আসছে পুরভোট। ফিরছে রাজনীতির লড়াই। কিন্তু কেমন আছে দুর্গাপুর?
ওয়ার্ডে ঘুরে-ঘুরে খোঁজ নিচ্ছে আনন্দবাজার। আজ ওয়ার্ড ৩৯ ও ৪০। |
একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন?...
প্রশ্নটা চেনা।
শ্যামাপ্রসাদ কুণ্ডুকে হাতের কাছে পেলে দুর্গাপুরের অনেকেই ঝপ করে প্রশ্নটা করে ফেলতে চান। যদিও উত্তর যে মিলবেই, সে নিশ্চয়তা নেই।
৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম কাউন্সিলর শ্যামাপ্রসাদবাবুই গত পাঁচ বছর যাবৎ শহরে পানীয় জল সরবরাহের দায়িত্বে। প্রায় খোলনলচে বদলে ফেলার প্রার্থিতালিকায় পুরনো যে তিন মেয়র পারিষদকে বামফ্রন্ট এ বারও টিকিট দিয়েছে, তিনি তার অন্যতম। ফলে ধরেই নেওয়া যায়, তাঁর কাজে নেতারা খুশি।
কিন্তু নেতা আর জনতা তো এক নয়! সকলেই শুধু জল নিয়ে খুশি নন। এমনকী জল নিয়ে কাউন্সিলরের কৃতিত্বের দাবিতেও জল ঢেলে দিয়েছেন অনেকে। শ্যামাপদবাবু যতই বলুন ‘আমার ওয়ার্ডে কুয়ো আছে, ট্যাপও আছে, জলসঙ্কট নেই’ সকলে তা নির্দ্বিধায় মানছেন না। বরং বিরোধীরা উল্টে দেখাচ্ছেন, নতুনপল্লির মতো কিছু জায়গায় যথেষ্ট জলকষ্ট রয়েছে।
ডিপিএল টাউনশিপের একাংশ, বিদ্যাসাগরপল্লি, ক্ষুদিরামপল্লি, আশিস নগর কলোনি, হ্যানিম্যান সরণির দুই পাশে বিরসা মুন্ডা ও নতুনপল্লি নিয়ে প্রায় ৩.২৫ বর্গ কিলোমিটার ছড়ানো ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড। কাউন্সিলরের দাবি, দামোদরের ফিডার ক্যানাল থেকে শ্বেতকালী মন্দির পর্যন্ত প্রায় ১৪ লক্ষ টাকা খরচে পিচরাস্তা ও ঢালাই রাস্তা করা হয়েছে। আশিসনগরের অধিকাংশ অলিগলি-রাস্তা কংক্রিটের। ডিপিএল কলোনিতে দু’টি শিশু উদ্যানের সংস্কার হয়েছে। গড়াও হয়েছে নতুন দু’টি। আশিসনগর কলোনির প্রাথমিক স্কুলে পঞ্চম শ্রেণি চালু হয়েছে। |
|
|
৩৯ নম্বরে কালভার্ট ভাঙা। |
৪০ নম্বরে রাস্তা থেকে বেরিয়ে পড়েছে ইট। |
|
আরও দাবি বস্তিতে কমিউনিটি শৌচাগার হয়েছে সাতটি। বার্ধক্য ভাতা পেয়েছেন ১৯ জন, বিধবা ভাতা ১০০ জন, প্রতিবন্ধী ভাতা এক জন, মৎস্যজীবী ভাতা ২ জন। দুঃস্থদের জন্য বিএসইউপি-র বাড়ি হয়েছে ৭২টি। আরও ২০টির কাজ চলছে। বিরসা মুন্ডা পল্লিতে কংক্রিটের রাস্তা হয়েছে। আশিসনগরে কমিউনিটি হলের কাজ চলছে। বিদ্যাসাগরপল্লির মাঝ বরাবর বয়ে যাওয়া ডিভিসির ফিডার ক্যানালে কাঠের সেতু বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আশিসনগর থেকে সরাসরি ডিপিএল কলোনিতে যাওয়ার জন্যও সেতু তৈরির পরিকল্পনা হলেও ডিভিসির আপত্তিতে তা সম্ভব হয়নি।
স্থানীয় কংগ্রেস নেতা উমাপদ দাস অবশ্য পাল্টা অভিযোগ করেন, বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতা, একশো দিনের কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বজনপোষণ হয়েছে। ক্ষুদিরামপল্লি ডিভিসি-র জায়গায়, তবু ভোটের কথা ভেবে সেখানে বেআইনি ভাবে পাট্টা দেওয়া হয়েছে। ডিপিএলের থেকে কর নেয় পুরসভা। কিন্তু উপযুক্ত পরিষেবা দেয় না। নিয়মিত নর্দমা পরিষ্কার হয় না। রাস্তা সংস্কারও হয় না। আশিসনগরের অবিনাশ গড়াই, ক্ষুদিরামপল্লির মিতা দাস, ডিপিএল টাউনশিপের অমিত গুহরাও বলেন, “যা পরিষেবা মেলার কথা তা মেলে না। কাউন্সিলরের উচিত আরও উদোগী হওয়া।”
যদি ধরেও নেওয়া যায় যে শ্যামাপদবাবুর ওয়ার্ডে জলসঙ্কট তেমন নেই, পাশের ওয়ার্ড ৪০ নম্বরের অবস্থা কিন্তু সঙ্গীন। সেখানে কুয়ো আছে, জল নেই। রাস্তায় আলো আছে, জ্বলে না। পুকুর সংস্কারের কাজ হয়েছে কিন্তু গভীরতা বাড়েনি।
রেলগেট, কল্পতরু নগর, ডিপিএল কলোনির ‘এ’ জোন, উড ইন্ডাস্ট্রিজ বস্তি, আমবাগান, দাসপাড়া, তালতলা, নববেদি বস্তি নিয়ে ৪০ নম্বর। ওয়ার্ডের সিপিএম কাউন্সিলর অসীম চক্রবর্তী ডিপিএল কর্মী। কেন কাজ হয়নি, তার কৈফিয়ত চাইতে লোকে তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। দাসপাড়ার বাবলু রুইদাস, রমাকান্ত দাস, অসীম রুইদাসদের অভিযোগ, কুয়ো মজে গিয়েছে। পুরসভা সংস্কার করেনি। বাধ্য হয়ে বাসিন্দারাই তা সংস্কার করেন। দাসপাড়ায় পথবাতি লাগিয়েছে পুরসভা। কিন্তু অধিকাংশই জ্বলে না। রাস্তাঘাট সংস্কার হয় না। আঁস্তাকুড় নেই। প্রয়োজন মতো নর্দমা হয়নি। স্থানীয় তৃণমূল নেতা মৃত্যঞ্জয় সিংহের অভিযোগ, “নাগরিক পরিষেবার বালাই নেই। বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতার ক্ষেত্রে স্বজনপোষণ হয়েছে। দাসপাড়ায় পুকুর সংস্কারের নামে বিপুল অর্থ নয়ছয় হয়েছে।”
অসীমবাবু অবশ্য দাবি করেন, “নিয়ম মেনেই সব কাজ হয়েছে। দলমত নির্বিশেষে মানুষ পরিষেবা পেয়েছেন।” তাঁর সাফাই, আইনি জটিলতার কারণে উড ইন্ডাস্ট্রিজ বস্তিতে বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি। বাকি সর্বত্র পৌঁছেছে। বস্তি এলাকায় ৯০ শতাংশ রাস্তা কংক্রিটের হয়েছে। ডিপিএল-এর সহযোগিতায় উড ইন্ডাস্ট্রিজ বস্তি থেকে রেলগেট পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছ’শো মিটার রাস্তা হয়েছে। প্রায় আড়াই কিমি দীর্ঘ নর্দমা হয়েছে ওয়ার্ডে। বিএসইউপি প্রকল্পে দুঃস্থদের জন্য ৫টি বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। বিধবা ভাতা পেয়েছেন ১৬ জন, বার্ধক্য ভাতা ৪৮ জন, প্রতিবন্ধী ভাতা ২ জন। তিনটি প্রাথমিক স্কুলে সীমানা পাঁচিল হয়েছে। কমিউনিটি শৌচাগার হয়েছে ১৬টি। দাসপাড়ায় পুকুর সংস্কার ও ঘাট বাঁধানো হয়েছে। একশো দিনের প্রকল্পে নিয়মিত নর্দমা সাফাই ও জঞ্জাল পরিষ্কার করা হয়। তাতে বেকারদের কর্মসংস্থান হচ্ছে।
কিন্তু সত্যিটা হল, গুচ্ছ গুচ্ছ অভিযোগের জবাব দিতে অসীমবাবুর এখন কালঘাম ছুটে যাচ্ছে। মন্দের ভাল যে, দল তাঁকে আর দাঁড় করায়নি। পড়শি শ্যামাপ্রসাদবাবু ফের টিকিট পেয়েছেন তার কারণ সম্ভবত মেয়র পারিষদ হিসেবে তাঁর ‘সাফল্য’। পুরকর্তাদের মতে, বিগত কয়েক বছরে যে ভাবে শহরের জনসংখ্যা বেড়েছে তাতে পানীয় জলের ভয়াবহ সঙ্কট দেখা দিতে পারত। তা যে হয়নি, তার জন্য অনেকটাই কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন মেয়র পারিষদ।
কংগ্রেসের উমাপদবাবু অবশ্য প্রশ্ন তুলছেন, “যিনি নিজের ওয়ার্ডেই জলসঙ্কট মেটাতে পারেননি, তাঁর দায়িত্বে বাকি ওয়ার্ডের কী অবস্থা?” তবে কি জলই ডোবাবে কমরেডকে?
রাজনীতিতে এ হেন সব প্রশ্নেরই যে স্পষ্ট উত্তর মেলে, তা অবশ্য নয়। কিছু উত্তর থাকেই, জলীয় বাষ্পের মতো ধোঁয়াটে...
|
নজরে নগর |
ওয়ার্ড ৩৯ |
ওয়ার্ড ৪০ |
• আশিসনগর থেকে ডিপিএল কলোনিতে
যেতে ক্যানালে কোনও সেতু নেই
• ডিপিএল কলোনিতে সাফাই অনিয়মিত।
• কয়েক জায়গায় পানীয় জলের সঙ্কট |
• ওয়ার্ডের বহু জায়গাতেই নিয়মিত
জঞ্জাল সাফাই হয় না
• বেহাল নিকাশি ব্যবস্থা
• পানীয় জলের সঙ্কট |
আমার ওয়ার্ডে পানীয় জলের সমস্যা নেই।
শ্যামাপ্রসাদ কুণ্ডু,
সিপিএম কাউন্সিলর |
কাজ করেছি বলেই না এত অভিযোগ!
অসীম চক্রবর্তী,
সিপিএম কাউন্সিলর |
নতুনপল্লি আদিবাসী পাড়ায় জলকষ্ট তীব্র।
উমাপদ দাস,
কংগ্রেস নেতা |
শুধু পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি করেছেন।
মৃত্যুঞ্জয় সিংহ,
তৃণমূল নেতা |
|