্ঞানের অভাব, সমস্যা দেখলে সেখানে আগুন নেভানোর রীতিতে ছোটাছুটি, আলাপচারিতা দিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা মধ্যবিত্ত এদের এই রীতিতে অভ্যস্ত নন। মধ্যবিত্ত শঙ্কা, এ কেমন শাসনরীতি? শৃঙ্খলাবদ্ধ শাসকগোষ্ঠী হয়ে উঠতে এঁদের সময় লাগবে। হয়তো কোনও দিনই এঁরা কংগ্রেস বা সিপিআইএম-এর মতো সুবিন্যস্ত শাসক দল হবেন না। কারণ, জনপ্রিয়তাবাদের মৌলিক সীমাবদ্ধতা থেকেই যাবে। জনপ্রিয়তাবাদ সমাজের মৌল রূপান্তর আনে না।
মধ্যবিত্তরা পছন্দ করুন আর না-ই করুন, আপাতত, কেন্দ্রে পুঞ্জীভূত নব্য অর্থনীতিবিদ এবং প্রযুক্তিবিদদের হাত থেকে এই নিম্নস্তরই রাজ্যবাসীকে বাঁচাবে। তা, তাদের শাসনরীতি যতই অভদ্র ও অসংস্কৃত মনে হোক না কেন।

লেখক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ-এর অধিকর্তা। মতামত ব্যক্তিগত


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.