এখনকার মত আগে গ্রামের দুনিয়া এতটা আধুনিকতায় ভরে ওঠেনি। তখন গ্রামে বিনোদনেরও এত অত্যাধুনিক নানা মাধ্যমও এসে পৌঁছয়নি। খুব সাধারণ, সহজ সরল জীবন বোধ থেকে গ্রামের মানুষ তখন বের করে নিতেন তাঁদের নিজস্ব বিনোদন। তাছাড়া সময়ও ছিল অনেক। ক্ষুদ্র বা বিকল্প সেচের অভাবে শুরু হয়নি দোফসলি কিংবা তিনফসলি চাষ। তাই বর্ষা অর্থাৎ ধান পোঁতার পর গ্রামের মানুষের হাতে কাজ থাকত না। ক্লান্তিকর একঘেয়েমি দূর করতে মূলত বয়স্ক এবং কৃষিজীবীরা মেতে উঠতেন গ্রাম্য খেলায়। তাঁদের মধ্যে সবথেকে জনপ্রিয় খেলা ছিল-- ‘মরদের লড়াই’।
একসময় গ্রাম্য বিনোদনের সেরা মাধ্যম ছিল এই খেলা। কিন্তু ভূমি সংস্কার এবং আধুনিক প্রযুক্তির সেচ ব্যবস্থার দৌলতে চাষের কাজ বেড়েছে। ফলে কৃষিজীবী গ্রামের মানুষের সময় কমেছে। অনেকে বিকল্প কাজও বেছে নিয়েছেন। ফলে ‘মরদের লড়াই’ নয়, গ্রামের মানুষের অবশিষ্ট সময়টুকুও ‘গ্রাস’ করে নিয়েছে অন্যান্য অত্যাধুনিক বিনোদন ব্যবস্থা। চর্চার অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে ‘মরদের লড়াই’-এর মতো কত নির্ভেজাল আনন্দের গ্রাম্য খেলা।
গ্রামের বয়স্কদের মলিন স্মৃতিতে যদিও আজও উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে ‘মরদের লড়াই’—
বাঁশের ‘ফরোটা’র (বাঁশ এবং দড়ি দিয়ে ঘেরা বৃত্তাকার কিংবা বর্গাকার স্থান) মাথায় লাঠিতে ঝোলানো রয়েছে লাল কার বা ফিতে দিয়ে বাঁধা তামা কিংবা অ্যালুমিনিয়ামের বেশ কয়েকটি মেডেল। সেই ফরোটার এককোণে ঢোল-কাঁসিতে বাজঝে তুমুল যুদ্ধের দামামা। আর ফরোটার ভিতরে রঙিন মখমলের জাঙিয়া ও হাতকাটা গেঞ্জি পড়ে ‘ফালা’ (উরু সন্ধি) চাপড়ে প্রতিপক্ষকে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আহ্বান করে পাকে পাকে ঘুরছে কোনও যুবক। এই দৃশ্য গ্রামের ওই সব মানুষদের মনে এখনও ফিকে হয়ে আসেনি। ‘মরদের লড়াই’ আদতে গ্রামের দিকে প্রতিযোগিতার রূপ নিত। যে প্রতিযোগিতার আগে সপ্তাহখানেক আগে থাকতেই গ্রামে গ্রামে ঢোল পিটিয়ে প্রচার করা হত। আহ্বান করা হত দর্শকদের। প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে ইচ্ছুকদেরও। |
কুস্তির সঙ্গে এই খেলার বেশ কিছুটা মিল রয়েছে। নিয়ম হল, দু’জন খেলোয়াড় প্রথমে ‘ফরোটা’র মধ্যে করমর্দন করবেন। তারপরেই শুরু হবে লড়াই। খেলায় প্রতিপক্ষকে কোনওরকম ইচ্ছাকৃত আঘাত না করে, কৌশলে মাটিতে চিৎ করে শুইয়ে দিতে হবে। তারপর তার বুকের উপর বসে উপরের দিকে দু’হাত তুলে ধরতে পারলেই তিনি জিতে যাবেন। বিবেচিত হবেন ‘মরদ’ হিসেবে। কর্মকর্তারা তার গলায় পরিয়ে দেন নির্ধারিত মেডেল। এরপর অবশ্য মেডেল জয়ী, তার ইচ্ছানুযায়ী ফের অন্য প্রতিপক্ষকে লড়াইয়ে আহ্বান করতে পারেন। তা না হলে শুরু হয় নতুন জুটির লড়াই। কোনও প্রতিযোগী ধারাবাহিক ভাবে সব প্রতিপক্ষকে চিৎ করে দিলে পান বিশেষ সম্মান। সমস্ত মেডেল-সহ একটি আকর্ষণীয় মেডেলেরও তিনি অধিকারী হন। ঘোষিত হন-- ‘সেরা মরদ’ বা ‘মরদের মরদ’।
একসময় ‘মরদের লড়াই’য়ে নিজের দাদার বিরুদ্ধেও নেমেছিলেন। বহু আসর মাতানো ‘লড়িয়ে’ ময়ূরেশ্বরের রামকৃষ্ণপুরের আবুল আহাদ শেখ কিংবা বহু লড়াইয়ের আয়োজক ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের রাধাকান্ত দাসদের আক্ষেপ, “এখনও কানে বাজে লড়াইয়ের আসরের সেই উত্তেজক ঢোল-কাঁসির বোল। এখন কোথায় সেই সব লড়িয়ে মরদ! কোথায় লড়াইয়ের আসর!”
|