দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজের ‘সুপ্রিম কাউন্সিল’ স্থির করিয়াছেন, প্রথম বর্ষে ভর্তির ক্ষেত্রে চল্লিশ শতাংশ আসন ছাত্রদের জন্য সংরক্ষণ করা হইবে। মেয়েদের জন্য আইনসভায় আসন সংরক্ষণ সংক্রান্ত বিবাদে রঙ্গচ্ছলে, কখনও বা ব্যঙ্গচ্ছলে পুরুষের জন্য সংরক্ষণের ‘প্রস্তাব’ শোনা যায় বটে, কিন্তু তাহাই বাস্তবটিকে বুঝাইয়া দেয়। বাস্তব ইহাই যে, মেয়েরা অনগ্রসর জাতি বা বর্ণ কিংবা শ্রেণিভুক্ত গোষ্ঠীর মতোই সমাজে পশ্চাৎপদ, প্রান্তিক, সেই কারণেই তাহাদের জন্য সংরক্ষণের প্রসঙ্গ ওঠে। পুরুষের জন্য সংরক্ষণের প্রসঙ্গ ওঠে না, কারণ সমাজ পুরুষের দ্বারাই শাসিত। ক্ষমতা যাহার হাতে, তাহার বিশেষ সুবিধা দরকার হইবে কেন?
তবে সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে পুরুষের জন্য আসন সংরক্ষণের কথা উঠিল কেন? উঠিল এই কারণে যে, সেখানে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে পুরুষের অনুপাত কমিতে কমিতে প্রায় তলানিতে ঠেকিয়াছে, ইদানীং দুই-তৃতীয়াংশ পড়ুয়াই ছাত্রী। এই কলেজ অতীতে কেবল ছাত্রদের জন্যই নির্ধারিত ছিল, সত্তরের দশকে ইহার দ্বার ছাত্রীদের জন্য উন্মুক্ত হয়। প্রায় চার দশকের অবকাশে ছাত্রীস্রোত ক্রমে প্লাবনে পরিণত হইয়াছে, সেন্ট স্টিফেন্স কালক্রমে ছাত্রীসর্বস্ব হইবার ‘আশঙ্কা’ দেখা দিয়াছে। এক কালে কেবল ছাত্রদের কলেজ ছিল বলিয়াই হয়তো এই পরিণতি পরিচালকদের নিকট দ্বিগুণ ভয়াবহ ঠেকিয়াছে। অতএব সংরক্ষণের উদ্যোগ। ইতিমধ্যেই এই উদ্যোগে বাধা পড়িয়াছে, কলেজের শিক্ষক ও পড়ুয়াদের সমালোচনার মুখে পড়িয়া পরিচালকরা সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত আপাতত মুলতুবি রাখিতেছেন।
মেয়েদের অনুপাত বৃদ্ধির এই প্রবণতা বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই প্রকট। কেবল এ দেশে নয়, দুনিয়ার বহু দেশেই শিক্ষায় মেয়েরা ছেলেদের পাশাপাশি অথবা তাহাদের আগে স্থান করিয়া লইয়াছে। তাহার নানা কারণ থাকা সম্ভব। ছেলেরা হয়তো ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি, আই টি ইত্যাদি বৃত্তিমুখী শিক্ষায় বেশি মনোনিবেশ করিতেছে বলিয়াই সাধারণ শিক্ষায়, বিশেষত মানবিকীবিদ্যায় মেয়েদের অনুপাত ক্রমবর্ধমান। অন্য দিকে, সাধারণ ভাবে মেয়েরা পড়াশোনায় অনেক বেশি মনোযোগী ও সুশৃঙ্খল, সুতরাং ‘ভাল কলেজ’-এ উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ বেশি পাইতেছে, এমন কথাও মনে করিবার কারণ আছে। স্কুল শেষ করিবার বিভিন্ন পরীক্ষায় মেয়েদের আপেক্ষিক সাফল্যের ধারাবাহিকতা এই সম্ভাবনাকেই চিহ্নিত করে। লক্ষণীয়, নাগরিক জীবনযাত্রার আধুনিক রূপ ও চরিত্র মনোযোগ এবং মানসিক শৃঙ্খলাকে উত্তরোত্তর বিধ্বস্ত করিয়া চলিয়াছে, বিক্ষিপ্ত হইবার অগণিত উপকরণ সতত চার পাশে মজুত থাকিলে মনঃসংযোগ দুঃসাধ্য। সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের প্রচলিত নিয়মেই এই বিক্ষিপ্ততার প্রভাব ছেলেদের উপর মেয়েদের তুলনায় অনেকটা বেশি। ছেলেরা অনেক বেশি ‘স্বাধীনতা’ ভোগ করে, সেই স্বাধীনতা কি তাহাদের পশ্চাৎপদ করিয়া তুলিতেছে? তাহারা কি ‘নিজের মতো’ জীবন কাটাইতে গিয়া ভাল কলেজের প্রতিযোগিতায় আঁটিয়া উঠিতে ব্যর্থ হইতেছে? ‘পৌরুষ’-এর মহিমায় বিহ্বল না হইয়া পুরুষের বরং আত্মসমীক্ষা কর্তব্য। নতুবা শেষ অবধি সংরক্ষণের যষ্টি হাতে ধরিতে হইলে পৌরুষ লজ্জিত হইবে না কি? |