ভাগ্য সচরাচর এক সুযোগ দুই বার দেয় না। পশ্চিমবঙ্গ ব্যতিক্রম। হিলারি ক্লিন্টনের সফর-বাহিত হইয়া পশ্চিমবঙ্গে ফের সুযোগ আসিয়াছে। দীর্ঘ স্থবিরতা কাটাইয়া জঙ্গম হইবার সুযোগ। কিন্তু হেলায় সুযোগ নষ্ট করিবার অভ্যাস এই বঙ্গের মজ্জাগত। ফলে, নূতন সুযোগ দ্বারে কড়া নাড়িলে আশার সহিত আশঙ্কাও অনিবার্য। প্রশ্ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাড়াইয়া দেওয়া হাতটি পশ্চিমবঙ্গ ধরিবে কি? প্রশ্নটি সহজ নহে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এখনও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনে জাতীয় ছুটি ঘোষণার দাবিতে কেন্দ্রের নিকট দরবার করেন। এই মানসিকতা লইয়া নূতনের আবাহন কঠিন কাজ। অতীতের বোঝা ত্যাগ করিলে তবেই ভবিষ্যতের সহিত মিলন সম্ভব। রাজ্যের মসনদে শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়ের পূর্বসূরিরা যেমন আর এক অতীতের বোঝা বহিয়াই ৩৪ বৎসর কাটাইয়া দিলেন, উন্নয়নের সহিত তাহাদের সংলাপ আর সম্ভব হইল না।
আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের ছিল মার্কস-লেনিনের বোঝা বস্তাপচা বামপন্থী বুলি শিরোধার্য করিবার দায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই দায় নাই। কিন্তু, তিনি নিজের জন্য প্রায় সমান ওজনের একটি জগদ্দল খুঁজিয়া লইয়াছেন। তাহার নাম, তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী ইশ্তেহার। বস্তুত, মার্কস-লেনিনের যে বন্ধনে বামপন্থীদের হাত বাঁধা ছিল, তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী ইশ্তেহারও ঠিক সেই বন্ধনেই শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়কে বাঁধিয়াছে বামপন্থীদের ন্যায় তিনিও ছাপা অক্ষরকে ‘ঈশ্বর’, অতএব অলঙ্ঘ্য, জ্ঞান করিয়াছেন। বামপন্থীরা যে অক্ষরের দাস ছিলেন, তাহা অপরের লেখা আর শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর প্রভূত্ব করিতে উদ্যত অক্ষরগুলি তাঁহারই সৃষ্ট, এইমাত্র ফারাক। বামপন্থীরা বুঝেন নাই, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বুঝিতেই হইবে যে রাজ্যের স্বার্থ অপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নাই। রাজ্যের স্বার্থে যদি দলীয় ইশ্তেহারটিকে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করিতে হয়, তাহা করাই বিধেয়। তাহাতে আকাশ ভাঙিয়া পড়িবে না। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বলিয়াছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমবঙ্গকে ‘অংশীদার রাজ্য’ হিসাবে পাইতে ইচ্ছুক। খুচরা ব্যবসায়ে বিদেশি বিনিয়োগ প্রসঙ্গে তাঁহার দলীয় ইশ্তেহার যাহাই বলুক না কেন, সেই কথা বিস্মৃত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। মাও জে দং বা লেনিনের ন্যায় নেতা, বৃহৎ রাজনীতির স্বার্থে, নিজেদের কথা হইতে সরিয়া আসিয়াছেন। ঘরের কাছেও উদাহরণ আছে। গাঁধীর আধুনিক শিল্প-বিরোধী রাজনৈতিক দর্শনের কংগ্রেসি লাইন হইতে বহু দূরে সরিয়া নেহরু যোজনা-কেন্দ্রিক বৃহৎ শিল্পায়নের পথে হাঁটিয়াছিলেন। ব্যক্তিগত স্বার্থে নহে, দেশের স্বার্থে। পশ্চিমবঙ্গও এমন একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তের পথ চাহিয়া আছে।
মার্কিন বিদেশ সচিব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহিত সম্পর্কের সূচনাটি চমৎকার করিয়াছেন। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ‘জেদ’-কে প্রশ্রয় দিলে চলিবে না। অনেকেই নিজের ভাল বুঝিতে পারেন না। তখন প্রয়োজনে তাহার প্রতি নির্মম হইতে হয়, কঠোর ভাবে শাসন করিতে হয়। কঠোর না হইতে পারিলে তাহার ফল বিষম হয়। একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ: মার্কিন অভিনেত্রী লিন্ডসে লোহান। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গাড়ি চালাইবার অপরাধে আদালত তাহাকে পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠায়। কিন্তু, মেয়াদ সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই তিনি ছাড়া পান। আবারও একই অপরাধ করেন। ভিন্নতর অপরাধেও তাঁহার নাম জড়াইয়া যায়। তাঁহার কারাদণ্ডের আদেশ হয়। অভিনেত্রী হিসাবে তাঁহার যে সম্ভাবনা ছিল, তাহা কার্যত নষ্ট হইয়া যায়। প্রথম বারেই প্রশাসন যথেষ্ট কঠোর হইলে হয়তো এই পরিণতি হইত না। শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে উদাহরণটি স্মর্তব্য। বস্তুত, তাঁহার জেদকে প্রশ্রয় না দিলে তিনি যে বিচক্ষণতার পথে ফিরিয়া আসেন, সাম্প্রতিক ইনফোসিস-কাণ্ডে তাহা প্রমাণিত। কেন্দ্রীয় সরকারকে পশ্চিমবঙ্গে ইনফোসিস-এর ক্যাম্পাসকে আই টি পার্ক-এর মর্যাদা দিতে বলিয়া তিনি প্রমাণ করিয়াছেন, রাজনীতির সহজপাঠ তিনি ভুলেন নাই। মার্কিন প্রশাসন এই ঘটনাক্রম হইতে শিখিতে পারে। |