|
|
|
|
|
প্রবন্ধ... যা দেখি, যা শুনি, একা একা কথা বলি |
ভালবেসে মিটল না সাধ, জীবন এত ছোট
ভেবেছিলাম, ধর্ম নিয়ে মানুষের মূর্খতা, পাগলামি, অসভ্যতা, নিষ্ঠুরতা একেবারে
শেষ হয়ে যাবে। ধর্ম নিয়ে মানুষের পরিচয় হবে না।
কিন্তু তা তো হলই না,
বরং যেন দিন দিন বাড়ছে। লিখছেন
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় |
|
|
— কেমন আছো, মণিদা?
— আরেঃ! তুই এসেছিস, পথ ভুলে নাকি?
— এই দিকে এক জায়গায় একটা কাজ ছিল। কাজটা তাড়াতাড়ি মিটে গেল, তাই ভাবলাম এক বার তোমার সঙ্গে দেখা করে যাই।
— মানে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্যই তুই বাড়ি থেকে বেরোসনি, এ দিকে তোকে আসতে হয়েছিল বলেই...
— তাই। হাসপাতাল কিংবা নার্সিংহোমে আমার আসতে ইচ্ছা করে না। আবার তোমার সঙ্গে অনেক দিন দেখা হয়নি সে জন্যও...
— বেশ! বোস বোস, আমার আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুুবান্ধব নিজেদের সময় নষ্ট করে আমাকে দেখতে আসবে, এসে গজল্লা করবে, সেটা আমার মোটেই ভাল লাগে না। নার্সিংহোমে থাকাটা বেশ পছন্দ হয়েছে আমার, খুব নিরিবিলি...
— কত বড় নার্সিংহোম, কত মানুষের আসা যাওয়া, তুমি বলছ নিরিবিলি?
— কেবিনের দরজা বন্ধ করে দিলে আর কিছুই টের পাওয়া যায় না। জানলা দিয়ে দেখি, একটা পার্কের মধ্যে একটা সরোবর। ঠিক একই জায়গায় রোজ বসে থাকে দুটি বক। মাঝে মাঝে দু’জন নার্স আসে আমাকে খাওয়াতে টাওয়াতে। কী সুন্দর তাদের ব্যবহার।
— তোমাকে এখন বেশ ভালই দেখাচ্ছে, চোখ-মুখ বেশ স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
— ভাল দেখাচ্ছে, তাই না? চলে যাওয়ার আগে চেহারাটা দুর্বল, প্যাঁকাটে, কিম্ভূতকিমাকার করার কোনও মানে হয় না।
— চলে যাওয়া... মানে... তুমি নার্সিংহোম থেকে কবে ছুটি পাচ্ছ?
— যে কোনও দিন। আমি ইচ্ছা করলে এক্ষুনি। এখানে আমার আর চিকিৎসার কিছু নেই। চলে যাওয়া মানে একেবারেই চলে যাওয়া।
— এ কী বলছ মণিদা। আমরা তো জানি যে তুমি —
— চিরযুবা, তাই না? বয়স আমাকে ছুঁতে পারে না! আমাকে ওই সব টক্ দিস না। আমার আয়ু আর মাত্র দু’মাস। শোন, এ দেশের ডাক্তাররা ক্রিটিকাল রোগীর কাছে আসল অবস্থাটার কথা লুকিয়ে যায়। অনেক দেশে রোগীদের পুরো সত্যটা জানিয়ে দেয়, তাতে তাদের মনের জোর বাড়তে পারে। এখানে এক জন তরুণ ডাক্তার, সদ্য বিলেত থেকে ফিরেছে, তাকে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আমার আয়ু আর কত দিন, সত্যি করে বলুন তো ভাই। সে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, দু’মাস থেকে ছ’মাস। আমাদের চিকিৎসাবিজ্ঞানে আপনাকে সাহায্য করার মতো আর কিছু নেই। সে কথা শুনে আমার বেশ ভাল লাগল। আমার বয়স তো কম হল না, জীবনকে যথেষ্ট উপভোগ করেছি। এখন চলে গেলে কেউ অকালমৃত্যু বলবে না। যেতে তো হবেই। তবে একটা কী আফসোস রয়ে গেল, জানিস? ভেবেছিলাম, আমার জীবৎকালেই দেখে যেতে পারব যে ধর্ম নিয়ে মানুষের মূর্খতা, পাগলামি, অসভ্যতা, নিষ্ঠুরতা একেবারে শেষ হয়ে যাবে। ধর্ম নিয়ে মানুষের পরিচয় হবে না। কিন্তু তা তো হলই না, বরং যেন দিন দিন বাড়ছে। এমনকী বহু শিক্ষিত মানুষও...
— শিক্ষিত তুমি কাদের বলবে মণিদা? যাদের মনের মধ্যে কোনও যুক্তিবোধ তৈরি হয়নি, যাদের মনের মধ্যে ভালবাসা শুকিয়ে গেছে, তাদের কিছু কেতাবি পড়াশোনার জন্যই শিক্ষিত বলা যায়? হিন্দু-মুসলমান, ইহুদি আর আরবের মুসলমান, খ্রিস্টান আর বৌদ্ধরা যখন তখন মারামারি করার জন্য তৈরি হয়ে আছে। |
|
অলৌকিক নয়? চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে পৃথিবী যেমন। শিল্পীর চোখে। |
— ধর্ম কথাটার সঠিক মানে কী, বল তো নীলু?
— সঠিক কোনও মানে এখন নেই। কিংবা থাকলে এখন কেউ মানে না। পুরোনো বাঁধাধরা বিশ্বাসকেই আগলে রেখেছে। মজার কথা কী জানো মণিদা, প্রত্যেক ধর্মেই এক জন করে আলাদা ঈশ্বর আছে, খ্রিস্টান, ইসলাম, হিন্দু মুনি-ঋষিদের পরম ব্রহ্ম। এদের কারওর সঙ্গে অন্যদের কোনও মিল নেই। তবু এরা মনে করে নিজের নিজের ধর্মের ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। এই বিশ্বাসের মধ্যে যে একটা চরম ছেলেমানুষি আছে, তা এই সব সম্প্রদায়ের শিক্ষিত লোকরাও বোঝে না? কিংবা বুঝেও ক্ষমতা দখলের চেষ্টায় নিজের নিজের ধর্মের ঢাক পেটায়।
— থাক, বাদ দে ও সব কথা। আমাদের কাশ্মীর সমস্যাও কোনও দিন মিটবে না। ইজরায়েল ও আরব দেশগুলির শত্রুতাও চলবে অনন্তকাল। আমার আর একটা আফসোস কী জানিস, ভেবেছিলাম আমি বেঁচে থাকতে থাকতেই দেখে যাব, আমাদের পৃথিবীর মতো এই মহাবিশ্বের আরও কোনও গ্রহে মানুষ কিংবা আর কোনও জ্যান্ত প্রাণী আছে কি না? বিজ্ঞানের এত উন্নতি হয়েছে, তবু এ পর্যন্ত কিছুই জানা গেল না।
— এই মহাবিশ্বটা বড্ড বড়।
— ঠিক বলেছিস, বিচ্ছিরি রকমের বড়। কত যে ছোট গ্রহ নক্ষত্র রয়েছে, তা আজও আমরা গুনে শেষ করতে পারিনি। আমাদের কল্পনাও এখানে হার মেনে যায়। এই পৃথিবীতে মানুষ ও কত সুন্দর প্রকৃতি রয়েছে। বিশ্বের আর কোথাও তা নেই। পৃথিবীর এই সৌভাগ্য হল কেন? আমরা খালি চোখে যত তারাকে ঝিকমিক করতে দেখি তার মধ্যে বেশ কিছু তারাই আর বেঁচে নেই। তবু তাদের আমরা দেখি। কারণ, তাদের আলো এখানে এসে পৌঁছতে বহু সহস্রাব্দ লেগে যায়। তার মানে, একটা জিনিস নেই, তবু তাকে আমরা দেখি, এটা একটা মজার ব্যাপার না?
— মণিদা, তোমাকে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে, আমাদের সবাইকেই যেতে হবে, তা নিয়ে কি তোমার মনে...
— আমি মৃত্যুকে ভয় পাই কি না জানতে চাইছিস? ঠিক ভয় নয়। তবে, আমি তো জানি, চলে যাওয়ার ব্যাপার কিছু নেই। মানুষের শেষ নিশ্বাস ফেলা মানেই সব কিছু শেষ। পরজন্ম ফরজন্ম বলে কিছু নেই, ও সব রূপকথা। মানুষের আত্মা বলেও কিছু নেই। ঈশ্বরের অস্তিত্বের মতো ওটাও একটা গুজব। যে হেতু এ সব আমি নিশ্চিত ভাবে জানি, তাই শেষ নিশ্বাস ফেলাটা যত দূর সম্ভব ঠেকিয়ে রাখা যায়, সে রকম ইচ্ছা তো হবেই। ভয় নয়, তবু সব মানুষেরই এ রকম আকাঙ্ক্ষা থাকে। অনেকে আবার আত্মহত্যাও করে। তারাও মূর্খ, কিংবা আমি তাদের বুঝি না। কটা বাজল রে? এ বার বোধহয় আমার যাওয়ার সময় হয়েছে।
— আমিও এ বার উঠব। তোমার ছবিগুলোর জন্য তোমাকে অনেকেই মনে রাখবে।
— মনে রাখুক বা না রাখুক, তাতে আমার বয়েই গেল। আমি তো তা জানতে পারছি না। হ্যাঁ রে, রবীন্দ্রনাথ নাকি আড়াই হাজার ছবি এঁকে গেছেন?
— সে রকমই তো একটা হিসেব পাওয়া যায়।
—অত লেখালেখি, কত গান, কত মিটিং তার মধ্যে এত ছবি এঁকে গেছেন? কী অসাধারণ মানুষ! আমি তো এঁকেছি মাত্র দুশো আড়াইশো। ওঁর চোখে আমি একটা শিশু।
— রবীন্দ্রনাথ অনেক ছোট ছবি, কাগজের উপর অনেক স্কেচ রেখে গেছেন, সেই সব মিলিয়ে আড়াই হাজার। রবীন্দ্রনাথ গ্রেট তো বটেই, কিন্তু তাঁর সঙ্গে তোমার তুলনাটা ঠিক নয়। তুমি এঁকেছ ক্যানভাসে, বেশির ভাগই অয়েলের কাজ। রবীন্দ্রনাথ তেল রং নিয়ে কিছু কাজ করেছেন কি না, তা আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। তোমার ছবি তো বিদেশেও বিক্রি হয়েছে।
— শোন, তোরা যারা ছবি আঁকার প্রক্রিয়াটা ঠিক জানিস না, তারা বুঝবি না, এখন তেল রঙের বদলে অ্যাক্রিলিকে অনেকেই কাজ করে। তাতে অনেকটা সময় বাঁচে। অ্যাক্রিলিক তাড়াতাড়ি শুকোয়। আমার কোনও ছবিই ঠিক যেন পারফেকশনে পৌঁছয়নি। তুই উঠছিস? ঠিক আছে, আবার দেখা হবে কি না জানি না।
— হ্যাঁ, দেখা হবে। তুমি এই নার্সিংহোমে থাক কিংবা বাড়িতে। আমি তার কাছাকাছি একটা কাজের ছুতোয় তোমার কাছে আসব।
শোন, আমি ধর্ম কিংবা মহাকাশ নিয়ে যা বলেছি, তা অতি সাধারণ কথা। আসলে ক্ষোভ কী জানিস, এখন আমার প্রায়ই মনে হয়, জীবন এত ছোট কেন? ভালবাসার সাধ তো মিটল না। এ বিষয়ে বোধহয় তারাশঙ্করবাবুর একটা লেখা আছে। আমি কিছু মানুষের ভালবাসা পেয়েছি ঠিকই, তবু যেন এখন এক সময় বুকের মধ্যে খাঁ খাঁ করে। একা থাকলেই মনে মনে বলতে থাকি, ভালবেসে মিটল না সাধ, ভালবেসে মিটল না সাধ, মিটল না সাধ... |
|
|
|
|
|