পুলিশে গান গায়, অনেকে বিশ্বাসই করেন না।
থানায় গেলে পুলিশ ধমক না দিয়ে গোলাপ দেয়, এ কথাই বা কে কবে শুনেছে?
কিন্তু জন্মদিনে দেড়শো বছরের রবীন্দ্রনাথ আর মহাকরণে এক বছরে পা রাখতে চলা নতুন সরকার, দুইয়ে মিলিয়ে বন্দুকের বদলে গান আর বিলাপ করলেই গোলাপ!
মোবাইল খুইয়ে মঙ্গলবার সকাল-সকাল বিরস মুখে বর্ধমান থানায় গিয়েছিলেন শরৎপল্লির অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। থানা-পুলিশের হ্যাঙ্গাম কী জিনিস, তা তো বিলক্ষণ জানা। কিন্তু এ কী! খোদ আইসি দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায় সহাস্যে এগিয়ে দিলেন গোলাপ। সঙ্গে লাড্ডু। গলা দিয়ে একটা গলতে না গলতেই ‘আর একটা নেবেন?’ |
পুরুলিয়ার হুড়া থানায় সকালে হঠাৎ হ্যালো হ্যালো... টেস্টিং... ওয়ান, টু, থ্রি...। আশপাশের লোকজন থতমত। হল কী? পুলিশ মাইক ফুঁকছে কেন? সরকারি নির্দেশে পুলিশ যে সপ্তাহভর ‘জন্মোৎসব’ করছে, তা সম্ভবত তাঁদের জানা ছিল না। গুটিগুটি পায়ে দু’চার জন সবে এগোবেন কি এগোবেন না করছেন, ভেসে এল ঘোষণা, ‘আজ রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন।’
মুখ চাওয়াচাওয়ি! মৃদু হাসি, হা-হা হাসি! হইচই। কনস্টেবলদের মধ্যে তখন ‘পহলে আপ’ গোছের বিনয়। মাইক্রোফোন হাতে ইনিংস শুরু করলেন ওসি রমেশ হাজরা ‘ভগবান তুমি যুগে যুগে...।’ কেউ কবিতা পড়লেন, কেউ গাইলেন গান। যাঁরা শুনলেন, তাঁদের জন্য ঠোঙা ভরা বোঁদে আর ভুজিয়া।
হুগলির শ্রীরামপুর থানায় অনুষ্ঠানের মাঝপথেই মাইক ধরেছিলেন সাব-ইনস্পেক্টর নিমাই বন্দ্যোপাধ্যায়। দরাজ গলায় আবৃত্তি। হাততালি। পুলিশে আপনি কী করছেন মশাই? পকেট হাতড়ে নিমাইবাবু বের করে আনেন ‘আবৃত্তি পরিষদ’ লেখা ভিজিটিং কার্ড। লাজুক হেসে বলেন, “সুযোগ পেলেই আবৃত্তিচর্চা করি। বাড়িতে আবৃত্তি শিক্ষণ কেন্দ্র আছে আমাদের।”
সকলে যে ‘লেফট-রাইট’ ছাড়া অন্য ছন্দ জানেন, তা কিন্তু মোটেই নয়। বরং ‘কাঠখোট্টা’ স্বামীকে বাঁচাতে মাঠে নামতে হয়েছিল অনেক শ্রীমতিকেই। ধুতি-পাঞ্জাবিতে পরিপাটি উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার চম্পক ভট্টাচার্যেরও হাসিমুখের আড়ালে চাপা টেনশন। স্ত্রী-বাহিনী যে আয়োজন করেছে, চম্পক-জায়া রুনুই তাঁদের পান্ডা। তবে তিনি ‘একা কুম্ভ’ নন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) জয় বিশ্বাসের স্ত্রী ঝুমা মাতালেন রবীন্দ্রনৃত্যে। রাজ্য পুলিশের আই জি (দক্ষিণবঙ্গ) মিহির ভট্টাচার্য ধরলেন, “এই কথাটি মনে রেখো।” কাকে বললেন কে জানে?
রবীন্দ্রনাথ নিয়ে যে ‘আমরা-ওরা’ করতে নেই, সেটা বলাই বোধহয় আসল উদ্দেশ্য ছিল দার্জিলিং জেলা পুলিশসুপার কুণাল অগ্রবালের। রবীন্দ্রনাথ বাঙালির
কবি। কিন্তু তিনি যদি শুধুই বাঙালির হন, পঞ্জাবের ভূমিপুত্র কুণাল করেন কী? মাইক ধরেই তিনি তাই জানিয়ে দেন, “রবীন্দ্রনাথ শুধু বাংলার নন, তিনি বিশ্বকবি। খুব ছোটবেলায় তিনি তাঁর বাবার সঙ্গে পঞ্জাবে গিয়েছিলেন। |
আমি গীতাঞ্জলি কিছুটা পড়েছি। আপনারাও পড়ুন।”
সরকার পরিবর্তনের পরে যখন ‘বড় করে’ বাইশে শ্রাবণ পালন হল, তখনই রবীন্দ্রনাথের ছবি জোগাড় করে যত্ন করে রেখেছিলেন অনেক থানার কর্তা। জানতেন, ক’মাস বাদেই কাজে লাগবে। সে সবই এ দিন ঝেড়ে-পুঁছে
বের করা হয়েছে। মুর্শিদাবাদ পুলিশের আবার অত সব মাথায় ছিল না। মনে পড়তেই ‘খোঁজ খোঁজ’। শেষে এক ফটো বাঁধাইয়ের দোকান থেকে ছবি এনে লাগানো হল। তার পর মালা।
মুর্শিদাবাদ জেলা গোয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি সুপার শুভেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় যখন হারমোনিয়াম বাজিয়ে ‘আকাশ ভরা সূর্যতারা’ ধরলেন, সূর্য তখন অনেকটাই চড়ে গিয়েছে। হাসি-হাসি মুখে শুনছিলেন সবাই। চোর-ডাকাত ধরে বেড়িয়েও পুরো বারোটা বাজেনি এখনও ফিসফিসিয়ে বলছিলেন এক জন।
ভিড়ের মধ্যে ছিলেন বহরমপুর থানার আইসি মেহাইমেনুল হক, সঙ্গে ক্লাস টেনে পড়া মেয়ে জামিলা। হঠাৎই তপ্ত বাতাসে ডেকে উঠল জামিলার গলা ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে...
হোক না বাবা আইসি, থাকুক না পুলিশ চারপাশে... |