পুরো ব্যাপারটার দায়িত্বে রয়েছে পূর্ত দফতর। অথচ তাদের কাউকে না-ডেকে নিজেদের লোক দিয়েই ঘরের বিদ্যুৎসজ্জা পাল্টে ফেলছেন মন্ত্রী থেকে শীর্ষ পুলিশকর্তা! ফলে চাপ বাড়ছে বিদ্যুৎবাহী তারের উপরে। বাড়ছে অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কা।
এ হেন ‘আগুনে আশঙ্কা’ নিয়ে কার্যত বারুদের স্তূপের উপরে দাঁড়িয়ে আছে খাস রাজ্য প্রশাসনের সদর ভবনটি। অর্থাৎ মহাকরণ। পুলিশের ডিজি-র ঘর থেকে শুরু করে ডিজি কন্ট্রোল, তথ্য-সংস্কৃতি থেকে পূর্ত গত ক’মাসে মহাকরণের বিভিন্ন অফিসে পরের পর অগ্নিকাণ্ডের তদন্তে নেমে এমনটাই জানতে পেরেছে রাজ্য পূর্ত দফতর। শুধু তা-ই নয়, তদন্তে বেরিয়ে এসেছে আরও মারাত্মক একটি তথ্য। তা হল, মহাকরণের আনাচে-কানাচে বৈদ্যুতিক সংযোগ বিন্যাসের ‘মূল’ যে নক্শা (মাস্টার প্ল্যান), নানা রদবদলের পরিণতিতে তা এখন প্রায় তামাদি!
ফলে বিদ্যুতের লাইনে কোথাও গণ্ডগোল থাকলে ধরাটাই মুশকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমনটা হল কী ভাবে?
মহাকরণের এক কর্তা বলেন, “ব্রিটিশ আমলে তৈরি রাইটার্স বিল্ডিংয়ে বিদ্যুৎ পরিবহণ ব্যবস্থার একটা ‘মাস্টার প্ল্যান’ ছিল। সেটা থাকত পূর্ত দফতরের কাছে। পুরো বাড়িটার কোথায় কী ভাবে বিদ্যুতের তার গিয়েছে, ওই নক্শার মাধ্যমে তা সহজে চিহ্নিত করা যেত। তারের বিন্যাসে কোথাও কোনও পরিবর্তন হলে মাস্টার প্ল্যানেও সেই ভাবে বদল করা হতো।” কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, মহাকরণের পরিসর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ধীরে ধীরে মাস্টার প্ল্যানই ওলট-পালট হয়ে গিয়েছে। অভিযোগ, সম্প্রতি অনেক বিভাগে, এমনকী ভিভিআইপি অঞ্চলের বেশ কিছু তাবড় মন্ত্রী-আমলার ঘরেও পূর্ত দফতরকে না-জানিয়ে বাইরের সংস্থাকে দিয়ে নতুন ভাবে লাইন করা হয়েছে। বহু জায়গায় টেলিফোন ও কম্পিউটার নেটওয়ার্কের তারের ভিড়ে জঙ্গল হয়ে গিয়েছে। সব মিলিয়ে মহাকরণের
বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় সার্বিক নজরদারিতেই সমস্যা তৈরি হচ্ছে। |
সঙ্কটের সুরাহায় এ বার মহাকরণের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ঢেলে সাজার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর ঘোষ সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে পূর্ত ও দমকলের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তারের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে সুপরিকল্পিত বিদ্যুৎ পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে মহাকরণ জুড়ে। প্রথম নজর দেওয়া হচ্ছে ‘ভিভিআইপি জোনে।’ পরে দফায় দফায় মহাকরণের সর্বত্র বিদ্যুৎ ব্যবস্থার আমূল সংস্কার হবে। নতুন করে ‘ওয়্যারিং প্ল্যান’ বানাবে পূর্ত দফতর।
দেওয়ালে-দেওয়ালে কুণ্ডলী পাকানো তারের গুচ্ছকে ‘স্টিল ট্রে’র মধ্যে দিয়ে চালান করা হবে। মুখ্যসচিব এ-ও নির্দেশ দিয়েছেন, নতুন ব্যবস্থা চালু হওয়ার পরে পূর্তের অনুমতি ব্যতীত কোথাও ওয়্যারিং পাল্টানো যাবে না।
কিন্তু ‘বিস্মরণ’ বা নজরদারিতে ‘ঢিলেমি’র দাওয়াই কী? প্রতি দফতরে কম্পিউটার, এসি-সহ বিদ্যুৎচালিত সরঞ্জামের সংখ্যা বেড়েছে। এবং অনেক সময়ে ছুটির পরে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা সেগুলো অফ করতে ভুলে যাচ্ছেন! বহুক্ষণ ধরে চলার পরে যন্ত্রগুলি গরম হয়ে গিয়ে অগ্নিকাণ্ডের সম্ভাবনা তৈরি করছে। বস্তুত কিছু দিন আগে তথ্য-সংস্কৃতি দফতরে কম্পিউটার এবং পূর্ত দফতরে এসি মেশিন চালিয়ে রেখে যাওয়ার ফলেই আগুন লেগেছিল বলে জানিয়েছেন মহাকরণের এক কর্তা।
মুখ্যসচিবের বৈঠকে অবশ্য এ প্রসঙ্গটিও ওঠে। স্থির হয়েছে, প্রতিটি দফতরে, বিশেষত যেখানে যেখানে প্রচুর বিদ্যুৎচালিত সরঞ্জাম রয়েছে, সেখানে ‘মাস্টার সুইচ’ লাগানো হবে। সেটি অফ করে দিলে বিভাগের যাবতীয় বিদ্যুৎচালিত সরঞ্জাম একসঙ্গে বন্ধ হয়ে যাবে। এতে ‘অন্যমনস্কতা’র কারণে অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কা এড়ানো যাবে কর্তারা মনে করছেন।
পাশাপাশি মহাকরণের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ও নজরদারি জোরদার করে তোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ‘ফায়ার কন্ট্রোল রুম’ তৈরির কাজ শুরু হচ্ছে শিগগিরই। আগুন নেভানোর পরিকাঠামো ঠিকঠাক আছে কি না, প্রতি মাসে পূর্ত ও দমকল যৌথ ভাবে তা খতিয়ে দেখবে।
পরিকল্পনাগুলিকে বাস্তবায়িত করতে কয়েক কোটি টাকা খরচ হবে বলে মনে করছেন পূর্ত-কর্তারা। মুখ্যসচিবের নির্দেশে সম্ভাব্য খরচের হিসেব কষাও শুরু হয়েছে। “আশা করছি, দিন দশেকের মধ্যে হিসেবটা মুখ্যসচিবকে দিতে পারব।” বলেন ওই কর্তা। |